
চৌধুরী মুনীর উদ্দিন মাহফুজ ‘উচ্চ আদালতে শুধুই বাংলা ব্যবহার: আবার কি শহীদ হতে হবে?’ শীর্ষক নিবন্ধে তাঁর নিজের বিচারক জীবনের স্মৃতিচারণায় প্রবীণ আইনজীবী আলী সিদ্দীকীর কথা উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘...১৯৯৮ সাল আমি তখন অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে টাঙ্গাইল জেলায় কর্মরত ছিলাম। কোন এক খুনের মামলার রায়ের ফাঁসির আদেশ দেই। সেই রায়টি উন্মুক্ত আদালতে ইংরেজিতে পড়ে শুনাই। তিনি তখন উক্ত আদালতে উপস্থিত থেকে আদালতের অনুমতি নিয়ে বলেছিলেন, হুজুর আদালত-এ মামলার মক্কেলগণ বাঙালী, বিজ্ঞ আইনজীবীগণও বাঙালী এবং মাননীয় বিচারক আপনিও বাঙালী। তাই রায়টি যদি বাংলায় হতো, তাতে কারও কোন আপত্তি থাকতো না বা অসুবিধা হতো না। বরং মক্কেলগণের বুঝতে সুবিধা হতো হুজুর কেন ফাঁসি দিলেন। তারা বুঝলো তাদের ফাঁসি হয়েছে। কেন হলো, তা তো তারা বুঝলো না। আর এভাবে বাংলায় রায় লিখলে ভাষা আন্দোলন ও ভাষাশহীদদের এবং স্বাধীনতা আন্দোলন ও স্বাধীনতার শহীদদের প্রতি যথোপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করা হতো। আদালতের কাছে বাংলায় রায় চাওয়া আমাদের সাংবিধানিক অধিকার এবং এ অধিকার ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতাযুদ্ধের চেতনার সম্পূরক। আমাদের এ চাওয়া বেশি চাওয়া নয়….।’(৫৮ ডি.এল.আর পাতা-জার্নাল-১৮)
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ তিনে মাত্র তিনটি শব্দে আমাদের সংবিধান স্পষ্ট ঘোষণা প্রদান করেছে, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা।’ সংবিধানের এই অনুচ্ছেদ অনুসারে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাভাষীর এই দেশে সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার বাধ্যতামূলক হওয়ার কথা। কারণ, ‘সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন।’ এ ছাড়া জাতীয় জীবনে বাংলা ভাষার গুরুত্ব অনুধাবনের জন্য সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশে ‘জাতীয় সংস্কৃতি’ শিরোনামে অনুচ্ছেদ ২৩-এ রাষ্ট্রকে ‘জাতীয় ভাষা’র উন্নয়নে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। এখানে আরও বলা হয়েছে, রাষ্ট্র এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, যাতে সর্বস্তরের জনগণ জাতীয় সংস্কৃতির সমৃদ্ধিতে অবদান রাখার ও অংশগ্রহণ করার সুযোগ পায়।
বাংলাদেশের সংবিধান ও আইনে বাংলা কীভাবে এল, এই সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার জন্য স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মে বাংলা ভাষার অবদান কী, সে সম্পর্কে কিছু কথা বলা উচিত। ১৯৪৭ সালে ইংরেজ শাসন অবসানের সময় দ্বিজাতি তত্ত্ব অনুসারে জন্ম হয় দুটি দেশের—ভারত ও পাকিস্তান। এই পাকিস্তান ছিল আবার দুটি অংশে বিভক্ত—পূর্ব ও পশ্চিম। ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের আবাসভূমি হিসেবে দুই পাকিস্তানের অবস্থান এক হলেও ভৌগোলিকভাবে তাদের দূরত্ব ছিল হাজার মাইলের বেশি, সাংস্কৃতিক পার্থক্য ছিল তেল ও জলের মতো, অর্থনৈতিক পার্থক্য ছিল প্রভু ও ভৃত্যের ন্যায়, বৈষম্য ছিল ব্যাপক। