
বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে থাকে পারস্পরিক আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক, দুই দেশের সরকারি কর্মকর্তারা রয়েছেন যার কেন্দ্রে। তবে এই সম্পর্ককে আরও বিস্তৃত রূপ দেয় সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর নাগরিকেরা। শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, বাণিজ্য, দুর্যোগ মোকাবিলা, অর্থনীতি—এ রকম নানা খাতে নানা পর্যায়ে এই সম্পর্ক স্থাপিত হয়, সময়ের পরিক্রমায় যা ক্রমে দৃঢ় হয়, একে অপরের বোধগম্যতায় রাখে কার্যকর ভূমিকা।
পারস্পরিক এই বিনিময়ের ক্ষেত্রে অবশ্য অন্যতম ভূমিকা পালন করে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সংবাদমাধ্যম। প্রতিনিয়ত নানা সংবাদ ও ফিচার প্রকাশের মধ্য দিয়ে বিশ্বের দূরতম রাষ্ট্র সম্পর্কেও নাগরিকদের মধ্যে আগ্রহ গড়ে তোলে সংবাদমাধ্যমগুলো। বিশ্বায়নের যুগে যা এখন অপেক্ষাকৃত সহজও বটে।
সরকারি ঘেরাটোপের বাইরে নাগরিক বিনিময়ের এই বিষয়টি মাথায় রেখেই যেন জাপান সরকার প্রতিবছর বিভিন্ন ক্ষেত্রে অন্যান্য রাষ্ট্রের সম্পর্ক এগিয়ে নিতে অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসেবে নানা পেশায় নিয়োজিত ও শৈল্পিক দক্ষতায় অবদান রাখা লোকজনকে সম্মানিত করে থাকে। যা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সম্মাননা হিসেবে পরিচিত। এই সম্মাননা সনদ জাপানিদের পাশাপাশি বিদেশের কিছু ব্যক্তিত্বকেও প্রতিবছর এই সনদ দেওয়া হয়।
সাংস্কৃতিক ও শৈল্পিক ক্ষেত্রে অবদান রাখা ব্যক্তিদের পাশাপাশি শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ী এবং সমাজসেবার মধ্য দিয়ে বিদেশের সঙ্গে জাপানের সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ায় যাঁরা সাহায্য করছেন, তাঁদের দেওয়া হয় এই সনদ। তবে এ বছর প্রথমবারের মতো জাপান সরকার এখানে দায়িত্বরত বিদেশি সাংবাদিকদের সম্মানিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রথমবারের মতো সেই সম্মাননা পেতে যাচ্ছেন জাপানে প্রথম আলোর ব্যুরো প্রধান মনজুরুল হক। বিশ্বের প্রায় সব কটি প্রধান সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের উপস্থিতি রয়েছে জাপানে। সেখানে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিকের সেই সম্মাননা লাভ করা বাংলাদেশ ও দেশের সংবাদমাধ্যমের জন্যও বিরল এক প্রাপ্তি বলে মনে করা হচ্ছে।
১৯৯৮ সালের নভেম্বর মাসে ‘প্রথম আলো’ প্রকাশিত হওয়ার প্রথম দিন থেকেই মনজুরুল হক পত্রিকার জাপান প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করে আসছেন। সংবাদ সংগ্রহের সূত্রে জাপানের ৪৭টি জেলার সব কটি তিনি ভ্রমণ করেছেন, সাক্ষাৎ করেছেন সম্রাট থেকে শুরু করে দেশের নেতৃস্থানীয় রাজনীতিবিদ, শিল্প, সংস্কৃতি ও চলচ্চিত্রের পরিচিত ব্যক্তিত্ব, হিরোশিমা-নাগাসাকির আণবিক বোমা হামলায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া হিবাকুশা নামে পরিচিত প্রজন্মের লোকজন ছাড়াও একেবারে সাধারণ মানুষজনের সঙ্গে। তাঁদের নিয়ে বিভিন্ন সময়ে পাঠানো তাঁর সংবাদ ও প্রতিবেদন ‘প্রথম আলো’ নিয়মিতভাবে প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া জাপানে বিভিন্ন সময়ে আয়োজিত আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সমাবেশ ও সম্মেলনের পাশাপাশি দেশের ক্রীড়া, সংস্কৃতি ও অন্যান্য অঙ্গনের সংবাদ তিনি পরিবেশন করেছেন বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য।
মনজুরুল হক নেতৃত্ব দিয়েছেন বিদেশি সাংবাদিকদের ক্লাব ফরেন করেসপন্ডেন্টস ক্লাব জাপানেরও (এফসিসিজে)। ২০০৯ সালে তিনি ক্লাবের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং এক বছর মেয়াদি সেই দায়িত্ব সম্মানের সঙ্গে পালন করেন। এ ছাড়া জাপানের নেতৃস্থানীয় দৈনিক মায়ানিচি শিম্বুনে ২০২১ সাল থেকে তিনি লিখেছেন নিজস্ব কলাম। সে রকম বহুমুখী অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বছর তাঁকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সম্মাননা পেতে যাওয়া প্রথম বিদেশি সাংবাদিক হিসেবে বেছে নিয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উল্লেখ করেছে যে জাপান ও বাংলাদেশের মধ্যে পারস্পরিক বোধগম্যতা এগিয়ে নেওয়ায় অবদান রাখার জন্য মনজুরুল হককে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সম্মাননা প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সেপ্টেম্বর মাসের ৫ তারিখে জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিথি ভবন ইকুরা হাউসে আয়োজিত অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইওয়াইয়া তাকেশি এ বছর যাঁরা সম্মানিত হচ্ছেন, তাঁদের হাতে সনদ তুলে দেবেন।
সম্মাননা প্রাপ্তি সম্পর্কে মনজুরুল হক বলেছেন যে এই সম্মাননা হচ্ছে বিশ্বমানের একটি সংবাদপত্র হিসেবে নিজস্ব অস্তিত্ব ঘোষণা করে যাওয়া ‘প্রথম আলো’র জন্য অনন্য এক স্বীকৃতি। অন্য অর্থে এই প্রাপ্তি হচ্ছে প্রথম আলোতে কর্মরত সংবাদকর্মী ও অন্যদের। আর ব্যক্তিগতভাবে এটা তাঁকে বাংলাদেশের লোকজনের সামনে জাপানকে বস্তুনিষ্ঠভাবে তুলে ধরা অব্যাহত রাখতে অনুপ্রাণিত করবে।
তবে মনজুরুল হকের এই অর্জন বাংলাদেশের সংবাদকর্মীদের জন্যও অনুপ্রেরণাদায়ক হবে বলে ধরে নেওয়া যায়, যাঁরা নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও দেশ-বিদেশের বস্তুনিষ্ঠ খবর পরিবেশনে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন। নিশ্চয়ই জাপানের মাধ্যমে পাওয়া আমাদের সাংবাদিকতার এই বৈশ্বিক স্বীকৃতি বেগবান করবে তাঁদের সেই গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টাকে।