নতুন টেলিযোগাযোগ আইনের খসড়া তৈরি করেছে সরকার। সামান্য কিছু বদল ছাড়া বিদ্যমান আইনের সবকিছুই রাখা হয়েছে এতে। নতুন করে আইনটি কেন করা হচ্ছে, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই খসড়ায়। আবার খসড়ায় যেসব পরিবর্তন আনা হয়েছে, সেগুলোর কিছু বিষয় নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ নতুন টেলিযোগাযোগ আইন, ২০২৪-এর এই খসড়া করেছে।
খসড়ার শুরুতে আইনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে টেলিযোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন এবং টেলিযোগাযোগ সেবা নিয়ন্ত্রণে একটি স্বাধীন কমিশন প্রতিষ্ঠাসহ মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতা, কার্যাবলি ও দায়িত্ব কমিশনের কাছে হস্তান্তরসহ আনুষঙ্গিক বিষয়ে বিধান করা প্রয়োজন। তাই আইন করা হলো।
এক যুগ আগে যখন বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০১ করা হয়, সেখানেও হুবহু একই উদ্দেশ্যর কথা লেখা ছিল। স্বাধীন কমিশন গঠনেরও এক যুগ হয়েছে। বিদ্যমান আইনে কাজ করতে গিয়ে সরকার কী কী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে যে নতুন করে আইন করতে হচ্ছে—বিশেষজ্ঞরা সে প্রশ্ন তুলেছেন। আবার সরকারের অনেক আইন থাকার পর নতুন করে এ-সংক্রান্ত আইন করা নিয়ে সমালোচনা উঠেছে।
এক যুগ আগে যখন বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০১ করা হয় সেখানেও প্রস্তাবিত আইনের হুবহু একই উদ্দেশ্যর কথা লেখা ছিল।
কিছু ধারায় পরিবর্তন এনে সরকার ২০০৬ ও ২০১০ সালে টেলিযোগাযোগ আইন সংশোধন করেছিল। এবারের খসড়ায় আগের আইনের প্রায় সবই রাখা হয়েছে। কিন্তু প্রস্তাবিত আইনটিতে আগের আইন রহিত হবে কি না, উল্লেখ নেই। শুধু বলা হয়েছে, টেলিগ্রাফ অ্যাক্ট ১৮৮৫ ও ওয়্যারলেস টেলিগ্রাফি অ্যাক্ট, ১৯৩৩ রহিত হবে। তবে প্রস্তাবিত আইনের জন্য যদি উল্লিখিত দুটি আইনের অধীন বিধি বা কোনো কিছু সংগতিপূর্ণ হয়, তবে তা প্রয়োগ করা যাবে।
খসড়া বিষয়ে জানতে চাইলে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটি (খসড়া) এখনো চূড়ান্ত হয়নি, অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। সর্বশেষ সংশোধনের পর (বিদ্যমান আইন) ১৪ বছর পার হয়েছে। এ সময়ে প্রযুক্তিগত অনেক পরিবর্তন এসেছে। স্মার্ট বাংলাদেশের রূপকল্প ও যুগের চাহিদার জন্যই নতুন আইনের প্রয়োজন।’ আগের আইন রহিত করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আলোচনা ও প্রস্তাবের পর সিদ্ধান্ত হবে, আগের আইনগুলোর কী হবে।
খসড়ায় আনা উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের মধ্যে আইনটির প্রয়োগের আওতায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, সেলব্রডকাস্টিং ও ইন্টারনেট প্রটোকলভিত্তিক (আইপি) সেবাসহ সব ধরনের টেলিযোগাযোগ সেবা যুক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোকে আইনের আওতায় লাইসেন্স নিতে হবে। এ ছাড়া দেশের বাইরে থেকে কোনো ব্যক্তি অপরাধ করলে তিনিও এ আইনের আওতায় পড়বেন।
খসড়া আইনের অধীন যে কমিশন গঠনের কথা বলা আছে, সেই কমিশন বিটিআরসিই ‘রেগুলেশন ফর ডিজিটাল অ্যান্ড সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মস, ২০২১’ শীর্ষক প্রবিধান খসড়া করেছে। অন্যদিকে ‘ওভার দ্য টপ (ওটিটি) কনটেন্টভিত্তিক পরিষেবা প্রদান এবং পরিচালনা এবং বিজ্ঞাপন প্রদর্শন’ নীতিমালার খসড়া করেছে তথ্য মন্ত্রণালয়। আবার আইপিটিভির অনুমোদন দিচ্ছে তথ্য মন্ত্রণালয়। ওদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ২০১৮ সালে ‘জাতীয় ডিজিটাল কমার্স’ নীতিমালা তৈরি করেছে। এ ছাড়া একই মন্ত্রণালয়ের অধীন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে যাঁরা ব্যবসা করেন, তাঁদের নিবন্ধন নিতে হয়।
