গোলটেবিল বৈঠকে (বাঁ থেকে) সৈয়দা সেলিনা আজিজ, আসিফ মোহাম্মদ শাহান, মাহীন সুলতান, শাহীন আনাম, তোফায়েল আহমেদ, সৈয়দ হাসিবউদ্দীন হোসেন, ইলিরা দেওয়ান ও নুরুল হুদা সাকিব। গতকাল ঢাকায় প্রথম আলো কার্যালয়ে
গোলটেবিল বৈঠকে (বাঁ থেকে) সৈয়দা সেলিনা আজিজ, আসিফ মোহাম্মদ শাহান, মাহীন সুলতান, শাহীন আনাম, তোফায়েল আহমেদ, সৈয়দ হাসিবউদ্দীন হোসেন, ইলিরা দেওয়ান ও নুরুল হুদা সাকিব। গতকাল ঢাকায় প্রথম আলো কার্যালয়ে

গোলটেবিল বৈঠক

জনমুখী স্থানীয় শাসনব্যবস্থা জরুরি

স্থানীয় শাসনব্যবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচন, বাজেটে স্বচ্ছতা ও নারীর অংশগ্রহণ থেকে শুরু করে সর্বোপরি নাগরিক সম্পৃক্ততা বাড়াতে হলে মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি। সরকারকে চাইতে হবে, সত্যিকারের জনমুখী স্থানীয় শাসনব্যবস্থার প্রয়োজন আছে। এতে জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহির জায়গা তৈরি হবে, নাগরিকেরাও নিজেদের মতামত জানাতে পারবে।

গতকাল রোববার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘স্থানীয় শাসনব্যবস্থায় নাগরিক কোথায়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এ কথা উঠে আসে। প্রথম আলো ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) উদ্যোগে এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়।

এতে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান তোফায়েল আহমেদ বলেন, স্থানীয় সরকারে একমাত্র সমস্যা নাগরিক সম্পৃক্ততা নয়, মূল সমস্যা সত্যিকারের নির্বাচন না হওয়া। একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বাকি জিনিসগুলোও কাজ করে।

তোফায়েল আহমেদ বলেন, স্থানীয় সরকারে যেসব সভা হয়, সেগুলো উন্মুক্ত করা হোক, যাতে যে কেউ তাতে অংশ নিতে পারে। বাংলাদেশের ব্যবস্থায় চেয়ারম্যান, মেয়রদের কাছে পৌঁছানো কঠিন। এ জন্য যিনি ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্বাচিত হন, তাঁর দায়বদ্ধতার জায়গা শক্তিশালী করতে হবে; যেন নাগরিক যেকোনো প্রয়োজনে তাঁর কাছেই যেতে পারে।

এই স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ বলেন, স্থানীয় শাসনব্যবস্থা মানেই স্থানীয় সরকার নয়। এর সঙ্গে স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা, ব্যবসা, নাগরিক সমাজ মিলেই এই শাসনব্যবস্থা। সরকারের চেয়ে কিন্তু বেশি কাজ করে বেসরকারি খাত। কিন্তু এই খাতের কোনো স্বীকৃতি নেই, এ নিয়ে কোনো নীতি নেই। ফলে নাগরিকেরা ভুগছে। আর বিকেন্দ্রীকরণ মানেই স্থানীয় সরকারের বিকেন্দ্রীকরণ নয়, পুরো ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ।

স্থানীয় সরকারে যত বাজেট আছে, তা শুধু নামমাত্র কাগজ উল্লেখ করে তোফায়েল আহমেদ বলেন, তারা জানেও না কত টাকা তারা পাবে। এ ছাড়া এ বাজেটে পুরো টাকাও স্থানীয় সরকারের এই প্রতিষ্ঠানগুলো পায় না। কিছু টাকা সরিয়ে রেখে বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়ান কর্মকর্তারা। তা জায়েজ করার জন্য জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে যান। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের যুক্ত করে এ বাজেটও স্থানীয় পর্যায় থেকে হতে হবে।

বৈঠকে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের ওপর বিআইজিডির পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন সংস্থাটির ফেলো অব প্র্যাকটিস এবং গভর্ন্যান্স অ্যান্ড পলিটিকস ক্লাস্টারের প্রধান সৈয়দা সেলিনা আজিজ। তিনি বলেন, কমিশনের প্রতিবেদনে জনপ্রতিনিধিদের শক্তিশালী ভূমিকা, আর্থিকভাবে শক্তিশালী করা এবং নারীর কার্যকর অংশগ্রহণের বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে। তবে নাগরিককেন্দ্রিক কথা কম। ওয়ার্ড সভার মতো বিষয়, নাগরিক আরও কীভাবে স্থানীয় শাসনব্যবস্থায় যুক্ত হবে, তা সুনির্দিষ্ট করে উল্লেখ নেই।

