একটা সময় রাজধানীর ব্যস্ততম জায়গাগুলোতেই দেখা মিলত আকাশচুম্বী ভবনের। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আকাশচুম্বী ভবন নির্মাণ। মতিঝিল, পল্টন, কারওয়ান বাজারের অফিসপাড়া ছেড়ে আকাশচুম্বী ভবন জায়গা করে নিচ্ছে গুলশান, বনানীর মতো জায়গায়। পৃথিবীর অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে আকাশচুম্বী ভবন বেশ কম। উচ্চতা ও সংখ্যা—দুই দিক থেকেই। বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু ভবন রাজধানীর মতিঝিলে অবস্থিত সিটি সেন্টার। ৫৬১ ফুট উঁচু এই ভবন। তবে তাকে টেক্কা দেওয়ার মতো একের পর এক ভবন তৈরি হচ্ছে বর্তমান ঢাকায়।
ট্রপিক্যাল হোমস্ লিমিটেডের হেড অব মার্কেটিং অ্যান্ড ব্র্যান্ড নাজমুল হাসান খান মজলিস বলেন, ঢাকা শহরের বেশির ভাগ আকাশচুম্বী ভবনই বাণিজ্যিক ভবন, যে কারণে আবাসিক ভবনের মতো অবাধ আলো–বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখার তেমন একটা সুযোগ হয় না, বৈদ্যুতিক বাতি ও শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ওপরই নির্ভর করতে হয়। তবে অধিকাংশই কাচের তৈরি হওয়ায় বাইরের তীব্র গরম ভেতরে প্রবেশের চিন্তা থাকে অনেকের। সেটি দূর করতে ব্যবহার করা হয় ডাবল গ্লেজিং গ্লাস। এতে সূর্যের আলো ভেতরে ঢুকলেও তাপ প্রবেশ করতে পারে না।
নাজমুল হাসান খান মজলিস আরও জানালেন তাঁদের চলমান প্রকল্পগুলো সম্পর্কে। বর্তমানে ঢাকায় ট্রপিক্যাল হোমসের পাঁচটি সুউচ্চ ভবন তৈরির কাজ চলমান। ফকিরাপুলে ২২ তলা ট্রপিক্যাল মেট্রো সেন্টার, পুরানা পল্টনে ২৬ তলা ইলেক্ট্রা টাওয়ার ও মালিবাগে ৪৫ তলা টিএ টাওয়ারের কাজ চলছে। এ ছাড়া কারওয়ান বাজারে ট্রপিক্যাল নুর টাওয়ার ও উত্তরাতে ট্রপিক্যাল আহমেদ টাওয়ারের কাজ শেষ হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকার বিভিন্ন প্রাইম লোকেশনে আরও বেশ কিছু সুউচ্চ ভবনের কাজ অতিসত্বর শুরু হবে।
৫০০ ফুট উচ্চতার বেশ কয়েকটি ভবনের নির্মাণকাজ চলছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে শান্তা হোল্ডিংসের পিনাকেল ও ঢাকা টাওয়ার।
শান্তা হোল্ডিংস লিমিটেডের বিপণন বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার রাহি আফতাব বলেন, ‘ঢাকার নতুন কমার্শিয়াল জোন তেজগাঁওয়ে শান্তা হোল্ডিংস এরই মধ্যে কাজ করছে। ২০১১ সালে শান্তা-ওয়েস্টার্ন টাওয়ার নির্মাণের মাধ্যমে এর সূচনা। এরই পাশে ২৫ তলাবিশিষ্ট ফোরাম টুইন টাওয়ার এখন সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। এ ছাড়া ঢাকার প্রথম ৪০ তলা কমার্শিয়াল টাওয়ার পিনাকেলের নির্মাণকাজ শেষের দিকে। হাতিরঝিল ঘিরে গড়ে উঠছে ঢাকার নতুন আইকন—ঢাকা টাওয়ার। ৩৭ তলাবিশিষ্ট এই বিল্ডিং ডিজাইন করেছে নেদারল্যান্ডসভিত্তিক স্থাপত্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ওএমএ।’
এ ছাড়া রয়েছে ট্রপিক্যাল হোমসের টিএ টাওয়ার, সেনাকল্যাণ কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টসের এসকেএস স্কাইরিচ ও মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের এমজিআই টাওয়ার।
