গবাদিপশুতে লাম্পি স্কিন ডিজিজ বা এলএসডি রোগের সংক্রমণ হচ্ছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলছে, ২৪ জুলাই ও তার আগের এক বছরে সারা দেশে এই রোগে আক্রান্ত গরুর সংখ্যা ৮ হাজার ৪৯৪। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বাস্তবে এই রোগে আক্রান্ত গরুর সংখ্যা আরও বেশি। মারাও যাচ্ছে গরু। খামারিরা, বিশেষ করে যাঁরা বাড়িতে কয়েকটি গরু পালন করেন, এমন ছোট খামারিরা বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। এই রোগ কীভাবে ছড়ায়, সুরক্ষার উপায় কী, আদৌ এই রোগ নির্মূল করা সম্ভব কি না—এ রকম বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) মোহাম্মদ রেয়াজুল হকের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক প্রদীপ সরকার।

এই রোগ দেশে এল কীভাবে?
মোহাম্মদ রেয়াজুল হক: ২০১৯ সালে এই রোগ প্রথম দেখা যায় চট্টগ্রামের কর্ণফুলী, পটিয়া, আনোয়ারা অঞ্চলে। দেখা যাচ্ছিল এই রোগ ছড়িয়ে যাচ্ছে এবং অতীতের চর্মরোগ থেকে আলাদা। এসব বিবেচনায় ওই বছরের জুলাইয়ে চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে নমুনা সংগ্রহ করে কেন্দ্রীয় রোগ অনুসন্ধান গবেষণাগারে (সিডিআইএল) পাঠানো হয়। ৪ আগস্ট অনুসন্ধান প্রতিবেদন জমা হয়। জানা যায়, এটা গরুর এলএসডি রোগ। আরও অধিকতর নিশ্চিত হতে অস্ট্রেলিয়া থেকে একজন বিশেষজ্ঞ আসেন। তিনি এসে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। তারপর ২৭ আগস্ট পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায়, এটি এলএসডি। এর আগে দেশে এই রোগ ছিল না। অবশ্য তার আগে এই রোগ আফ্রিকা অঞ্চলে দেখা যেত। আমরা ধারণা করছি, এই রোগ আফ্রিকা থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ভারতে আসে। ভারত থেকে আমাদের দেশে এসেছে।
চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রথম শনাক্ত হলে ভারত থেকে কীভাবে আসে?
মোহাম্মদ রেয়াজুল হক: চট্টগ্রাম থেকে নমুনা সংগ্রহের চার-পাঁচ মাস আগে থেকেই খুলনা, যশোর, ঝিনাইদহ—এসব অঞ্চলে এর লক্ষণ দেখা গেছে। তখন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়নি। সে সময় লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল এবং ভালোও হয়ে যাচ্ছিল। তবে চট্টগ্রামে যখন অনেক খামারে হচ্ছিল এবং বড় বড় খামারেও হচ্ছিল, তখন মনে হলো অস্বাভাবিক কিছু। তখন থেকেই এই রোগ থেকে সুরক্ষায় প্রাণিসম্পদ উদ্ভাবিত ‘গোট পক্স’ রোগের টিকা দেওয়া হচ্ছে, যা কাজে লাগছে।
এ রোগের উপসর্গ দেখা দিতে কত দিন লাগে?
মোহাম্মদ রেয়াজুল হক: এলএসডি ভাইরাসজনিত রোগ, যা গরুর শরীরে প্রবেশের পর তিন থেকে সাত দিন সময় লাগে উপসর্গ দেখা দিতে। পশু সুস্থ–সবল হলে উপসর্গ দেখা দিতে আরও বেশি সময় লাগে, কখনো ২৮ দিন লেগে যায়। গরু দুর্বল হলে উপসর্গ দ্রুত দেখা দেয় এবং মাছি বেশি কামড় দিলেও দ্রুত দেখা দিতে পারে।
সুস্থ হতে কত দিন লাগে?
