পুরান ঢাকার সোব্বাসী ভাষায় উর্দু আধিক্য—অপবাদে কোণঠাসা ভাষাটি

সোব্বাসী ভাষা সংরক্ষণে কিছু কাজ শুরু হয়েছে। ফেসবুকে এ ভাষাভাষীর জনগোষ্ঠীরা অনেক গ্রুপে যুক্ত হয়ে ভাষাটি নিয়ে আলোচনা করছেন
ছবি: লেখক

পুরান ঢাকার সোব্বাসী ভাষা প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। তবে ‘বাংলা-ঢাকাইয়া সোব্বাসী ডিক্সেনারি’ বা অভিধান, সোব্বাসী ক্লাব গঠন, বিভিন্ন বই প্রকাশের মধ্য দিয়ে ভাষাটি সংরক্ষণে কিছু কাজ শুরু হয়েছে। ফেসবুকে এ ভাষাভাষীর জনগোষ্ঠীরা অনেক গ্রুপে যুক্ত হয়ে ভাষাটি নিয়ে আলোচনা করছেন, নানা উদ্যোগ নিচ্ছেন।

এ ভাষাভাষী মানুষের আক্ষেপ, পুরান ঢাকার ঘরের মধ্যে, বাজার বা শুধু কয়েকটি জায়গায় কিছু মানুষ সোব্বাসী ভাষায় কথা বলছেন। বর্তমান প্রজন্ম এ ভাষায় কথা বলে না। নিজেদের এ ভাষাভাষী হিসেবে পরিচয় দিতেও অনেকে পান লজ্জা। ভাষায় উর্দু শব্দের আধিক্য—এ অপবাদের কারণে রাজনৈতিকভাবেও ভাষাটি কোণঠাসা হয়ে আছে।

বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি ঢাকার ৪০০ বছর উদ্‌যাপনের অংশ হিসেবে ‘ঢাকাই উপভাষা প্রবাদ-প্রবচন কৌতুক ছড়া’ নামের একটি বই প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, পুরান ঢাকার মানুষের ভাষিক ঐতিহ্য বিশ্লেষণে যে দুটি ভাষারীতির ব্যবহার লক্ষ করা যায়, সেগুলো হলো কুট্টি ও সুখবাস ভাষা। বইটিতে কুট্টি ভাষা ও সুখবাস বা সোব্বাসি ভাষার বিভিন্ন উদাহরণও দেওয়া হয়েছে।

২০২১ সালে ‘বাংলা-ঢাকাইয়া সোব্বাসী ডিক্সেনারি’ বইটি প্রকাশিত হয়। বইয়ের লেখক মো. শাহাবুদ্দিন

২০২১ সালে ‘বাংলা-ঢাকাইয়া সোব্বাসী ডিক্সেনারি’ বইটি প্রকাশিত হয়। ঢাকাইয়াদের পুরোনো সোব্বাসী ভাষা বেঁচে থাকুক—এ জন্যই এ অভিধান সম্পাদনা করেছেন মো. শাহাবুদ্দিন। তিনি বলেন, সুখে বাস করা বা সুখবাস শব্দ থেকে ‘সোব্বাস’ শব্দের উৎপত্তি। সোব্বাস ঢাকাইয়ারা ‘সুখ’কে বলে ‘সোখ’। সুখবাস থেকে সোখবাস আর তা থেকে সোব্বাস। অর্থাৎ সুখবাস > সোখবাস > সোববাস > সোব্বাস > সোব্বাসী।

‘এব্বিকা আর আনেআলা সাব সোব্বাসী বাচ্চাওনোকিলে’, অর্থাৎ বর্তমান ও ভবিষ্যতের সোব্বাসি ভাষার শিশুদের জন্য এ অভিধান। অভিধানের শুরুতেই স্পষ্ট করে এ কথা লিখেছেন মো. শাহাবুদ্দিন। অভিধানটিতে শব্দ আছে ৫৯ হাজার ৩৮০টি। ২২২ পৃষ্ঠার এ অভিধানে বাংলা শব্দভুক্তি ১৫ হাজার ৩০৪টি। পুরান ঢাকার ঘরে, বাজারে যে শব্দগুলোর ব্যবহার বেশি, সেগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এতে।