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক পার্থক্যের ওপর প্রথম প্রশ্নবোধক চিহ্ন উঠে আসে ভাষার প্রশ্নে। এ দেশের মানুষ ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি গৃহীত হওয়া তাদের ‘কনস্টিটিউশন অব ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান’-এর ২১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার অল্প কয়েক দিন আগে ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা একাডেমির একুশের অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘আমি ঘোষণা করছি, আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে, সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। বাংলা ভাষার পণ্ডিতেরা পরিভাষা তৈরি করবেন, তারপর বাংলা ভাষা চালু হবে, সে হবে না। পরিভাষাবিদেরা যত খুশি গবেষণা করুন, আমরা ক্ষমতা হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা চালু করে দেব, সেই বাংলা যদি ভুল হয়, তবে ভুলই চালু হবে, পড়ে তা সংশোধন করা হবে।’(বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল লিখিত ‘মায়ের ভাষায় আদালতের রায়’ বই থেকে উদ্ধৃত)
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয়ী ৪০৩ সদস্য নিয়ে গণপরিষদের অধিবেশন বসে এবং সেই অধিবেশনে ড. কামাল হোসেনকে সভাপতি করে ৩৪ সদস্যের ‘খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি’ গঠন করা হয়। সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্যরা ৭৪টি বৈঠকে মিলিত হয়ে ১৫৩টি অনুচ্ছেদ–সংবলিত খসড়া সংবিধান বিল আকারে গণপরিষদের সামনে পেশ করেন। বিভিন্ন সংশোধনী প্রস্তাব আলোচনা-পর্যালোচনা করে বাংলায় লেখা সংবিধান গৃহীত হয় এবং ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে তা কার্যকর হয়। এভাবেই স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান তথা সর্বোচ্চ আইনে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা স্থান করে নেয়।
সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের পরও সর্বস্তরে এর ব্যবহার শুরু করা যায়নি। এ কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘বাংলা ভাষার প্রচলন সংক্রান্ত সরকারি নির্দেশ, ১৯৭৫’ জারি করেন। যেখানে বলা হয়, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলা আমাদের জতীয় ভাষা। তবুও অত্যন্ত দুঃখের সাথে লক্ষ্য করছি যে, স্বাধীনতার তিন বৎসর পরেও অধিকাংশ অফিস-আদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ইংরেজি ভাষায় নথিপত্র লেখা হচ্ছে। মাতৃভাষার প্রতি যার ভালোবাসা নেই, দেশের প্রতি তার ভালোবাসা আছে, এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। দীর্ঘ তিন বৎসর অপেক্ষার পরও বাংলাদেশের বাঙ্গালী কর্মচারীরা ইংরেজি ভাষায় নথিতে লিখবেন, সেটা অসহনীয়। এ সম্পর্কে আমার পূর্ববর্তী নির্দেশ সত্বেও এ ধরনের অনিয়ম চলছে। আর এ উচ্ছৃঙ্খলতা চলতে দেয়া যেতে পারে না। এ আদেশ জারী হওয়ার সংগে সংগে সকল সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও আধা-সরকারি অফিসসমূহে কেবলমাত্র বাংলার মাধ্যমে নথিপত্র ও চিঠিপত্র লেখা হবে, এ বিষয়ে কোন অন্যথা হলে উক্ত বিধি লংঘনকারীকে আইনানুগ শাস্তি দেবার ব্যবস্থা করা হবে। বিভিন্ন অফিস-আদালতের কর্তা ব্যক্তিগণ সতর্কতার সাথে এ আদেশ কার্যকরী করবেন এবং আদেশ লংঘনকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা করবেন। তবে কোন বিদেশী সংস্থা বা সরকারের সাথে পত্র যোগাযোগ করার সময় বাংলার সাথে ইংরেজি অথবা সংশ্লিষ্ট ভাষার একটি প্রতিলিপি পাঠানো প্রয়োজন। তেমনিভাবে বিদেশের কোন সরকার বা সংস্থার সাথে চুক্তি সম্পাদনের সময়ও বাংলার সাথে অনুমোদিত ইংরেজি বা সংশ্লিষ্ট ভাষার প্রতিলিপি ব্যবহার করা চলবে।