টেলিযোগাযোগ আইনের নতুন খসড়ায় অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ যেসব নতুন বিষয় যুক্ত করা হয়েছে, সেগুলোর কোনো সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। বিদ্যমান আইনের সংজ্ঞায় যেসব বিষয় আছে, সেগুলোই এ খসড়ায় রাখা হয়েছে।
মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশ (অ্যামটব) খসড়ার ওপর নিজেদের পর্যবেক্ষণ জানিয়েছে। তারাও বলেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অনলাইনভিত্তিক প্ল্যাটফর্মের অন্তর্ভুক্তি জটিলতা তৈরি করবে। এগুলো স্পষ্ট করা প্রয়োজন।
অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ কতগুলো মন্ত্রণালয়ের আওতায় পড়বে, সবারই বিটিআরসি থেকে অনুমতি নিতে হবে কি না—এমন প্রশ্ন উঠেছে।
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আজকের ডিলের প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম মাশরুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘সবারই এখন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। তাহলে ব্যবসা করতে গেলে কি সবারই বিটিআরসিরও অনুমতি নিতে হবে? এমনিতেই এখানে ডুয়িং বিজনেস (ব্যবসা করার পরিবেশ) ভালো না। এখন টেলিযোগাযোগ আইনের নতুন খসড়া অনুযায়ী বিষয়গুলো আরও জটিল ও কঠিন হবে।’
তবে প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেগুলো খসড়া পর্যায়ে আছে, তা নিয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এ জন্য এই আইনে প্রস্তাব আনা হয়েছে। যেখানে সাংঘর্ষিক হবে, সেখানে একত্র হয়ে কাজ করা হবে।’
খসড়ায় নতুন যুক্ত করা হয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। অ্যামটব এ-সংক্রান্ত বিধানের অপসারণ চেয়েছে। তারা বলছে, টেলিকম পরিষেবার ধরন ও প্রযুক্তিগত বিষয় বিবেচনা করে তাৎক্ষণিক মূল্যায়ন এবং এর ভিত্তিতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা সম্ভব নয় এবং ন্যায়সংগত নয়।
অপারেটররা বলছে, কয়েকটি বিষয় ছাড়া এটি আগের আইনই। স্মার্ট বাংলাদেশ ও বিনিয়োগ বাড়ানোর চিন্তা বিবেচনায় এ আইন ২০৪১ সালকে মাথায় রেখে করা হয়নি।
খসড়ায় যুক্ত করা বিষয়ের মধ্যে আরও আছে, সাইবার নিরাপত্তায় টেলিযোগাযোগব্যবস্থার মাধ্যমে সৃষ্ট, প্রেরিত, গৃহীত বা সংরক্ষিত ট্রাফিক/ইন্টারনেট ডেটা সংগ্রহ ও পর্যালোচনা করতে পারবে কমিশন।
মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি অব মালয়ের আইন ও উদীয়মান প্রযুক্তি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মুহাম্মদ এরশাদুল করিমের কাছে এ খসড়া প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হয়। তিনি বলেন, নতুন করে কেন করা হলো, বোঝা যাচ্ছে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোর সংজ্ঞা নেই। এগুলো নিয়ে আলাদা মন্ত্রণালয়/সংস্থারও নীতি রয়েছে। নতুন আইনে শাস্তির কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। তিনি আরও বলেন, ‘বিদ্যমান আইনটি কিছুটা পরিবর্তন করে ২০১০ সালে কিছুটা সংশোধন আনা হয়। এবারও সেটা করা যেত। কেন নতুন করে আইন করার প্রয়োজন হলো, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই।
এরশাদুল করিম বলেন, টেলিযোগাযোগ আইনে প্রায় ২৫ বছরের অভিজ্ঞতা হয়েছে সরকারের। সরকার জানে তার চ্যালেঞ্জ কী কী। নতুন আইন করতে গেলে সরকার সেসব চ্যালেঞ্জ উদাহরণ হিসেবে আনতে পারত। কিন্তু এখানে সেসব নেই।