
স্তন ক্যানসার নির্ণয় সঠিকভাবে করার পরই চিকিৎসা শুরু করতে হবে, সামাজিক কুসংস্কারও ভাঙতে হবে। যেহেতু নতুন জেনেটিক টেস্ট ও ওষুধের মাধ্যমে উদ্ভাবন সম্ভব, তাই সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।
‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনায় অতিথিদের কথায় প্রসঙ্গগুলো উঠে আসে। নাসিহা তাহসিনের উপস্থাপনায় এ পর্বে অতিথি হিসেবে ছিলেন ল্যাবএইড ক্যানসার হাসপাতাল অ্যান্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টারের ক্লিনিক্যাল ও রেডিয়েশন অনকোলজির সিনিয়র কনসালট্যান্ট অধ্যাপক ডা. কাজী মুশতাক হোসেন এবং ক্যানসার বিশেষজ্ঞ, স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক। ক্যানসার বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে এসকেএফ অনকোলজি।
এবারের আলোচনায় স্তন ক্যানসার নিয়ে বিভিন্ন সচেতনতামূলক পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা। পর্বটি ২৬ অক্টোবর (রোববার) সরাসরি প্রচারিত হয় প্রথম আলো ডটকম এবং প্রথম আলো, এসকেএফ অনকোলজি ও এসকেএফের ফেসবুক পেজে। আলোচনায় উঠে আসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০৪০ সালের মধ্যে ‘৬০-৬০-৮০’ কৌশল অনুযায়ী ৬০ শতাংশ রোগীকে স্টেজ ওয়ান/ টু-তে শনাক্ত, ৬০ দিনের মধ্যে ডায়াগনোসিস নিশ্চিত করা ও ৮০ শতাংশ রোগীকে সম্পূর্ণ চিকিৎসা দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা করেছে।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই উপস্থাপক জানান, অনেকে ক্যানসারকে আধুনিক যুগের রোগ মনে করলেও স্তন ক্যানসার সম্পর্কে মানুষ অনেক আগেই জানত—প্রথম রিপোর্টেড কেসটি পাওয়া যায় বাইজেন্টাইন যুগে। সেই থেকেই চলমান গবেষণার ধারাবাহিকতায় আজ স্তন ক্যানসারের চিকিৎসা ও নির্ণয়পদ্ধতিতে এসেছে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি।
স্তন ক্যানসারের লক্ষণগুলো এবং এসব দেখা দিলে কী করা উচিত? এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ডা. কাজী মুশতাক হোসেন বলেন, স্তন ক্যানসার সাধারণত শুরুতে ছোট একটি গাঁট বা চাকা হিসেবে ধরা পড়ে, যা অনেক সময় নিজের হাতেই বোঝা যায়। তবে সব গাঁটই ক্যানসার নয়—বেশির ভাগই ক্ষতিকর নয়।
অধ্যাপক ডা. কাজী মুশতাক হোসেন বলেন, এই ক্যানসারের প্রধান লক্ষণগুলো হলো স্তনে গাঁট বা পিণ্ড ধরা পড়া, নিপল ভেতরে ঢুকে যাওয়া, নিপল বা স্তন থেকে রস বা রক্ত নির্গত হওয়া, চামড়া কমলালেবুর খোসার মতো খসখসে হয়ে যাওয়া, বগলে গাঁট অনুভব হওয়া। মনে রাখতে হবে, যদি এ ক্যানসার ছড়িয়ে পড়ে, সে ক্ষেত্রে লিভারে জন্ডিস, হাড়ে ব্যথা বা ভাঙা, মাথাব্যথা ও বমি আর ফুসফুসে কাশি বা রক্ত আসার মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে। যখনই স্তন বা বগলে কোনো অস্বাভাবিকতা টের পাওয়া যায়, তখনই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। প্রথমে ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানের কাছে যাওয়া ভালো। তিনি প্রয়োজনে পরীক্ষা বা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ দেবেন। মনে রাখতে হবে, প্রায় ৮৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই স্তনের গাঁট ক্যানসার নয়, তবে নিশ্চিত হতে দ্রুত পরীক্ষা করানো অত্যন্ত জরুরি।
