বেঙ্গল ডেলটা কনফারেন্সে প্যানেল আলোচনায় (বাঁ থেকে) তাকবির হুদা, সারা হোসেন, আইরিন খান, হুমা খান ও মোহাম্মদ তাইজুল ইসলাম। গতকাল রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে
বেঙ্গল ডেলটা কনফারেন্সে প্যানেল আলোচনায় (বাঁ থেকে) তাকবির হুদা, সারা হোসেন, আইরিন খান, হুমা খান ও মোহাম্মদ তাইজুল ইসলাম। গতকাল রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে

বেঙ্গল ডেলটা কনফারেন্স

জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে জোর দিতে হবে

নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। অন্য গোষ্ঠী এসে ঝুঁকি তৈরি করছে। এখন আর জানা যায় না যে কে নজরদারি করছে, কে আঘাত করবে আর কে থামাবে। রাজনৈতিক পালাবদলের এই সময়ে মানুষের কাছে ন্যায়বিচার ও জবাবদিহি ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে সত্য উদ্ঘাটন, বিচার, ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ওপর জোর দিতে হবে।

গতকাল শনিবার ‘বেঙ্গল ডেলটা কনফারেন্স ২০২৫’–এর সমাপনী দিনে এক প্যানেল আলোচনায় বক্তারা এ কথা বলেন। তাঁরা আরও বলেন, জুলাই হত্যার মতো সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। আগামী নির্বাচনে যে সরকারই আসুক, বিচারপ্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।

একনায়কতান্ত্রিক শাসনের নীতি হলো গণমাধ্যমকে আক্রমণ করা। বাংলাদেশেও আমি এটা বহু বছর ধরে দেখেছি।
আইরিন খান, মুক্তচিন্তা বিষয়ক বিশেষ র‍্যাপোর্টিয়ার, জাতিসংঘ

দুই দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক এই সম্মেলন গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে শেষ হয়। গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইটিকস (দায়রা) এই সম্মেলনের আয়োজন করে। সম্মেলনের প্রতিপাদ্য ছিল, ‘বাংলাদেশ অ্যাট ক্রস রোডস: রিথিঙ্কিং পলিটিকস, ইকোনমিকস, জিওপলিটিক্যাল স্ট্র্যাটেজি’ (সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশ: রাজনীতি, অর্থনীতি ও ভূরাজনৈতিক কৌশল নিয়ে নতুন ভাবনা)। শেষ দিনে পাঁচটি প্যানেল আলোচনা, পাঁচটি একাডেমিক আলোচনা ও তিনটি বিশেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।

গতকাল বেলা তিনটার দিকে ‘অথরিটারিয়ানিজম, অ্যাট্রোসিটি অ্যান্ড অ্যাকাউন্টেবিলিটি: হিউম্যান রাইটস অ্যাবিউজেস অ্যান্ড ট্রানজিশনাল জাস্টিস ইন বাংলাদেশ’ (বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদ, নৃশংসতা ও জবাবদিহি: মানবাধিকার লঙ্ঘন ও পরিবর্তনের সময়ের ন্যায়বিচার) শীর্ষক প্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।

শীর্ষ অভিযুক্তদের বিচার হতে পারে নির্বাচনের আগেই

আলোচনায় অংশ নিয়ে জুলাই হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। চব্বিশের জুলাইয়ে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় ৮–১০টি মামলার বিচার আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগেই নিষ্পত্তি হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

তাজুল ইসলাম বলেন, শীর্ষ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের ব্যবস্থা করা হতে পারে নির্বাচনের আগেই। নির্বাচনের পর যে সরকারই আসুক, তাদের অঙ্গীকার থাকতে হবে যে বিচারপ্রক্রিয়া বন্ধ হবে না। তা না করা হলে জুলাইয়ে যাঁরা রক্ত দিয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে প্রতারণা করা হবে। তিনি বলেন, জুলাইয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় বেশির ভাগ অভিযুক্ত পুলিশ বাহিনীর সদস্য। শুরুতে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে পুলিশদের দিয়ে তদন্ত করানো, গ্রেপ্তার করা কঠিন ছিল। পুলিশ পুনর্গঠনের মাধ্যমে কাজটি করতে হচ্ছে। ২২৭ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। গ্রেপ্তারের সংখ্যা ৮০ জনের বেশি নয়।

প্রধান প্রসিকিউটর বলেন, ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার–এনটিএমসি (টেলিযোগাযোগ নজরদারির জাতীয় সংস্থা) থেকে এখনো তথ্যসহায়তা পাওয়া যাচ্ছে না। মারণাস্ত্র ব্যবহার করতে, হেলিকপ্টার ব্যবহার করতে কারা নির্দেশ দিয়েছিল, সেই কল রেকর্ড এনটিএমসিতে সংরক্ষিত থাকার কথা। সেসব অনেক তথ্য ডিলিট (মুছে ফেলা) করে ফেলা হয়েছে।

