একজন মানুষ যখন অন্য মানুষকে হত্যা করে, তাকে আইনের ভাষায় ‘নরহত্যা’ বলা হয়। পৃথিবীর সব আইনে নরহত্যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশের আইনও তার ব্যতিক্রম নয়, কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে এ নরহত্যা আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ নয়। আইনের সাধারণ নিয়ম হচ্ছে, যেসব কাজ শাস্তিযোগ্য বলে আইনে স্বীকৃত হবে, সেই সব কাজ শুধু অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। এর বাইরের অন্য কোনো কাজ অপরাধ বলে বিবেচিত হবে না। যেসব ব্যক্তি ‘অপরাধমূলক মন’ নিয়ে অপরাধে অংশগ্রহণ করবে, তাদের বলা হবে ‘অপরাধী’।
‘অপরাধমূলক মন’ অপরাধ আইনে খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অপরাধমূলক মন বা অপরাধমূলক ইচ্ছা ছাড়া কোনো কাজ অপরাধ বলে আইনে স্বীকৃত হয় না। তত্ত্বগত এ ধারণার বাস্তবিক রূপ হিসেবে বাংলাদেশের মানুষের জন্য কোন কাজগুলো অপরাধ বলে বিবেচিত হবে এবং সেসব অপরাধের সংজ্ঞা কী হবে, সেই সঙ্গে পরিবেশ পরিস্থিতির বিবেচনায় শাস্তি কেমন হবে—এ সবকিছুর সাধারণ আলোচনা করা হয়েছে বাংলাদেশে বর্তমান বলবৎ ‘দণ্ডবিধি’ আইনে। যেখানে নরহত্যাকে কিছু ক্ষেত্রে বৈধ বলা হয়েছে, কিছু ক্ষেত্রে শুধু দণ্ডনীয় অপরাধ বলা হয়েছে এবং কিছু ক্ষেত্রে সরাসরি খুন বলে আখ্যায়িত করে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা হয়েছে। কোন পরিস্থিতিতে একজন মানুষকে হত্যা করলেও ‘হত্যাকারী’কে শাস্তি পেতে হয় না, আইনের আলোকে তা ব্যাখ্যা করা হলো।
বাংলাদেশের বর্তমান দণ্ডবিধি আইনের চতুর্থ অধ্যায়ে ‘রাইট অব প্রাইভেট ডিফেন্স (ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষার অধিকার)’ উপ-শিরোনামে যে সব ধারা সন্নিবেশিত আছে, তার মধ্যে ধারা-১০০ এবং ১০৩ পর্যালোচনায় দেখা যায়, একজন ব্যক্তি ১০টি কারণে নরহত্যা সংঘটন করতে পারে, যার জন্য নরহত্যা সংঘটনকারী ব্যক্তিকে কোনো প্রকার শাস্তি পেতে হয় না। কারণগুলো হচ্ছে—
১. নিহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে: কোন ব্যক্তি যদি এমন কোনো আক্রমণ করে যে আক্রমণের জন্য মৃত্যু অনিবার্য, সেই আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য আক্রমণকারীর মৃত্যু ঘটালে তা অপরাধ হবে না।
২. গুরুতর আহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে: এমন কোনো আক্রমণ, যা প্রতিহত না করলে গুরুতর আহত হওয়ার আশঙ্কা আছে, তাহলে সেই ক্ষেত্রে আক্রমণকারীর মৃত্যু ঘটালে তা অপরাধ বলে বিবেচিত হবে না।
৩.ধর্ষণ: ধর্ষিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে ধর্ষণ প্রতিরোধ করার জন্য ধর্ষণের চেষ্টাকারীকে হত্যা করা আইনবলে স্বীকৃত। ধর্ষণ প্রতিরোধে হত্যা সংঘটন করা অপরাধ বলে বিবেচিত হবে না।
৪.অস্বাভাবিক কামলালসা থেকে বাঁচার জন্য: কোনো নারী বা পুরুষকে অপ্রাকৃতিক কামলালসার শিকার করার উদ্দেশ্যে আক্রমণ করা হলে আক্রমণ প্রতিরোধে আক্রমণকারীর মৃত্যু ঘটানো যাবে, যা অপরাধ হবে না।
৫. অপহৃত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে: অপহৃত হওয়ার সময় অপহরণ প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে অপহরণকারীর মৃত্যু ঘটালে তা অপরাধ হবে না।
৬. অবৈধ আটক থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য হত্যা সংঘটন করলে: যখন কোন ব্যক্তিকে অবৈধভাবে আটক করার জন্য আক্রমণ করা হয়, সেই সময় আটক ব্যক্তির যদি যুক্তিসংগতভাবে মনে হয় যে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে সরকারি কর্তৃপক্ষের সহায়তা পাবেন না, তবে সেই ক্ষেত্রে অবৈধ আটকের উদ্দেশ্যে আক্রমণকারীর মৃত্যু ঘটানো অপরাধ বলে বিবেচিত হবে না।
