
ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে প্রায়ই তরুণদের দেখা যায় সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে ভুগতে। ফলে অনেক সময় যথেষ্ট মেধা, আগ্রহ ও দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও তাঁরা ক্যারিয়ারে ভালো করতে পারেন না। তরুণদের সঠিক দিকনির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা জোগাতে প্রথম আলো ডটকম ও প্রাইম ব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত পডকাস্ট শো: লিগ্যাসি উইথ এমআরএইচ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ রিদওয়ানুল হকের সঞ্চালনায় দশম পর্বে অতিথি হিসেবে অংশ নেন করপোরেট ব্যক্তিত্ব ও বিপণন বিশেষজ্ঞ সৈয়দ আলমগীর। আলোচনার বিষয় ছিল ‘উদ্ভাবন, নেতৃত্ব ও নৈতিকতা: আকাশচুম্বী উন্নয়নের পথে সৈয়দ আলমগীরের লিগ্যাসি’।
‘মার্কেটিং সেক্টরে কাজ করতে হলে সৃজনশীলতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই সঙ্গে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ ধরে রাখাও জরুরি।’ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে তরুণদের উদ্দেশে এ পরামর্শ দেন এবারের পডকাস্ট শো: লিগ্যাসি উইথ এমআরএইচের অতিথি সৈয়দ আলমগীর। পর্বটি গত শনিবার প্রচার হয় প্রথম আলোর ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতে।
বাংলাদেশে সত্তর থেকে আশির দশকে যখন সৈয়দ আলমগীর পেশাগত যাত্রা শুরু করেন, তখন মার্কেটিংয়ের ধারণাটি খুব একটা স্পষ্ট ছিল না। বিষয়টি উল্লেখ করে পডকাস্টের শুরুতেই সঞ্চালক জানতে চান, আপনি কীভাবে এই পেশায় এলেন?
উত্তরে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘ছাত্রজীবনে আমি সিভিল সার্ভেন্ট হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু স্বাধীনতার পর বুঝলাম সেটা আমার পথ নয়। পরে আইবিএতে ভর্তি হই। পড়াশোনা শেষ করে প্রথমে ব্রিটিশ ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে কাজ শুরু করি। সেখানেই আমার মার্কেটিংয়ে হাতেখড়ি।’
প্রসঙ্গক্রমে সঞ্চালক জানতে চান, বাংলাদেশে প্রথম আপনি ফার্মাসিউটিক্যাল মার্কেটিংয়ে ‘লোকাল প্রিন্টিং’য়ের ধারণা আনলেন। এটি কীভাবে সম্ভব হলো?
সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘সেই সময়ে ফার্মাসিউটিক্যালসে বিদেশ থেকে প্রিন্ট করে আনা হতো। আমি প্রমাণ করলাম বাংলাদেশেও একই মানের প্রিন্টিং সম্ভব। স্থানীয় প্রেসে প্রিন্ট করে তাদের দুটো স্যাম্পল পাঠাই এবং তাদের কপিটি আমার কাছে রেখে দিই। তারা চিনতেই পারেনি কোনটা আসল। ফার্মাসিউটিক্যালে দেশীয় প্রিন্টিং ব্যবহার করে বিদেশি কোম্পানির আস্থা অর্জন করি, যা প্রমাণ করে দেশেই ভালো কাজ সম্ভব।’
সৈয়দ আলমগীর আরও বলেন, ‘এরপর বড় কিছু করার উদ্দেশ্যে এবং একটি ভালো সুযোগ পেয়ে আমি এফএমসিজির দিকে যাই। যেখানে আগের বেতনের প্রায় ২৫০ শতাংশ বেশি প্রস্তাব পেয়েছিলাম। আমিই প্রথমবার স্থানীয়ভাবে “স্নিকার জুতা” চালু করি, যা আগে বাংলাদেশে ছিল না।’
আপনি বাংলাদেশে ‘হালাল সাবানে’র ধারণা এনেছেন—এই আইডিয়াটি মাথায় কীভাবে এল? জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘আমি সব সময় একটি শক্তিশালী ও আলাদা ইউএসপি তৈরি করতে চেয়েছি। অতীতে আমার ভালো পণ্য—যেমন শিশুদের দুধ “অস্টার মিল্ক” বা মানসম্মত সাবান—প্রত্যাশিত সাফল্য পায়নি, মূলত ভোক্তাদের, বিশেষ করে গৃহিণীদের ঐতিহ্য ও মান নিয়ে দ্বিধার কারণে।’
এ প্রসঙ্গে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ হিসেবে আমি ভেবে দেখলাম, একটি ভালো সাবানে কী থাকা উচিত—পর্যাপ্ত ফেনা, মনোরম ঘ্রাণ এবং দীর্ঘস্থায়ী ব্যবহারযোগ্যতা। ঠিক তখনই লন্ডনে একটি খাবারের দোকানে “হালাল” লেখা দেখেই আমার মাথায় আসে, যদি সাবান সম্পূর্ণ ভেজিটেবল ফ্যাট থেকে তৈরি হয়, তবে সেটি শতভাগ হালাল সাবান হতে পারে। এ ধারণাটিই আমি দেখি ভোক্তাদের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনের এক অভিনব উপায় হিসেবে।’