মো. শাহাবুদ্দিনের স্ত্রী উম্মে হালিমাও সোব্বাসী ভাষায় কথা বলেন। তিনিও অভিধান প্রণয়নে বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছেন। অভিধানটির ভূমিকা বাংলা প্রচলিত ভাষা এবং বাংলা বর্ণমালায় সোব্বাসী ভাষায় লেখা হয়েছে।

মো. শাহাবুদ্দিনের জন্ম পুরান ঢাকার আগামসি লেনে। তাঁর মা হোসনে আরার জন্মও এ এলাকায়। বাবা আশ্রাফউদ্দিনের জন্ম সিদ্দিকবাজারে। বাবা পঞ্চায়েতের সরদারদের বংশধর। মো. শাহাবুদ্দিন সাভার সরকারি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। তিনি জানান, সোব্বাসি ভাষাটি মূলত ১৪টি ভাষার মিশ্রিত রূপ। এ ভাষার ৬০ শতাংশই সংস্কৃত বাংলা শব্দ।

৭২ বছর বয়সী ব্যবসায়ী মো. জাহাঙ্গীর করিম

গত বছর ২৪ অক্টোবর প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘ঢাকাইয়া সোব্বাসী ও তাদের ভাষা’ শিরোনামের এক নিবন্ধে মো. শাহাবুদ্দিন বলেন, সোব্বাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত কথ্য হিন্দুস্তানি ভাষার ওপর ১৬১০ থেকে ১৮৩০ সাল পর্যন্ত ফারসি, ১৮৩১ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ইংরেজি, উর্দু, ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত উর্দু, ১৯৭১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বাংলা ভাষার প্রভাব ছিল।

১৯৪৭ সালে ভারত থেকে অসংখ্য মুহাজির ঢাকায় প্রবেশ করে। তখন সোব্বাসী ভাষার ওপর এই মুহাজিরদের, যাদের ‘বিহারি’ বলা হয়, তাদের ভাষা উর্দু প্রভাব বিস্তার করেছিল। এখনো অনেককেই ঢাকার এই বিহারি উর্দুর সঙ্গে সোব্বাসী ভাষাকে গুলিয়ে ফেলতে দেখা যায়। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর সোব্বাসী ভাষায় ব্যাপক হারে বাংলা শব্দের প্রবেশ ঘটেছে এবং ঘটছে। ইদানীং ভারতীয় হিন্দি চ্যানেলের সুবাদে হিন্দি শব্দেরও প্রবেশ হয়েছে।

মো. শাহাবুদ্দিন আক্ষেপ করে বলেন, তবে এ ভাষা বিহারিদের ভাষা, এতে উর্দুর আধিক্য বেশি—এ ধরনের অপবাদ পিছু ছাড়ছে না। আর শুধু এ কারণেই রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে আছে ভাষাটি।

গবেষক শায়লা পারভীন, ড. কানিজ-ই-বাতুলসহ বিভিন্ন গবেষকের তথ্য উল্লেখ করে মো. শাহাবুদ্দিন জানান, ইসলাম খা চিশতির সময় থেকেই, অর্থাৎ ১৬১০ সাল থেকেই ‘ঢাকাইয়া সোব্বাসী’রা পুরান ঢাকার অধিবাসী। ঢাকায় বসবাসকারী সব উচ্চ ও নিম্নপদস্থ পরিবারগুলোর মধ্যে আরবি, ইংরেজি, গুজরাটি, তুর্কি, পালি, পর্তুগিজ, ফরাসি, ফারসি, মুন্ডা, সংস্কৃত, বাংলা, হিন্দুস্তানি (উর্দু, হিন্দি) ভাষার মিশ্রণে নতুন এক মিশ্রিত কথ্যভাষার প্রচলন শুরু হয়, যা এখনো ঢাকার আদি অধিবাসীদের আঞ্চলিক কথ্যভাষা। এ মিশ্রিত হিন্দুস্তানি ভাষা পরিবর্তিত হয়ে বর্তমানে কথ্য সোব্বাসী ভাষায় পরিণত হয়েছে। তবে ঠিক কত মানুষ এ ভাষা ব্যবহার করে, তার হিসাব কখনো করা হয়নি। বর্তমানে ঢাকায় সূত্রাপুর, কোতোয়ালি, বংশাল, চকবাজার ও লালবাগ থানার অন্তর্গত বিভিন্ন মহল্লায় সোব্বাসীদের বাস।