সেই একই কাঠামো আছে

এই আলোচনায় অংশ নেন জাতিসংঘের মুক্তচিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিকাশ ও সুরক্ষাবিষয়ক বিশেষ র‍্যাপোর্টিয়ার আইরিন খান। তিনি বলেন, ‘একনায়কতান্ত্রিক শাসনের নীতি হলো গণমাধ্যমকে আক্রমণ করা। বাংলাদেশেও আমি এটা বহু বছর ধরে দেখেছি।’ তিনি বলেন, আগের সরকার একটিমাত্র বয়ানের দিকে ধাবিত হয়েছে। একক বয়ান গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পরিপন্থী। গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন কিছু সুপারিশ করেছে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে। তা কার্যকর হবে কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

এ প্রসঙ্গে আইরিন খান আরও বলেন, ‘এখনো আমাদের কাছে সেই একই কাঠামো আছে, যা ব্যবহার করে মানুষকে আটকানো হয়, গুম করা হয়, নজরদারিতে রাখা হয়। নজরদারির যন্ত্রপাতি—সবই এখনো বিদ্যমান। বর্তমান সরকারও সেটা জানে।’ তিনি বলেন, প্রশ্ন হলো এখন এগুলো কে ব্যবহার করছে, কার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে?

আইরিন খানের মতে, এই অনিশ্চয়তাই ‘ভীতিকর প্রভাব’ তৈরি করছে। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর আগের সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিল, এমন অনেক সাংবাদিককে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এর একটি ভীতিকর প্রভাব পড়েছে। অনেক সাংবাদিক লিখতে গিয়ে ভাবছেন, তাঁর কিছু হবে কি না।

মতপ্রকাশে পরিস্থিতি বদলেছে কি না, এমন এক প্রশ্নের জবাবে আইরিন খান বলেন, ‘রাষ্ট্রের দায়িত্ব আমাদের রক্ষা করা। সেটা হচ্ছে না। অন্য গোষ্ঠী এসে ঝুঁকি তৈরি করছে। আগে অন্তত জানা ছিল, ডিজিএফআইকে ভয় পেতে হবে...এখন আর জানা যায় না কে নজরদারি করছে, কে থামাবে, কে আঘাত করবে।’

মানবাধিকার লঙ্ঘন যেন বারবার না ঘটে

ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে জবাবদিহি নিশ্চিত করার কথা বলেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন। তিনি বলেন, দায়বদ্ধতা মানে শুধু ফৌজদারি দায়বদ্ধতা নয়। এর মধ্যে সত্যও আছে, এর মধ্যে প্রতিকার, ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের বিষয়ও আছে। তিনি আরও বলেন, জুলাই হত্যাকাণ্ড, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্বিচার গ্রেপ্তার, আটক, নির্যাতন, নারী ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, প্রতিবাদকারীর ওপর যৌন সহিংসতার মতো একই ধরনের সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন যেন বারবার না ঘটে।

সারা হোসেনের মতে, মানবাধিকার কমিশন একেবারেই অকার্যকর হয়ে আছে। আগের সময়ে এটি মানবাধিকার লঙ্ঘন মোকাবিলায় কার্যকর ভূমিকা রাখেনি। আজও নেই। জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে জোর দিতে হবে।

টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ ফেলো তাকবির হুদা বলেন, ‘ক্ষতিপূরণের প্রসঙ্গে বলব, ক্ষতিপূরণ মানে শুধু টাকা নয়, সত্য জানার অধিকারও এর মধ্যে পড়ে। এখন পর্যন্ত যাদের হত্যা করা হয়েছে, সেই তালিকায় শুধু তাদের নাম আছে, যাদের লাশ উদ্ধার হয়েছে। আমি স্মরণ করাতে চাই মোহাম্মদ রিদয়কে—একজন ২০ বছরের যুবক, যাকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গাজীপুরে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। তার পরিবার কোনো সুবিধা পাচ্ছে না জুলাই যোদ্ধার পরিবার হিসেবে। কারণ, তার লাশ পাওয়া যায়নি।’

আলোচনার সঞ্চালক ছিলেন বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ মানবাধিকারবিষয়ক উপদেষ্টা হুমা খান। বিভিন্ন সময়ে গুম হওয়া ব্যক্তিদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখনো পরিবারগুলো অপেক্ষা করছে গুম হওয়া স্বজনের জন্য। অসংখ্য বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনও ঘটেছে। মানুষ জানতে চায় কী ঘটেছিল।

জুলাই গণ–অভ্যুত্থান নিয়ে জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদনের প্রসঙ্গ তুলে ধরে হুমা খান বলেন, সেই সময়ের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী সরাসরি পরিকল্পনা করেছিল, নির্দেশ দিয়েছিল এবং ওই হত্যাযজ্ঞ কার্যকর করেছিল। তাঁর মতে, পুলিশ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক সংস্কৃতি পর্যন্ত সংস্কার করতে হবে। পাশাপাশি প্রচলিত বয়ানগুলোও সংশোধন করতে হবে এবং যথেষ্ট ভারসাম্য নিশ্চিত করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে অতীতের মতো পরিস্থিতি আবার না ঘটে।