জেনেটিক ফ্যাক্টর কি স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়? আগে থেকে এই ঝুঁকি জানা সম্ভব? উপস্থাপকের এমন প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক ডা. গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক বলেন, স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি দুইভাবে দেখা যায়—পরিবর্তনযোগ্য ও অপরিবর্তনযোগ্য। খাদ্যাভ্যাস, দেরিতে সন্তান নেওয়া, বুকের দুধ না খাওয়ানো এবং ধূমপান—এসব পরিবর্তনযোগ্য ঝুঁকি। আর অপরিবর্তনযোগ্য ঝুঁকি হলো জেনেটিক বা বংশগত প্রভাব—যা পরিবারে কেউ ক্যানসারে আক্রান্ত হলে অন্যদের ঝুঁকিও বাড়ে।
অধ্যাপক ডা. গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক বলেন, তাই ঝুঁকি বোঝার জন্য ‘বিআরসিএ১’ ও ‘বিআরসিএ২’ নামের জেনেটিক টেস্ট করা যায়। যদি টেস্টে মিউটেশন পজিটিভ হয়, তাহলে আশঙ্কা বেশি ধরা হয়—তবে এটি নিশ্চিত করে না যে ক্যানসার হবেই। একইভাবে নেগেটিভ ফলাফল মানেও পুরোপুরি নিশ্চিন্ত থাকা নয়। তাই যাঁদের পারিবারিক ইতিহাস আছে, তাঁদের নিয়মিত সেলফ-এক্সামিনেশন ও স্ক্রিনিং করানো উচিত।
ক্লিনিক্যাল ব্রেস্ট এক্সামিনেশন কত ধরনের এবং কত দিন পরপর করা উচিত? জানতে চাইলে অধ্যাপক ডা. গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক বলেন, ব্রেস্ট পরীক্ষা মূলত দুই ধরনের—সেলফ ব্রেস্ট এক্সামিনেশন, যা নিজে নিজে বাড়িতে করা যায়। অন্যটি ক্লিনিক্যাল ব্রেস্ট এক্সামিনেশন, যা ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মী করে থাকেন। বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটিসহ সরকারি ও বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান নিয়মিত ক্লিনিক্যাল স্ক্রিনিং করে থাকে, যেখানে চিকিৎসকেরা সরাসরি রোগীকে পরীক্ষা করেন।
অধ্যাপক ডা. গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক বলেন, প্রয়োজনে তাঁরা দুটি অতিরিক্ত টেস্ট সাজেস্ট করেন—আলটাসোনোগ্রাফি, যা সন্দেহজনক কিছু অনুভব হলে করা যায়। এটি নিরাপদ এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত। তবে মাসিক চলাকালে করা ঠিক নয়; পিরিয়ড শেষ হওয়ার ৫ থেকে ৭ দিন পর করা উপযুক্ত। অন্যটি হলো ম্যামোগ্রাফি, যা একধরনের বিশেষ এক্স-রে। এটি সাধারণত ৪০ বছর বয়সের পর প্রতিবছর একবার করার পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে যদি পরিবারে স্তন ক্যানসারের ইতিহাস থাকে, তাহলে ৩০ বছর বয়সের পর থেকেই এটি করা যেতে পারে।
স্তন ক্যানসারে সার্জারির সঠিক প্রয়োজনীয়তা এবং এর ধরন সম্পর্কে ডা. কাজী মুশতাক হোসেন বলেন, ছোট টিউমার (২ সেন্টিমিটারের কম) হলে প্রথমেই অপারেশন। বড় বা বগল বা স্ক্রিনে ছড়িয়ে গেলে আগে কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপি দিয়ে ছোট করে পরে অপারেশন। অ্যাডভান্সড বা মেটাস্টেটিক ক্যানসারে সাধারণত অপারেশন হয় না, তবে গুরুতর ঘা, সংক্রমণ বা দুর্গন্ধ থাকলে প্যালিয়েটিভ সার্জারি করা হয়।
সার্জারির ধরন সম্পর্কে ডা. কাজী মুশতাক হোসেন বলেন, ‘এটি তিন ধরনের। ব্রেস্ট কনজারভেটিভ/ ওয়াইড এক্সিশন—শুধু টিউমার ও আশপাশের অংশ কেটে ফেলা হয়। অঙ্কোপ্লাস্টিক সার্জারি—অপারেশনের পরে স্তনের আকার ঠিক রাখা। মোডিফাইড র্যাডিক্যাল মাস্টেকটমি—আগে পুরো ব্রেস্ট ও বগলের লিম্ফনোড কাটা হতো, এখন প্রয়োজনমতো করা হয়। এ ধরনের সার্জারি আধুনিক হওয়ায় এখানে নানান সুবিধা পাওয়া যায়। তার মধ্যে হাত ফোলা বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম, রেডিয়েশনের ক্ষতি ন্যূনতম, নতুন কৌশলে কসমেটিক ও শারীরিক প্রভাব কম। সুতরাং রোগীদের মনে রাখতে হবে, সার্জারির ভয়ে চিকিৎসা এড়িয়ে চলবেন না। কারণ, আধুনিক চিকিৎসায় রোগী সুস্থ জীবন যাপন করতে পারেন।’
