স্বয়ংক্রিয় সড়কবাতি, আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ, সোলার সিস্টেম—সব মিলিয়ে একটি স্মার্ট সিটি গড়ে তুলতে চায় আরাফাত বিন আজম। চট্টগ্রামের নেভি অ্যাঙ্কোরেজ স্কুল অ্যান্ড কলেজের ষষ্ঠ শ্রেণির এই খুদে শিক্ষার্থী ছোট থেকেই বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী। বিজ্ঞান উৎসবে অংশগ্রহণের জন্য নিজেই শিক্ষকের কাছে গিয়ে নিজের পরিকল্পনা জানায়। পরিবারের পাশাপাশি স্কুলও তাকে সমর্থন দিয়েছে। এরপর নিজের শিক্ষকের সঙ্গেই সে বিকাশ-বিজ্ঞানচিন্তা বিজ্ঞান উৎসবের জাতীয় পর্বে অংশ নেয়।
আজ শুক্রবার তৃতীয়বারের মতো আয়োজিত হলো বিকাশ-বিজ্ঞানচিন্তা বিজ্ঞান উৎসবের জাতীয় পর্ব। রাজধানীর সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে দিনব্যাপী চলে এ উৎসব।
চট্টগ্রাম থেকে আরাফাতকে ঢাকার উৎসবে নিয়ে এসেছেন তার স্কুলের শিক্ষক তৌহিদুজ্জামান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর স্কুল থেকে এ ধরনের আয়োজনে শিক্ষার্থীদের অংশ নিতে উৎসাহিত করা হয়। এসব উৎসব শিক্ষার্থীদের চোখ ও মন খুলে দেয়। সবাই বিজয়ী হবে না ঠিকই; কিন্তু তাদের যে প্রচেষ্টা, এটাই অনেক।
বিজ্ঞান উৎসবকে শুভকামনা জানিয়ে সকালে অনুষ্ঠান উদ্বোধন করে রোবট নাও। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীতের সঙ্গে পতাকা উত্তোলন ও বেলুন উড়িয়ে আয়োজনের সূচনা করেন সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের অধ্যক্ষ ব্রাদার লিও জেমস পেরেরা, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লাফিফা জামাল, বিকাশ লিমিটেডের ইভিপি এবং রেগুলেটরি অ্যান্ড করপোরেট অ্যাফেয়ার্স ডিপার্টমেন্টের প্রধান হুমায়ুন কবির, অ্যাসোসিয়েশন ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ফারজানা আলম, কথাসাহিত্যিক ও প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হক এবং বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।
বিজ্ঞান উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ ছিল প্রজেক্ট প্রদর্শনী। খুদে বিজ্ঞানীরা হাজির হয় নিজেদের উদ্ভাবন নিয়ে। বিশ্বে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) যে জোয়ার চলছে, তার কিছু নমুনা দেখা গেল এবারের বিজ্ঞান উৎসবে।
বরিশালের ব্রজমোহন বিদ্যালয় থেকে এআই চ্যাটবট বানিয়ে নিয়ে এসেছে এস এম সাইফান শাফি। আবার খুলনার নেভি অ্যাঙ্কোরেজ স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে তিন শিক্ষার্থী এনেছে এআইভিত্তিক ট্রাফিক সিস্টেম। দুটি প্রকল্পই শেষে পুরস্কার পেয়েছে।
অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, বিজ্ঞানমনস্ক হওয়া বেশি জরুরি। এ দেশে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয় বিদেশি পরামর্শকদের পেছনে। তাই এ দেশের মেধাকে এ জায়গা ধরতে হবে। চিন্তা করতে হবে, সমস্যা সমাধান করতে হবে, প্রোগ্রামিং করতে হবে।
বিকাশ লিমিটেডের কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির বলেন, এ দেশের মানুষের মেধা আছে, বুদ্ধি আছে, যা কাজে লাগাতে হবে।
কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক বলেন, বিজ্ঞান জানতে হবে, বিজ্ঞানমনস্ক হতে হবে। ভালো ছাত্র হতে হলে প্রচুর পড়তে হবে, নানা সামাজিক কাজে যুক্ত থাকতে হবে।
বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম বলেন, কিশোর–তরুণদের এআইয়ের মতো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নতুন বিষয়গুলোর প্রতি আগ্রহী করে গড়ে তুলতে হবে। চিন্তাশক্তির বিকাশ ঘটানোই এই উৎসবের উদ্দেশ্য।
উৎসবের একটি অংশ ছিল মজার বিজ্ঞান বক্তৃতা: সায়েন্স আনপ্লাগড। এতে ‘রোবটরা কি পৃথিবী দখল করে নেবে’—এ বিষয়ে আলোচনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবোটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক লাফিফা জামাল। তিনি বলেন, ‘রোবট কি মানুষের জায়গা দখল করে নেবে? মোটেও না। রোবট তার অনুকূল পরিবেশ না পেলে কিছু করতে পারে না; কিন্তু মানুষ তা পারে। তাই নিজের বুদ্ধিকে শাণ দিতে হবে।’