মোহাম্মদ রেয়াজুল হক: পশুস্বাস্থ্য সবল হলে এবং ভালো পরিচর্যা হলে সাধারণত ৫-১০ দিন পর পশুর শরীরে ওঠা গোটা মিলিয়ে যেতে থাকে বা কমতে শুরু করে। কিন্তু গোটা যদি ফেটে যায়, তখন তাতে ব্যাকটেরিয়া ঢোকে, এতে ঘা হয়ে যায়। তখন এক-দেড় মাস সময় লাগে ভালো হতে। পরিচর্যা করলে আরও দ্রুত সুস্থ হয়। না ফাটলে চামড়ার কিছু হয় না। ফেটে গেলে চামড়ার ক্ষতি হয় এবং দাগ স্থায়ীভাবে থেকে যায়।
কীভাবে এই রোগ ছড়ায়?
মোহাম্মদ রেয়াজুল হক: মশা নয়, মাছির কামড়ে এ রোগ ছড়ায়। তবে কোন মাছি এই রোগ ছড়ায়, তা নির্ধারণ করা যায়নি। সব মাছি কামড়ায় না। কিছু মাছি কামড়ায়। দেখা গেল, এই রোগে আক্রান্ত একটি গরুর শরীর থেকে রক্ত খেল একটি মাছি। সেই মাছির মুখে রক্ত বা জীবাণু লেগে আছে। সেই মাছি অন্য একটি সুস্থ গরুকে কামড় দিলে সেটিও এ রোগে আক্রান্ত হবে। এভাবেই ছড়াচ্ছে। মাছির নিজ শরীরের ভেতর জীবাণু উৎপাদন করে না। একটা প্রবণতা দেখা গেছে, একটি খামারে ৩০টি গরু থাকলে সব আক্রান্ত হচ্ছে না। তার মধ্যে ৪-৫টি গরু আক্রান্ত হচ্ছে। আবার পাশের আরেকটি খামারে এভাবে কয়েকটি গরু আক্রান্ত হচ্ছে। এ রোগের ঘনত্ব কম, তবে ছড়িয়ে যাচ্ছে দ্রুত। এর কারণ হয়তো একটি মাছি এক খামারে কামড় দিয়ে কাছাকাছি অন্য খামারে চলে যায়।
ছাগল-ভেড়ার জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উদ্ভাবিত ‘গোট পক্স’ টিকা এই রোগ প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখছে। আবার বিদেশ থেকেও এলএসডির টিকা আমদানি করা হচ্ছে। তারপরও কি সব পশুকে টিকার আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে?
মোহাম্মদ রেয়াজুল হক: গোট পক্সের টিকা একসময় তিন লাখ উৎপাদন করতাম। সেখান থেকে গত অর্থবছর ৩৯ লাখ টিকা তৈরি করেছি। চলতি অর্থবছরে আরও উৎপাদন বাড়ানো হবে। কিন্তু দেশে প্রায় আড়াই কোটি গরু। আগে কিছু গরুকে দেওয়া ছিল, নতুন গরুকে এবার দিয়েছি। আবার কিছু টিকা বেসরকারিভাবে আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এভাবে সব পশুকে টিকার আওতায় আনা হচ্ছে। এই রোগে বেশি বয়সী গরুর চেয়ে অল্প বয়সী গরু বা বাছুর বেশি আক্রান্ত হয়েছে। কারণ হচ্ছে বাছুর টিকার আওতায় কম থাকে। যেমন চার মাসের আগে তো বাছুরকে টিকা দেওয়া যায় না। এর মধ্যেই আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। আর বেশি বয়সী গরুর টিকা থাকায় কম আক্রান্ত হচ্ছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের টিকা মাঠপর্যায়ে কীভাবে দেওয়া হয়?