এ ভাষায় কথা বলা ব্যক্তিরা বলছেন, সোব্বাসী ও কুট্টি—দুটিই ঢাকার নগর উপভাষা হলেও এ দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাষা। শব্দ ও উচ্চারণে মিলের চেয়ে অমিলই বেশি। সোব্বাসী ভাষা কোণঠাসা হয়ে থাকায় বর্তমানে নাটক ও সিনেমায় কুট্টি ভাষাকে ঢাকাইয়া ভাষা হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিকৃতভাবে বা নেতিবাচকভাবে প্রচার করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ সোব্বাসী ভাষায় কথা বলা মানুষদের।

সোব্বাসী ভাষাটি কেমন

সোব্বাসী ভাষার জটিল বিষয়গুলোর একটি ‘া’ (আ-কার)। ঢাকাইয়া সোব্বাসীরা দুই রকমের ‘া’ (আ-কার) উচ্চারণ করে—একটি জোর দিয়ে, আরেকটি আস্তে নরম সুরে। যেমন ‘আকাশের মেঘ’-এর সোব্বাসী ‘আসমানকা আবার’; এখানে ‘আসমানকা’ শব্দে প্রতিটি ‘া’ (আ-কার) জোর দিয়ে উচ্চারিত হবে আর ‘আবার’ শব্দে প্রতিটি ‘া’ (আ-কার) আস্তে, নরম সুরে উচ্চারিত হবে। এই ‘া’ (আ-কার)-এর উচ্চারণের কারণে যারা সোব্বাসী ভাষা জানে না, তাদের সোব্বাসী শব্দ উচ্চারণে সমস্যা হতে পারে।

সোব্বাসি শব্দে ‘ই’ ও ‘ি’ (ই-কার)-এর ব্যবহার ক্ষেত্রভেদে ‘এ’ ও ‘ে’ (এ-কার)-এ বিবর্তিত। যেমন ‘ই’-এর স্থলে ‘এ’: এলেম, এমাম, এজহার, এরাদা, এজারা, এজ্জাত, এজারবান্দ, এংরেজ, এন্তেজাম, এন্তেজার, এন্তেকাল ইত্যাদি।

‘ি’-এর স্থলে ‘ে’: কেরায়া, খেলাফাত, গেলাস, ঘেন, চেকনা, ছেদা, জেকার ইত্যাদি।

সোব্বাসীরা চন্দ্রবিন্দু খুব কমই ব্যবহার করে এবং যেকোনো শব্দ দ্রুত উচ্চারণ করে। যেমনÑ‘চানখাঁরপুল’কে দ্রুত বলে ‘চাংখাকাপোল’। ঠিক তেমনি ‘ঊ-কার’, ‘ঈ-কার’, ‘শ’-এর ব্যবহার কম। ‘শ’, ‘স’Ñ উভয়কেই অধিকাংশ শব্দে ‘স’-এর মতো উচ্চারণ করে।

যেমন—

১.

বাংলা: কুঁজোর আবার চিত হয়ে ঘুমানোর শখ।

সোব্বাসি: কুজাকা ফের চেত হোকে শোনেকা শাওখ।

কুট্টি: গুজারবি আবার চিত অয়া হুইবার সক।

২.

বাংলা: কুকুরের পেটে ঘি হজম হয় না।

সোব্বাসি: কোত্তাকা পেটমে ঘি হাজাম হোতানি।

কুট্টি: কুত্তার প্যাটে গি অজম অহে না।

৩.

বাংলা: বসতে দিলে ঘুমাতে চায়।

সোব্বাসি: বায়েটনে দেনেসে শোনে মাঙতা।

কুট্টি: বইবার দিলে হুইবার চায়।

ভাষাটি যাতে হারিয়ে না যায়

সোব্বাসী ভাষার আলাদা কোনো বর্ণমালা নেই। বাংলা বর্ণমালা ব্যবহার করে সোব্বাসী ভাষায় অভিধানসহ বিভিন্ন লেখালেখি হচ্ছে। ২০২১ সালে সোব্বাসী ক্লাবের ‘হামো হামোই’ নামের প্রকাশনাটি পুরোটাই বের করা হয়েছে সোব্বাসী ভাষায়।