আকাশছোঁয়া ভবন যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে চিন্তাও। কারণ, পাশ্চাত্যের দেশগুলোর মতো সুবিশাল কাচঘেরা দালান বাংলাদেশের জন্য ঠিক কতটুকু উপযোগী, তা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় সূর্যের আলো, বাতাস চলাচলের অবাধ ব্যবস্থা থাকা জরুরি। শুধু রাজধানী নয়, রাজধানীর বাইরেও বাড়ছে আকাশছোঁয়া দালানের সংখ্যা। এই চিন্তা দূর করতেই তৈরি করা হয়েছে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড বা বিএনডিসি; যেখানে আকাশচুম্বী ভবন কিংবা হাইরাইজ হিসেবে ধরা হয়েছে ১০ তলা বা এর বেশি তলাবিশিষ্ট দালানকে।
শান্তা হোল্ডিংস লিমিটেডের প্ল্যানিং অ্যান্ড কো–অর্ডিনেশন বিভাগের সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার রফিকুল ইসলাম জানান, ‘বিএনবিসির ২০২০ কোড অনুযায়ী ৩৩ মিটার বা ১১০ ফুটের উঁচু যেকোনো দালানকে হাইরাইজ হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে কোনো ভবন যদি ২০ তলা অর্থাৎ ৬০ (২২০ ফুট) মিটার উচ্চতা ছাড়িয়ে যায়, তবে সেগুলোকে স্পেশাল হাইরাইজ ভবন হিসেবে ধরা হয়।’
এ কারণে নির্মাণ বিধামালা মেনে যেমন নির্মাণকাজ চালানো হয়, তেমনি বাড়তি সতর্কতাও মেনে চলা হয়। ভূমিকম্প কিংবা অগ্নিনির্বাপণের ব্যাপারে মেনে চলা হয় আলাদা সতর্কতা। রফিকুল ইসলাম জানান, ‘এ ধরনের ভবনগুলোর প্রতিটি তলায় হিট ডিটেক্টর, ফায়ার অ্যালার্ম ও অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র থাকা বাধ্যতামূলক। ফায়ারম্যান লিফট এবং অন্তত দুটি আলাদা সিঁড়ি থাকে। এ ছাড়া একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায়, প্রতি ২০ থেকে ২৫ তলায় একটি নিরাপদ রিফিউজি ফ্লোর থাকে, যেখানে অফিস বা আবাসিক ভবনের কার্যক্রম থাকে না। এমনভাবে নকশা করা হয়, যাতে আগুন লাগলে কিংবা ভূমিকম্প হলে সেখান থেকে সহজে উদ্ধার করা সম্ভব হয়। এ ছাড়া অগ্নিনির্বাপণের জন্য আলাদা পানির ট্যাংক থাকে।
তবে বর্তমানে নির্মাণকৌশলের পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব উপকরণের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। পাশ্চাত্যের অনুকরণে সুউচ্চ ভবন নির্মাণের ফলে বাড়ছে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের ব্যবহার। এতে বিদ্যুতের ব্যবহারও বেশি হচ্ছে, বাইরে তাপও ছড়িয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে শহর ও আশপাশের ভবন ও পারিপার্শ্বিকতার বিষয়টি বিবেচনা করা জরুরি। বর্তমানে শহরাঞ্চলে যেভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেভাবে নগরের বিস্তার হচ্ছে না। ফলে আকাশচুম্বী ভবন নির্মাণ ছাড়া আর কোনো উপায়ও খোলা নেই। বিশেষ করে ঢাকার ভেতরে সীমিত ও ব্যয়বহুল জমির সবটুকু ব্যবহার করতে চান সবাই। এ কারণে সবাইকে আকৃষ্ট করতে পারে, এমনভাবেই আকাশচুম্বী ভবন তৈরি করা হচ্ছে। সেখানে জায়গা করে নিচ্ছে অফিস, শপিং মল ও বিলাসবহুল বাসা। নতুন ড্যাপ সংশোধনী অনুযায়ী ভবনের উচ্চতা নিয়ন্ত্রণ, চারপাশে রাস্তার প্রস্থ, খোলা জায়গার বাধ্যবাধকতার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। যথাযথ নিরাপত্তাব্যবস্থা, অবকাঠামোগত সামর্থ্য যাচাই ও নিরাপত্তাব্যবস্থা যাচাই না করে ভবনের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না।