মোহাম্মদ রেয়াজুল হক: মাঠপর্যায়ে তিনভাবে টিকা দেওয়া হয়। প্রথমত, মাঠপর্যায়ের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বড় খামারে গিয়ে অনেকগুলো গরুকে একবারে টিকা দিয়ে আসে। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় কোনো একটি এলাকায় টিকা দেওয়ার ক্যাম্প করা হয়। সেখানে এলাকার লোকজন গরু নিয়ে আসেন টিকা দিতে। তৃতীয়ত, খামারিরা উদ্যোগ নিয়ে যদি বলেন, তাঁরা এক জায়গায় পশু নিয়ে আসবেন। সেখানে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা গিয়ে টিকা দিয়ে আসেন। তবে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের পক্ষে বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিকা দিয়ে আসা সম্ভব হয় না। এ ক্ষেত্রে খামারিদের একটু উদ্যোগী হতে হবে।
এলএসডি নির্মূল করা সম্ভব কি না?
মোহাম্মদ রেয়াজুল হক: সম্ভব। এর জন্য ব্যাপকভাবে টিকা দিতে হবে। গোট পক্স টিকা আছে। আবার প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএলআরআই) নতুন টিকা উদ্ভাবন করেছে। সেটা চলে এলে টিকা দিয়েই নির্মূল করা সম্ভব হবে। সেই সঙ্গে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাও লাগবে।
সারা দেশেই এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের পাশাপাশি উত্তরাঞ্চলেও এই রোগের প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। এর কারণ কী?
মোহাম্মদ রেয়াজুল হক: এখন বৃষ্টি হচ্ছে, দেখবেন এতে সংক্রমণ কমে যাবে। কারণ, মাছির প্রজননক্ষেত্রে ধুয়ে চলে যাবে। এবারের বর্ষা আদর্শ নয়। একটু বৃষ্টি হওয়ার পর অনেক তাপ, এতে মাছির উপদ্রব এবার রয়ে গেছে। এ কারণে এবার একটু ছড়িয়েছে। বড় খামারিরা খামার পরিবেশ-পরিচ্ছন্ন রাখেন। তাঁদের খামারের আশপাশে মাছি কম জন্মায়। এতে বড় খামারে এই রোগ কম হচ্ছে। কিন্তু যাঁরা বাড়িতে দু-তিনটি গরু পালন করেন, তাঁদের পক্ষে মাছির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা সম্ভব হয় না। তাঁরা গরু রাখার স্থান ও আশপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে পারেন না। এতে তাঁদের গরু বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। তাই মাছি যেখানে জন্মে সেখানে জীবাণুনাশক দিতে হবে। শুকনা রাখতে হবে। তাহলেই মাছি জন্মাতে পারবে না, সংক্রমণ কমবে।
এই রোগ নিয়ন্ত্রণে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ভূমিকা রাখতে পারছে না বলে মনে করেন কি?
মোহাম্মদ রেয়াজুল হক: এমনটা মনে করি না। ভারত হয়ে এই রোগ আমাদের দেশে এসেছে বলে ধারণা। কিন্তু তাদের আগেই আমরা এটা শনাক্ত করেছি, এমনকি চীনের আগে শনাক্ত করেছি। দ্বিতীয়ত, টিকা দেওয়ার শৃঙ্খলা আমরা ভারত-চীনের আগে তৈরি করেছি বা তাদের আগে টিকা দেওয়া শুরু করেছি। নিয়ন্ত্রণের বেলায় আমরা এই দুই দেশ থেকে এগিয়ে আছি। আমাদের যে ঘনত্ব, সবকিছু মিলিয়ে যে রকম অবস্থা হওয়ার কথা সে রকম হয়নি।
ছোট খামারিরা বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছেন এই রোগে। খামারিদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কোনো উদ্যোগ প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর নেবে?
মোহাম্মদ রেয়াজুল হক: এই রোগ নিয়ন্ত্রণে আমরা প্রতিনিয়ত সচেতনতা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। মাত্র ৭০ পয়সা বা ১ টাকারও কমে টিকা দিচ্ছি। এগুলোই আমাদের প্রণোদনা।