এ পর্বে ‘রিলেটিভিটি এবং আইনস্টাইনের মহাবিশ্ব’ নিয়ে সহজ ভাষায় আলোচনা করেন ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের ফিজিক্যাল সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক আরশাদ মোমেন; ‘জিন এবং ডিএনএ—যে ভাষায় লেখা আমাদের গল্প’ নিয়ে আলোচনা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক আদনান মান্নান; বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) তড়িৎকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ফারসীম মান্নান মোহাম্মদীর আলোচনার বিষয় ছিল ‘এলিয়েন কি সত্যিই আছে’; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরিচালক বি এম মইনুল হোসেন এআই নিয়ে আলোচনা করেন; কসমিক ক্যালেন্ডার নিয়ে কথা বলেন বিজ্ঞান বক্তা আসিফ। এ ছাড়া কার্টুন ও কমিকস নিয়ে কার্টুনিস্ট নাসরিন সুলতানা মিতুর আলোচনার নাম ছিল ‘কালিতুলিতে গল্পবিজ্ঞান’। কিছু আলোচনার পর শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করার সুযোগ ছিল। এ সময় মজার সব প্রশ্ন করে তারা, উত্তর দেন বক্তারা।
জাতীয় বিজ্ঞান উৎসবে ৭০টির বেশি স্কুলের আঞ্চলিক পর্বের বিজয়ী ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা অংশ নেয় প্রজেক্ট প্রদর্শনী ও বিজ্ঞান কুইজ প্রতিযোগিতায়। এ ছাড়া ছিল রুবিকস কিউব ও সুডোকু প্রতিযোগিতা। শিক্ষার্থীরা উপভোগ করে রোবট শো। উৎসবটি সঞ্চালনা করেন সাইমুম মৌসুমী বৃষ্টি।
অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করেন দ্য রকস্টার শুভ এবং গায়ক জাহিদ অন্তু। ম্যাজিক দেখান রাজীব বসাক। অভিনয়শিল্পী সাফা কবির এসে শিক্ষার্থীদের উৎসাহ জোগান।
বিজ্ঞান উৎসবের জাতীয় পর্বে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অনেক অভিভাবকও এসেছেন। খুলনা থেকে মেয়েকে নিয়ে এসেছেন ডায়না খাতুন। আঞ্চলিক পর্বে বিজয়ী হয়ে মেয়ে জাতীয় পর্বে সুযোগ পেয়েছে, তাই নিজেই নিয়ে এসেছেন। তিনি জানান, ষষ্ঠ শ্রেণিপড়ুয়া মেয়ে জিয়ানা নিশাত সুলতানার বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার আগ্রহ অনেক। তাই মেয়েকে তিনি সব সময়ই উৎসাহ দেন।
পুরস্কার বিতরণীতে উপস্থিত ছিলেন আহ্ছানউল্লা ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির উপাচার্য অধ্যাপক মো. আশরাফুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুগত আহমেদ এবং চিকিৎসক ও লেখক তানজিনা হোসেন। অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বায়োলজির অলিম্পিয়াড দলের কোচ সৌমিত্র চক্রবর্তী ও গীতিকার কবির বকুল।
জাতীয় পর্বে প্রজেক্টে সেরাদের সেরা হয়েছে বিএএফ শাহীন কলেজের আরীব বিন ফারুক ও সাইম ইবনে সারওয়ার; দ্বিতীয় হয়েছে বরিশালের ব্রজমোহন স্কুলের এস এম সাইফান শাফি এবং তৃতীয় হয়েছে সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের রায়িন আর রাদ। এতে মোট ১৫টি প্রজেক্টে ৩১ জনকে পুরস্কৃত করা হয়েছে।
কুইজ প্রতিযোগিতায় মাধ্যমিক ক্যাটাগরিতে প্রথম হয়েছে রংপুর জিলা স্কুলের মো. ফাহিম ফয়সাল; দ্বিতীয় চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের রাজর্ষি দাশ গুপ্ত এবং তৃতীয় হয়েছে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড সরকারি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের মো. রিফাত সময়।
নিম্নমাধ্যমিক ক্যাটাগরিতে প্রথম হয়েছে সাভারের পারমাণবিক শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইরাম মাহমুদ রুহান; দ্বিতীয় হয়েছে নাচোল উপজেলা স্কুলের তাহমিদ উল ইসলাম এবং তৃতীয় হয়েছে বরিশাল জিলা স্কুলের দিলশান হোসেন। কুইজে প্রতি বিভাগে ১৫ জনকে পুরস্কৃত করা হয়েছে।
এ ছাড়া বিশেষ কুইজে প্রথম হয়েছে চ্যাম্পিয়ন একাডেমির তানভির হোসেন; দ্বিতীয় সিভিল এভিয়েশন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আহমেদ মুস্তাকিম খান এবং তৃতীয় হয়েছে বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের মৌনি জামান রুকান। এ বিভাগে ১৪ জনকে পুরস্কার দেওয়া হয়। এ ছাড়া রুবিকস কিউবে তিনজন এবং সুডোকুতে তিনজনকে পুরস্কৃত করা হয়েছে।
বিজ্ঞান প্রজেক্টে প্রথম তিনটি গ্রুপকে বিকাশের সৌজন্যে ল্যাপটপ এবং কুইজের দুই বিভাগের সেরাদের সেরাকে বিকাশের সৌজন্যে বিশেষ পুরস্কার এবং বিজ্ঞানচিন্তার সৌজন্যে ট্যাব পুরস্কার দেওয়া হয়। এ ছাড়া বই, বিজ্ঞানবাক্স, সার্টিফিকেট, মেডেল, ট্রফিসহ ছিল অনেক পুরস্কার।
এ উৎসবের স্ন্যাকস পার্টনার ছিল ড্যান কেক, আইসক্রিম পার্টনার ছিল পোলার এবং হেলথ পার্টনার ছিল ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ। এ ছাড়া সহযোগিতায় ছিল অন্যরকম বিজ্ঞানবাক্স, অনুপম প্রকাশনী, জ্ঞানকোষ, গুফি এবং ঢাকা কমিক্স।