হরমোন রিসেপ্টর পজিটিভ বা নেগেটিভ ব্রেস্ট ক্যানসার শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে ডা. গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক বলেন, ‘স্তন ক্যানসারের হরমোন রিসেপ্টর শনাক্ত করার জন্য প্রথমে কোর নিডল বায়োপসি করে টিউমারের টিস্যু সংগ্রহ করা হয় এবং মাইক্রোস্কোপে পরীক্ষা করা হয়। এরপর ইমিউনোহিস্টোকেমিস্ট্রি টেস্টের মাধ্যমে এস্ট্রোজেন রিসেপ্টর (ইআর), প্রজেস্টরন রিসেপ্টর (পিআর) এবং হারটু রিসেপ্টর পরীক্ষা করা হয়। ফলাফলের ওপর নির্ভর করে চিকিৎসা নির্ধারণ করা হয়; যদি পজিটিভ হয়, তবে নির্দিষ্ট হরমোন বা টার্গেটেড থেরাপি দেওয়া যায়, নেগেটিভ হলে সেই ওষুধ প্রযোজ্য হয় না। তিনটি রিসেপ্টরই নেগেটিভ হলে তাকে ট্রিপল নেগেটিভ ব্রেস্ট ক্যানসার (টিএনবিসি) বলা হয়, যা ঝুঁকিপূর্ণ। কখনো সার্জারি বা কেমোথেরাপির আগে বা পরে টেস্ট পুনরায় করা হতে পারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য। চিকিৎসা পরিকল্পনা রোগীর স্বাস্থ্য, আর্থিক সক্ষমতা ও ডাক্তারের সঙ্গে আলাপের ভিত্তিতে করা হয় এবং চিকিৎসা শেষে নিয়মিত ফলোআপ অপরিহার্য। এখানে মনে রাখা জরুরি, বায়োপসি টিউমার ছড়ায় না এবং মাল্টিডিসিপ্লিনারি বোর্ডের মাধ্যমে সঠিক চিকিৎসার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।’
আরও কয়েক ধরনের বায়োমার্কার টেস্ট সম্পর্কে অধ্যাপক ডা. কাজী মুশতাক হোসেন বলেন, আগে শুধু ইআর, পিআর আর হারটু দেখা হতো। এখন কেআই-৬৭, বিআরসিএ১/২, পিএআরপি ইনহিবিটারসহ আরও অনেক টেস্ট করা হয়। এগুলো রোগীর থেরাপি ও ওষুধ নির্ধারণে সাহায্য করে। হারটু পজিটিভ হলে নির্দিষ্ট ওষুধ ব্যবহার করা যায়, নেগেটিভ হলে দেওয়া সম্ভব নয়।
রেডিয়েশন থেরাপি শেষ করার পর ক্যানসার পুরোপুরি ভালো হয়ে গেলে কি আবার হতে পারে? উত্তরে অধ্যাপক ডা. গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক বলেন, রেডিয়েশন দেওয়া মানে চিকিৎসা শেষ নয়। অনেক রোগীর ক্ষেত্রে হারটু, ইআর বা পিআর পজিটিভ থাকলে এন্ডোক্রাইন বা হরমোন থেরাপি চালিয়ে যেতে হয় ৫ থেকে ১০ বছর। এই সময়ে ক্যানসার আবারও ফিরে আসতে পারে। তাই ফলোআপ আজীবন গুরুত্বপূর্ণ।
পুরুষদের স্তন ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি প্রসঙ্গে অধ্যাপক ডা. কাজী মুশতাক হোসেন বলেন, সাধারণ ধারণার বিপরীতে, পুরুষেরাও স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হতে পারেন। যদিও এটি খুবই কম—প্রায় ১ শতাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়। আমাদের দেশে কিছু পুরুষ রোগীও আছেন। তবে ট্রিটমেন্ট প্রক্রিয়ায় কোনো পার্থক্য নেই। পুরুষ বা নারী—উভয় ক্ষেত্রেই একই ধরনের সার্জারি, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি ও হরমোন থেরাপি প্রযোজ্য। রোগের উৎস ও কারণ প্রায় একই—যা জেনেটিক বা অর্জিত হোক, তা চিকিৎসার ধরনে প্রভাব ফেলে না। যারা সঠিকভাবে চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাঁরা ভালোভাবে সুস্থ হচ্ছেন।
স্তন ক্যানসার নিয়ে সোশ্যাল স্টিগমা বা সামাজিক অপবাদগুলো সম্পর্কে অধ্যাপক ডা. গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক বলেন, ব্যথা না থাকলে গাঁট নেই ভেবে চিকিৎসা না নেওয়া, ক্যানসারকে পাপের ফল মনে করা ও সামাজিক বা পারিবারিক ভয়। এ কারণে কেবল চিকিৎসা দেওয়া যথেষ্ট নয়, রোগী ও পরিবারের সঙ্গে কাউন্সেলিং করা এবং সামাজিক কুসংস্কার ভাঙা খুব গুরুত্বপূর্ণ।