—শেখ মুজিবুর রহমান, রাষ্ট্রপতি।’(বাংলা ভাষার প্রচলন সংক্রান্ত সরকারি নির্দেশ, ১৯৭৫ রাষ্ট্রপতির সচিবালয়, গণভবন, ঢাকা সংখ্যা ৩০.১২.৭৫, সাধারণ- ৭২৯/১ (৪০০) ১২ মার্চ, ১৯৭৫)
সংবিধানের অনুচ্ছেদ তিন অনুসারে বাংলা ভাষার ব্যবহার আইন দ্বারা বিধিবদ্ধ করার জন্য ১৯৮৭ সালে ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭’ প্রবর্তন করা হয়। মাত্র চারটি ধারার সে আইনের ৩(১) ধারায় বলা হয়, ‘বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারী অফিস, আদালত, আধা-সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সাথে যোগাযোগ ব্যতীত অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন আদালতের সওয়াল জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগত কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে।’ ওই আইনের ৩(২) ধারায় আরও উল্লেখ করা হয়, ‘কোন কর্মস্থলে যদি কোন ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোন ভাষায় আবেদন বা আপীল করেন, তাহলে তা বেআইনী ও অকার্যকর বলে গণ্য হবে।’ সরকারি কর্মকর্তাদের এ আইন অমান্যের জন্য ৩(৩) ধারায় শাস্তির বিধান করা হয়েছে। শাস্তি হিসেবে এ আইন আমান্যকারী ব্যক্তি, সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধির অধীনে অসদাচরণ করেছেন বলে গণ্য করে তাঁর বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধি অনুসারে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ১৯৮৭ সালের পর থেকে বাংলাদেশের সব আইন, অধ্যাদেশ, বিধিবিধান ও প্রজ্ঞাপন ইত্যাদি বাংলায় প্রণীত হচ্ছে।
আমরা জানি, রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগ থাকে; নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সচিবালয়সহ নির্বাহী বিভাগের সব স্তরে বাংলা প্রায় পুরোপুরি চালু আছে। আইন বিভাগ তথা বাংলাদেশের সংসদ ও সংসদ সচিবালয়ে সংসদ অধিবেশনসহ সব কাজও বাংলাতেই হয়। কিন্তু বিচার বিভাগে অধস্তন দেওয়ানি এবং ফৌজদারি আদালত যথাক্রমে দেওয়ানি কার্যবিধি, ১৯০৮–এর ধারা ১৩৭ এবং ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮–এর ধারা ৫৫৮ অনুসারে বাংলা ভাষায় হলেও উচ্চ আদালত এখনো ইংরেজি থেকে পুরোপুরি বের হতে পারেননি। উচ্চ আদালতে ইংরেজির ব্যবহার নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগের মৌলিক অধিকার অংশের অনুচ্ছেদ ৩৫(৩) অনুসারে, বাংলাদেশের সব নাগরিক প্রকাশ্য বিচার পাওয়ার অধিকারী। অর্থাৎ আদালতকে হতে হবে উন্মুক্ত, সবার জন্য প্রকাশ্য এবং আদালতের ভাষা হতে হবে সবার জন্য বোধগম্য। সুতরাং উচ্চ আদালতে ইংরেজির ব্যবহার আমাদের সংবিধান, সংস্কৃতি ও জনস্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যত দ্রুত সম্ভব আদালতের সব কাজে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
মো. সাজিদুর রহমান আইনজীবী