বিগত আওয়ামী লীগের শাসনামলে শেখ হাসিনা সশস্ত্র বাহিনীর অনেক কর্মকর্তাকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করেছেন। পুলিশ, র্যাব ও ডিজিএফআইকে ব্যবহার করে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি এবং ভিন্নমত দমন করেছেন, জনগণের ভোটাধিকার ছিনিয়ে নিয়েছেন, ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছেন। এখন ফ্যাসিবাদের উত্থান রুখে দেওয়ার পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করাও জরুরি।
আজ শনিবার রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন (রাওয়া) কমপ্লেক্সের হেলমেট হলে আয়োজিত ‘রাষ্ট্র সংস্কার: রাজনীতি প্রভাবমুক্ত সশস্ত্র বাহিনী’ শীর্ষক সেমিনারে আলোচকেরা এ কথাগুলো বলেছেন।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। তিনি বলেন, দেশ থেকে ফ্যাসিবাদ চিরতরে বিদায় করতে হলে দুই জায়গায় সংস্কার করতে হবে। একটি হলো সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ সংস্কার; অন্যটি রাষ্ট্র সংস্কার। যদি রাষ্ট্র সংস্কার না হয়, তাহলে সেনাবাহিনী না চাইলেও রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ থাকবে, রাজনীতিবিদেরা সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করবেন।
মাহমুদুর রহমান মূল প্রবন্ধে রাষ্ট্র সংস্কার ভাবনা তুলে ধরতে গিয়ে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের আদলে রাষ্ট্রপতিশাসিত শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের কথা বলেন। তিনি বলেন, জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে সর্বোচ্চ দুবার পাঁচ বছর মেয়াদের জন্য একজন নাগরিক রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হতে পারবেন। এই দুই মেয়াদ উপর্যুপরি হওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এই পদ্ধতিতে নির্বাচিত সংসদের সঙ্গে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার যথেষ্ট ভারসাম্য থাকতে হবে। এ ব্যবস্থায় একজন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব, জিয়াউর রহমান কিংবা এরশাদের মতো একক ক্ষমতাশালী হবেন না। রাষ্ট্রপতির দুই মেয়াদের বেশি ক্ষমতাসীন থাকার সুযোগ যদি সংবিধানে রহিত করা থাকে এবং রাষ্ট্রপতি ও সংসদের মধ্যে যদি ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করা যায়, তাহলে ফ্যাসিবাদের উত্থানের সুযোগ বন্ধ করা সম্ভব হবে।
প্রবন্ধে মাহমুদুর রহমান নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সংবিধানে পুনঃসংযোজন, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নিয়োগ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনে অভিযুক্ত সামরিক কর্মকর্তাদের বিচারের কথা বলেছেন।
সেমিনারে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুল্লাহ আল ইউসুফ ‘রাষ্ট্র সংস্কার: রাজনীতি প্রভাবমুক্ত সশস্ত্র বাহিনী’ শিরোনামে আরও একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তিনিও রাষ্ট্র সংস্কার ভাবনায় জনগণের সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচনের কথা বলেছেন।
প্রবন্ধের ওপর আলোচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক এ এস এম আলী আশরাফ বলেন, ‘সমালোচকের দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে চাই, প্রেসিডেনশিয়াল সিস্টেম যে কাজ করবে, সেটা কীভাবে জানি। আপনারা কোনো গ্লোবাল মডেল অ্যাপ্লিকেশন (বৈশ্বিক মডেলের প্রয়োগ) করতে চান? অমুক দেশে, অমুক জায়গায় এটি কাজ করেছে। এমন রেফারেন্স দেখি নাই। এটা হাইপোথিসিস (অনুমান) পর্যায়ে আছে। অন্যদিকে পার্লামেন্টারি সিস্টেম (সংসদীয় ব্যবস্থা) কাজ করে না, আমরা কীভাবে জানি? পার্লামেন্টারি স্ট্যান্ডিং কমিটির ভালো অ্যাকটিভিটি (কার্যক্রম) দেখিনি, ইনস্টিটিউশনাল স্ট্রাকচার ডেভেলপ না হলে কীভাবে ধরে নেব পার্লামেন্টারি সিস্টেম কাজ করে না?’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের শিক্ষক নইম সুলতান বলেন, ‘আমরা চিৎকার করছি সংস্কার, সংস্কার বলে। আমার সামনে কী মডেল আছে যে এই সংস্কার করলে আমার দেশে আর ফ্যাসিজমের উত্থান ঘটবে না। আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমন কোনো মডেল খুঁজে পাইনি। ফ্যাসিজমের উত্থান কোনো সংস্কার করে বন্ধ করা যায় না।’
দুটি প্রবন্ধের ওপর আরও আলোচনা করেছেন রিয়াল অ্যাডমিরাল (অব.) মুস্তাফিজুর রহমান। তাঁর মতে, দেশে দ্রুত বিচারব্যবস্থার সংস্কার করা উচিত। সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য দেন কর্নেল (অব.) আবদুল হক। তিনি বলেন, সেমিনারের উদ্দেশ্য হচ্ছে সশস্ত্র বাহিনী ও রাষ্ট্রের কী কী পরিবর্তন প্রয়োজন, সেটি খুঁজে বের করা।
সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ। তিনি বলেন, ‘সমাজের প্রবলেমটা কোথায়—শুধু সংস্কারে না। এখানে কোনো জবাবদিহি নেই। পয়সা থাকলে, ইউ কেন বাই অ্যানিথিং। যেমন বড় বড় ব্যবসায়ী যারা বলছিল, এখনো আছি, ভবিষ্যতেও থাকব। তাদের কি বিচার হচ্ছে? বিচার হচ্ছে না। কারণ, তারা হাজার কোটি টাকা আমাকে দিছে, আপনাকে দিছে।’
বিগত সরকারের সময়ে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের বিতর্কিত ভূমিকা নিয়ে কথা বলেন অলি আহমদ। তিনি বলেন, ডিজিএফআই এবং এনএসআইয়ের দায়িত্ব নির্ধারণ করতে হবে। কার দায়িত্ব কী, সেটা ঠিক করতে হবে। ডিজিএফআইয়ের মূল দায়িত্ব হলো, ‘লুক আফটার আর্মড ফোর্সেস, নট পলিটিকস, নট সিভিলিয়ানস।’ সিভিলিয়ানদের জন্য কাজ করবে এনএসআই। এগুলো নির্ধারণ করতে হবে।