পুরান ঢাকার আগামসি লেনের ৭২ বছর বয়সী ব্যবসায়ী মো. জাহাঙ্গীর করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘দলিত–হরিজনদের সমাজে যেমন নিকৃষ্ট শ্রেণির মনে করা হয়, আমরা যারা সোব্বাসি ভাষায় কথা বলি, তাদেরও বিহারি মনে করে হেয় করা হয়। অনেকে নিজেরাও এ ভাষায় কথা বলতে লজ্জা পান। আমি আমার মেয়েদের সঙ্গে এ ভাষায় কথা বললেও নাতি-নাতনিরা এ ভাষায় কথা বলে না।’

১৯৬৫ সালে যাত্রা শুরু করা ঢাকা মহানগরী সমিতি (ঢাকা সমিতি) পিঠা উৎসব, ঘুড়ি উৎসব, বার্ষিক বনভোজনসহ বিভিন্ন উৎসব নিয়ে মেতে থাকলেও পুরান ঢাকার ভাষা সংরক্ষণে এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেয়নি বলেও অভিযোগ করেন মো. জাহাঙ্গীর করিম।

ঢাকা মহানগরী সমিতির (ঢাকা সমিতি) কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সদস্য মাহমুদ মুসলিম নিজেও সোব্বাসী ভাষায় কথা বলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সমিতি পুরান ঢাকার সব আঞ্চলিক ভাষাকেই প্রাধান্য দেয়। তবে এটাও ঠিক যে সোব্বাসী ভাষাটা প্রায় বিলুপ্তির পথে। এ ভাষাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন অপবাদও প্রচলিত আছে।

গবেষণাধর্মী লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত আনিস আহামেদ তাঁর ‘ঢাকাইয়া আসলি’, ‘ঢাকাইয়া বাতচিৎ’সহ বিভিন্ন বইয়ে ঢাকার আদি ভাষা নিয়ে লিখেছেন। ‘ঢাকাইয়া আসলি’ বইয়ে তিনি লিখেছেন, থিয়েটারচর্চায় হিন্দুস্তানি ভাষাভাষীর ঢাকাইয়ারা বিপুল সফলতা লাভ করেছিল। হিন্দুস্তানি ও উর্দু ভাষায় নাটক রচনা, পরিচালনা ও অভিনয় করায় যতটা তারা উৎকর্ষ লাভ করেছিল, এ ধারা অব্যাহত থাকলে শুধু থিয়েটারের কল্যাণেই সোব্বাসি ঢাকাইয়াদের ভাষা ও সংস্কৃতি বেঁচে থাকতে পারত।

আনিস আহামেদ প্রথম আলোকে বলেন, সোব্বাসী ভাষায় ব্যবহৃত উর্দু আর প্রাতিষ্ঠানিক উর্দুর মধ্যে অনেক তফাত। মোগল নবাবদের বা নবাববাড়ির ভাষা ছিল উর্দু। নবাববাড়ির লোকেরা ভাষা আন্দোলনের বিরোধিতা করলেও সোব্বাসীভাষীরা ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন এবং তাঁরা আন্দোলন ও যুদ্ধে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষে নবাববাড়িকেন্দ্রিক উর্দুর যে বদনাম ছিল, তাতে অনেকেই স্কুলে বা বাইরে বাংলা ছাড়া অন্য ভাষায় কথা বলা বন্ধ করে দেন। ভাষার মর্যাদা দেওয়ার বিষয়টাও তেমন ছিল না। ফলে, সোব্বাসী ভাষার চর্চার কমে যায়।

নিজের ৫৯ বছর বয়সের উদাহরণ দিয়ে আনিস আহামেদ বলেন, ‘আমি নিজেও আমার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সোব্বাসী ভাষায় কথা বলি না। মা-বাবা, ভাইবোন, খালা-মামা বা খালাতো–মামাতো ভাইবোনের সঙ্গে শুধু এ ভাষায় কথা বলি। তবে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া এবং ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ বাড়ায় এখন আবার সোব্বাসী ভাষার উন্নয়নে বিভিন্নজন এগিয়ে এসেছেন। আমি নিজেও দীর্ঘদিন ধরে সোব্বাসী ভাষার প্রয়োগসহ একটি অভিধানের কাজ করছি।’