বৈঠকে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের (এমজেএফ) নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, দেশ শাসনে প্রান্তিক গোষ্ঠীর দরকার আছে কি না, সে বিশ্বাস আনতে হবে। কোনো সরকার এখন পর্যন্ত বিকেন্দ্রীকরণের প্রতিশ্রুতি দেয়নি বা আগ্রহ দেখায়নি। প্রচুর সুপারিশ আসে। নাগরিকদের সম্পৃক্ততা বাড়াতে এসব সুপারিশ মানা হলে এবং বাস্তবায়িত হলে কিছুটা সম্পৃক্ততা নিশ্চিত হতো।

এমজেএফের নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, নির্বাচনে জনগণকে ভোটের মেশিনের মতো ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এই নির্বাচনে জনগণ যে জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহি করবে, এমন কোনো প্ল্যাটফর্ম নেই। কারণ, পুরো ব্যবস্থা অনেক বেশি কেন্দ্রীভূত। ওপর থেকে নির্দেশ না এলে কাজ হয় না। তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার কমিশন তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, কিন্তু সেটা নিয়ে কোনো আলোচনা নেই।

ভালো স্থানীয় শাসনব্যবস্থা থাকলে নারীর অংশগ্রহণের সুযোগ বাড়ে উল্লেখ করে বিআইজিডির সিনিয়র ফেলো অব প্র্যাকটিস মাহীন সুলতান বলেন, এসব প্রক্রিয়ায় যদি নারীর নিরাপত্তা, মর্যাদা এবং মতামত জানানোর নিশ্চয়তা দেওয়া হয়, তবে নারীরা আরও যুক্ত হবেন। তিনি বলেন, নির্বাচনে প্রতিটি ওয়ার্ডে একজন পুরুষ ও একজন নারী প্রতিনিধি থাকতে পারেন, যাঁদের দায়িত্বও ভাগ করে দেওয়া হবে এবং যাঁরা সরাসরি নির্বাচনে লড়বেন।

দেশের অন্য সব স্থানীয় সরকারব্যবস্থার সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলার মিল নেই বলে জানান মানবাধিকারকর্মী ও স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের সদস্য ইলিরা দেওয়ান। তিনি বলেন, সেখানে একাধিক সংস্থা এবং তিন জেলার জন্য ভিন্ন ভিন্ন আইন। জেলা পরিষদে ৩০ বছর ধরে কোনো নির্বাচন হয়নি। যে সরকার আসে, তার লোক বসানো হয়।

এ কারণে সেখানে জনগণের সম্পৃক্ততার সুযোগ নেই মন্তব্য করে ইলিরা দেওয়ান বলেন, নির্বাচিত না হলে দায়বদ্ধতার জায়গা থাকে না। সেখানে নির্বাচনপ্রক্রিয়াও জটিল। তবে কমিশনের প্রস্তাব জমা দেওয়া হয়েছে। সরকার যদি আন্তরিক থাকে, জটিলতা থাকে না।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক নুরুল হুদা সাকিব বলেন, শাসনব্যবস্থায় যুক্ত হতে হলে শিক্ষাব্যবস্থা ও মানসিকতার পরিবর্তন লাগবে। মানুষকে সচেতন না করে পদ্ধতির পরিবর্তন করা হলে তা কাজে আসবে না। এটা ধাপে ধাপে করতে হবে।

রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের নেতা সৈয়দ হাসিব উদ্দিন হোসেন জেলায় জেলায় সরকার গঠনের কথা বলেন। তিনি বলেন, এতে মানুষের ক্ষমতায়ন সম্ভব। জেলাগুলোকে কেন্দ্রের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না। মানুষের ঢাকামুখী হওয়ার প্রবণতা কমে যাবে। কারণ, মানুষ বাড়ির কাছেই থাকতে চায়। শিক্ষা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং নিয়োগগুলো জেলাভিত্তিক হোক। এ ছাড়া নাগরিকদের সম্পৃক্ততার জন্য তথ্যের অবাধ প্রবাহ প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ মোহাম্মদ শাহান সঞ্চালকের বক্তব্যে বলেন, স্থানীয় সরকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ অংশের ওপর রাষ্ট্রের জোর কম দেখা যাচ্ছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে এ কমিশনের বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা নেই। শাসনব্যবস্থা, রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন নিয়ে যখন কথা হচ্ছে, সেখানে জনগণের সম্পৃক্ততার জায়গা নিয়ে কথা হচ্ছে না।

গোলটেবিল বৈঠকে সূচনা বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ।