বিমানে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ অনেক আগে থেকেই আলোচিত বিষয়। কিন্তু বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে এসব বন্ধ হচ্ছে না।
টিকিট বিক্রিতে অনিয়ম, উড়োজাহাজ ভাড়ায় দুর্নীতি, নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস, নারী কর্মীদের যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন সময় নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে। তদন্তেও অনিয়ম-অপরাধ প্রমাণিত হয়। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি হয় না।
বিমান-সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, বিমানে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ অনেক আগে থেকেই আলোচিত বিষয়। কিন্তু বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে এসব বন্ধ হচ্ছে না।
সর্বশেষ নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিমান ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। ১০টি পদের বিপরীতে এই নিয়োগ পরীক্ষা ছিল গত বছরের অক্টোবরে। কিন্তু তার আগেই প্রশ্নপত্র (উত্তরসহ) ফাঁস হওয়ায় পরীক্ষাটি বাতিল হয়। পরে বিমানের অভ্যন্তরীণ তদন্তে এসেছে, প্রতিষ্ঠানটির ৩৩ কর্মী কোনো না কোনোভাবে এ ঘটনায় জড়িত।
তাঁদের মধ্যে ২০ জন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন। এই ২০ জনের মধ্যে ৯ জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। বাকি ১১ জনের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি বিমান। এর বাইরে চিহ্নিত বাকি ১৩ জনের মধ্যে ২ জন গ্রেপ্তার হলেও অন্যদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
অপরাধের পরও কারও বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া হলে সেই অপরাধের দায় বিমানের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকেও নিতে হবে।মো. আবদুল মোমেন, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বিমান বাংলাদেশ
দোষ স্বীকার করা কর্মীদের একজন মোটর ট্রান্সপোর্ট বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক মাহবুব আলম শরীফ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর পরিচিত এক প্রার্থীর জন্য ওই সময়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের গাড়িচালকের কাছ থেকে তিনি প্রশ্নপত্র নিয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে মাহবুব আলম শরীফ বলেন, অনেক মানুষ জড়িত, কতজনকে শাস্তি দেবে।
এ ঘটনায় বিমানের মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন ও মানবসম্পদ) মুহাম্মদ নিজাম উদ্দীন আহাম্মেদ ও বিএটিসির অধ্যক্ষ নজমুল হুদার বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ এসেছে। তাঁদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো তাঁদের সাম্প্রতিক সময়ে অনুষ্ঠিত নিয়োগ পরীক্ষার কমিটিতে রাখা হয়েছে, যা নিয়ে মন্ত্রণালয় থেকেও আপত্তি জানানো হয়।
বিমান সূত্রে জানা গেছে, গত ১৮ মে অনুষ্ঠিত পাইলট নিয়োগের মৌখিক পরীক্ষাতেও উপস্থিত ছিলেন নিজাম উদ্দীন আহাম্মেদ। তাঁর নেতৃত্বেই বিমানের ৭৫ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে হজ ফ্লাইটের (পোস্ট হজ) কাজ পরিচালনার জন্য সৌদি আরব পাঠানো হচ্ছে।
মিসর থেকে দুটি উড়োহাজাজ ভাড়া করার ক্ষেত্রে অনিয়ম ও অদক্ষতার কারণে বিমানের প্রায় ১ হাজার ১৬১ কোটি টাকা লোকসান হয়। বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির তদন্তে এ অনিয়ম ও লোকসানের প্রমাণ মিলেছে। এ নিয়ে বহু আলোচনা-সমালোচনা হলেও উড়োজাহাজ দুটি ভাড়া করার ক্ষেত্রে যুক্ত কারও বিরুদ্ধে বিমান কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারিতে এ ঘটনায় বিমানের ২৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
২০২০ সালে টিকিট বিক্রিতে অনিয়ম ও গুরুতর আর্থিক দুর্নীতির দায়ে বিমানের ৪৩ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। এরপর বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব নিয়েই আবু সালেহ মোস্তফা কামাল অনিয়ম ও দুর্নীতির জন্য তাঁদের ভর্ৎসনা করে সবাইকে চাকরিতে পুনর্বহাল করেন। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন আবু সালেহ মোস্তফা কামাল।
গত বছর বিমানের পাইলট নিয়োগে অনিয়ম হয়। এর মধ্যে একজন নারী পাইলট শিক্ষা সনদ জালিয়াতি করে চাকরি পান। এ ক্ষেত্রে তাঁর স্বামীর ভূমিকা ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। যিনি ওই সময় বিমানের প্রশিক্ষণ শাখার প্রধান ছিলেন। এই কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পর নারী পাইলটকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। তবে স্বামীর বিরুদ্ধে কোনো বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কেবল বদলি করা হয়েছে।
এর আগে ২০১৮ সালেও ক্যাডেট পাইলট নিয়োগে অনিয়মের বড় অভিযোগ ছিল। ওই ঘটনায় বিমান কর্তৃপক্ষ অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করলেও পরে দুদক অভিযোগের সত্যতা পায়। এ ঘটনায় গত বছর দুদক চার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছে।
বিমানের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে আসছে এমন সূত্রগুলোর মতে, অনিয়ম-দুর্নীতির উদাহরণ আরও আছে। বিমান কর্তৃপক্ষের সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে, কোনো অভিযোগ উঠলেই সেটা অস্বীকার করা এবং পারলে ধামাচাপা দেওয়া।
তবে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী দাবি করেছেন, বিমানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেলে শাস্তি দেওয়া হয়। তারপরও কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে এবং সে ব্যাপারে বিমান কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা না নিলে বিষয়গুলো নিয়ে তিনি বিমান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলবেন বলে প্রথম আলোকে জানান।
উড়োজাহাজে ধূমপান অপেশাদার আচরণ ও ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু সম্প্রতি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, বিমানের একজন জুনিয়র পার্সার ফ্লাইটের ভেতরে ধূমপান করছেন।
ঘটনা জানাজানি হলে গত ৩০ এপ্রিল এ ব্যাপারে তাঁর ব্যাখ্যা তলব করলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে গত ২১ মে বলাকা ভবনে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিউল আজিম বলেন, ওই পার্সারের হাতে সিগারেট নয়, ই-সিগারেট ছিল।
তবে বিমানের কর্মকর্তারা বলছেন, উড়োজাহাজে ই-সিগারেটও নিষিদ্ধ।
গত ৪ মে বিমানের একজন পাইলটের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষের কাছে হয়রানির লিখিত অভিযোগ করেছেন একজন নারী কেবিন ক্রু। তাতে বলা হয়েছে, ওই পাইলট ফ্লাইটে নারী কেবিন ক্রুদের সঙ্গে আপত্তিকর কথাবার্তাসহ এমন সব আচরণ করেন, যা খুবই অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।
এর আগেও বিভিন্ন সময় নারী সহকর্মীদের যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছিল। এ–জাতীয় ঘটনায় কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিমানের মুখপাত্র, মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) তাহেরা খন্দকার এই প্রতিবেদককে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করার পরামর্শ দেন।
এ ছাড়া বিভিন্ন সময় বিমানকর্মীদের বিরুদ্ধে সোনা চোরাচালানে যুক্ত হওয়া, নির্দিষ্ট এজেন্টদের সুবিধা দিতে টিকিট বুকিংয়ে কারসাজি, বিভিন্ন কেনাকাটাসহ নানা ক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। সরকারি নিরীক্ষায়ও এমন অনেক অনিয়মের তথ্য আসে। কিন্তু সে অনুযায়ী দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনা হয় না।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিমানের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুল মোমেন প্রথম আলোকে বলেন, বিমানের প্রতিটি বিষয় পরিচালনার জন্য ‘স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি)’ আছে। সেটি না মানলে শাস্তি হবে, সেটিও বলা আছে। তাঁর মতে, অপরাধের পরও কারও বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া হলে সেই অপরাধের দায় বিমানের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকেও নিতে হবে।