লোকে সাধারণত ছবি ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখে। রেহানার কোনো ছবি ছিল না। তাই তার বাবা আবদুস সালাম খান রেহানার গায়ের জামাটিই ফ্রেমে বাঁধিয়ে রেখেছিলেন। খুবই সাধারণ, এক রাঙা ফিকে হলুদ সুতি কাপড়ের হাতাকাটা জামা। বুকের সামনে দিয়ে লম্বা ফিতার মতো করে খয়েরি রঙের এক ফালি কাপড় জুড়ে দেওয়া, নকশা বলতে এটুকুই।
আবদুস সালাম খানের কাছে তাঁর চার মাস বয়সী মেয়ের এই জামা কাচের ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখার মতোই মহার্ঘ বস্তু ছিল। কারণ, বড়ই নির্মমভাবে শিশুটিকে হত্যা করা হয়েছিল। মেয়ের স্মৃতি বলতে আর কিছু ছিল না তাঁর কাছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই বয়সী শিশুমাত্রই নিষ্পাপ। তবু ১৯৭১ সালে তাকে নির্মম হত্যার শিকার হতে হয়েছিল পিতার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য। রেহানার এই জামা এখন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ২ নম্বর গ্যালারিতে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক নিদর্শন হিসেবে প্রদর্শিত হচ্ছে। নিদর্শনটির পাশে সংক্ষিপ্ত বিবরণও আছে।
খুলনার সেনহাটি গ্রামের আবদুস সালাম খানের মেয়ে রেহানা। আবদুস সালাম খান বরাবরই ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন–শোষণের বিরুদ্ধে। অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। গ্রামের তরুণদের সংগঠিত করে তাঁদের যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য প্রশিক্ষণ দিতেন। তিনি ছিলেন তাঁদের দলপতি। এই বিষয়গুলো দালাল–রাজাকাররা ভালো চোখে দেখেনি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আবদুস সালাম খান তরুণদের নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
মুক্তিযুদ্ধের এক পর্যায়ে ১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিল স্থানীয় দালালেরা হানাদার পাকিস্তানি সৈনিকদের নিয়ে এসে আবদুস সালাম খানের বাড়ি ঘেরাও করে ফেলে। সালাম খানকে না পেয়ে ঘাতকের দল ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর মেয়ে রেহানাকে বাড়ির উঠানে আছাড় দিয়ে বুটের তলায় পিষে হত্যা করে চলে যায়। বাড়ির নারীরা এই পৈশাচিকতায় ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। খবরটি রাতে সালাম খানের কানে পৌঁছায়। তিনি গভীর রাতে বাড়িতে এসে চার মাসের মেয়ে রেহানার রক্তাক্ত মরদেহটি ধুয়েমুছে পরিচ্ছন্ন করে বাড়ির পাশের রূপসা নদীতে ভাসিয়ে দেন। একবুক শোক নিয়ে ফিরে যান রণাঙ্গনে।
যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করলেন আবদুস সালাম খানের মতো বীর মুক্তিযোদ্ধারা। তিনি ফিরে এলেন রণাঙ্গন থেকে। মেয়ে তো নেই। স্বাধীনতার জন্য চরম মূল্য দিতে হয়েছে তাঁকে। মেয়ের স্মৃতিরক্ষার জন্য রেহানার গায়ের জামাটিই কাচের ফ্রেমে বাঁধিয়ে পরম যত্নে আগলে রেখেছিলেন বছরের পর বছর।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কাছে এই নিদর্শন তুলে দিয়েছিলেন সালাম খান নিজেই। জাদুঘরের ট্রাস্টি বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক মফিদুল হক প্রথম আলোকে জানালেন, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করার পর তাঁরা ট্রাস্টিরা দেশের বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক সফর করেছিলেন। সুধী সমাবেশ করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযোদ্ধাসহ জনসাধারণকে এই উদ্যোগ সম্পর্কে জানানো এবং তাঁদের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের জন্য নিদর্শন সংগ্রহ করা। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৬ সালের শুরুর দিকে খুলনায় তাঁরা এমন একটি সুধী সমাবেশ করেছিলেন। ট্রাস্টি হিসেবে তিনি ও সদস্যসচিব আক্কু চৌধুরী গিয়েছিলেন সেখানে। সেই সমাবেশে এসেছিলেন আবদুস সালাম খান। তিনি পেছনের সারিতে বসে ছিলেন। খবরের কাগজে মোড়ানো একটি ফটোফ্রেমের মতো কিছু একটা বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলেন তিনি। সভা শেষ হলে সালাম খান তাঁদের কাছে এসে নিজের পরিচয় দেন। তারপর কাগজে মোড়ানো জিনিসটি তাঁদের হাতে তুলে দিয়ে রেহানার মর্মান্তিক পরিণতির কথা তাঁদের বলেন।
আবদুস সালাম খান পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ও কর্মীদের খুব কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। খুলনা থেকে তিনি মাঝেমধ্যে ঢাকায় আসতেন শুধু মেয়েটির ওই স্মৃতিচিহ্ন দেখার জন্য।
জাদুঘরের ট্রাস্টি ও ছায়ানটের সভাপতি ডা. সারওয়ার আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সালাম খান প্রদর্শন কক্ষে গিয়ে রেহানার জামার সামনে নীরবে অপেক্ষা করতেন। আমরা তাঁর বসার জন্য একটা টুলের ব্যবস্থা করে দিতাম। অনেক সময় তিনি দুপুরে কিংবা বিকেলে আমাদের সঙ্গে খাবার খেতেন। তারপর চলে যেতেন। আমাদের সবার সঙ্গেই তাঁর একরকম আন্তরিকতা সৃষ্টি হয়েছিল।’
মেয়ের শোক ভুলতে না পারা সেই পিতা আবদুস সালাম খান এখন আর নেই। তিনি ২০০৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ইন্তেকাল করেছেন। বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর।
রেহানার জামাটি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সংগৃহীত নিদর্শনগুলোর মধ্যে একটি অত্যন্ত বেদনাবিধুর ঘটনার স্মৃতির স্মারকই শুধু নয়, এর গভীর তাৎপর্য রয়েছে। ডা. সারওয়ার আলী বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের এখানে যে প্রকৃতপক্ষেই গণহত্যা করা হয়েছিল এবং অবোধ শিশু পর্যন্ত সেই গণহত্যার কবল থেকে রক্ষা পায়নি, এই জামা তার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ।’
বিজয়ের মাস শুরু হলো। অনেক বীরের রক্ত, রেহানাদের মতো অনেক কন্যা, মাতা, ভগ্নির আত্মদানের অনেক চড়া মূল্যে অর্জিত বলেই মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয় জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন। এর সমতুল্য আর কিছু নেই।