এরপর আপনিই প্রথম ‘শুদ্ধ লবণে’র কনসেপ্ট নিয়ে এলেন। এই ‘সাদা লবণ’ বা ‘বিশুদ্ধ লবণ’–এর ধারণা কীভাবে এল এবং দাম বেশি হওয়া সত্ত্বেও এটি কীভাবে সফল হলো? সঞ্চালকের এমন প্রশ্নের উত্তরে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘বিদেশে গিয়ে দেখি “ময়েশ্চার-ফ্রি” পরিষ্কার লবণ। দেশে এনে চেষ্টা করলাম একই ধরনের বানাতে। প্রথমে লস হয়, দাম বেশি ছিল বলে কেউ কিনছিল না। পরে “এসিআই লবণ মেধা বিকাশে সাহায্য করে” এই ধারণা দিই। এবং সেটাই গেমচেঞ্জার হয়ে যায়।’
তাহলে মার্কেটিং পেশায় ক্রিয়েটিভ হওয়া কতটা গুরুত্বপূর্ণ? সঞ্চালক জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘এই পেশায় ক্রিয়েটিভিটি হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শুধু বিজ্ঞাপনী সংস্থার ওপর নির্ভর করলে চলবে না। দেশের মানুষ কী চায়, তা বুঝতে হবে এবং বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্য জিনিস তুলে ধরতে হবে।’
অনেকেই বলে, মার্কেটিংয়ে নৈতিকতা রক্ষা করা কঠিন। আপনি কীভাবে এটা মেনটেইন করেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘আমি সব সময় নৈতিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী। হালাল সাবান করার সময় সবাই মানা করেছিল, তবু করেছিলাম। আমি কখনো ওপর থেকে ডিক্টেশন নিইনি। এ জন্য আমি দেশে-বিদেশে নানা সম্মানও পেয়েছি।’
বাংলাদেশে মার্কেটিং পেশায় এখনো মেয়েদের অংশগ্রহণ তুলনামূলকভাবে কম। কীভাবে এটা বাড়ানো যায়—এ প্রসঙ্গে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘আমি আমার দিক থেকে সব সময় মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়াতে চেয়েছি। যেখানে দরকার রিক্রুটমেন্টে বলেছি, অন্তত ৫০ শতাংশ নারী থাকতে হবে। মেয়েরা এখন অনেক এগিয়েছে—ডিসি, প্রতিষ্ঠানের এমডি পর্যন্ত হয়েছে। তাঁদের আরও সাহসী হতে হবে, নিজের সিকিউরিটি নিজেরাই তৈরি করতে হবে।’
এরপর সঞ্চালক বলেন, ব্র্যান্ড ম্যানেজার ও ক্রিয়েটিভ এজেন্সির মধ্যে প্রায়ই দূরত্ব দেখা যায়। এ ছাড়া বাংলাদেশে ব্র্যান্ডগুলোর গবেষণায় ঘাটতি আছে—আপনি এটা কীভাবে দেখেন?
উত্তরে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘গবেষণা খুব জরুরি। কিন্তু আমাদের মার্কেট ছোট এবং সুরক্ষিত না। আপনি নতুন কিছু আনলে অন্যরা নকল করে। যেমন আমি হালাল সাবান বলার পর ১০০টা হালাল সাবান বেরিয়ে গেছে। তবু আমাদের নিজের ক্রিয়েটিভিটি ধরে রাখতে হবে।’
প্রসঙ্গক্রমে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি—যারা মিথ্যা বলে, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেয়, তারা বাজারে বেশি দিন টিকতে পারে না।’
আকিজ ভেঞ্চারে আপনি যেভাবে কাজের নতুন সংস্কৃতি আনলেন—সপ্তাহে দুই দিন ছুটি, ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালান্স—এটা কীভাবে সম্ভব করলেন? সঞ্চালকের প্রশ্নের উত্তরে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘এই ওয়ার্ক-লাইফ-ব্যালান্স খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি ওই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানকে বলেছিলাম দুই দিন ছুটি দিলে প্রোডাক্টিভিটি বাড়বে। তিনি রাজি হলেন। আজও তারা সেই সিস্টেমে কাজ করছে। দারুণ ফল পাচ্ছে।’
আলোচনার শেষ পর্যায়ে সৈয়দ আলমগীর তরুণদের উদ্দেশে বলেন, ‘মার্কেটিং প্রফেশনে সফল হতে হলে কোনো কিছু হালকাভাবে নেওয়া যাবে না। নিজের বুদ্ধি, গবেষণা আর নৈতিকতা—এই তিনটিই সফলতার মূল।’