৭. সম্পত্তির ওপর দস্যুতা প্রতিরোধে: সম্পত্তির ওপর দস্যুতাকারীর আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য দস্যুতাকারীর মৃত্যু ঘটানো অপরাধ বলে বিবেচিত হবে না।
৮. রাতে ঘর ভেঙে অনুপ্রবেশকারীর হাত থেকে সম্পদ রক্ষার্থে: রাতে দরজা-জানালা ভেঙে বা সিঁধ কেটে অনুপ্রবেশকারীর হাত থেকে সম্পদ রক্ষার জন্য অনুপ্রবেশকারীর মৃত্যু ঘটানো অপরাধ নয়।
৯. সম্পদের ওপর অগ্নিসংযোগ প্রতিরোধে: সম্পদ বা সম্পত্তির ওপর যদি অগ্নিসংযোগের চেষ্টা করা হয়, তাহলে তা প্রতিহত করার জন্য অগ্নিসংযোগকারীর মৃত্যু ঘটানো যাবে।
১০. চুরি, ক্ষতি বা অনধিকার গৃহ প্রবেশ প্রতিরোধে: সম্পদ চুরি, সম্পদের ক্ষতি বা সম্পদ রক্ষায় অনধিকার গৃহ প্রবেশ প্রতিরোধে যদি কারও মৃত্যু বা গুরুতর জখম হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে মৃত্যু ঘটানো যাবে।
দণ্ডবিধিতে অপরাধ নয়, এমন নরহত্যা সংঘটনের পরিধি সম্পর্কে ৯৭ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষার অধিকার কেবল নিজের জন্য প্রযোজ্য নয়, বরং সবার জন্য প্রযোজ্য হয়। অর্থাৎ, নিজের দেহ ও সম্পদ এবং সেই সঙ্গে অপরের দেহ ও সম্পদ রক্ষার্থে ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষার অধিকার প্রয়োগ করা যায়। দণ্ডবিধির ১০১ এবং ১০৪ ধারা পর্যালোচনায় আরও দেখা যায়, ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষার অধিকার প্রয়োগে শুধু মৃত্যু নয়, অন্য কোনো প্রকার ক্ষতি সাধিত হলেও তা অপরাধ বলে বিবেচিত হবে না। দণ্ডবিধির ধারা-১০৬ অনুসারে আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য যদি প্রতি-আক্রমণের প্রয়োজন হয় এবং এ কারণে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তির মৃত্যু বা অন্য কোনো প্রকার ক্ষতি সাধিত হয়, তা-ও আইনের চোখে অপরাধ বলে বিবেচিত হবে না।
উল্লেখিত ১০টি ক্ষেত্র ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষার অধিকারের প্রয়োগ দেখিয়ে নরহত্যা সংঘটন করা বা কারও মৃত্যু ঘটালে আইনে স্পষ্ট দণ্ডনীয় অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। আবার দণ্ডবিধির ধারা-৯৯ অনুসারে সরকারি কর্মকর্তা বা সরকারি কর্মকর্তার নির্দেশক্রমে কোনো ব্যক্তি যখন আইনানুগ কাজ সম্পাদন করে, সেই ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত আত্মরক্ষার প্রয়োগ দেখিয়ে হত্যা সংঘটন দণ্ডনীয় অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। যেকোনো প্রকার আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য যদি আইনের আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ থাকে, তবে সে ক্ষেত্রেও ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষার অধিকার প্রয়োগ দেখিয়ে হত্যা সংঘটন দণ্ডনীয় অপরাধ হবে। ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষার মূলনীতি হচ্ছে, আক্রমণ যতটুকু প্রতিরোধ হবে, ততটুকু। কোনোভাবেই আক্রমণের সীমা অতিক্রম করে প্রতি-আক্রমণ করা যাবে না।
ফৌজদারি অপরাধ প্রমাণে আদালতের মূলনীতি হচ্ছে, যতক্ষণ পর্যন্ত দোষী প্রমাণিত না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত নির্দোষ ধরে নিতে হবে। সাক্ষ্য আইন অনুসারে কোনো ব্যক্তিকে দোষী প্রমাণের ভার সব সময় অভিযোগকারীর ওপর বর্তায়। তবে ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষায় ক্ষতি সংঘটিত হয়েছে, এমন অজুহাত প্রমাণের ক্ষেত্রে সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২-এর ১০৫ ধারা অনুসারে প্রমাণের ভার অজুহাত উত্থাপনকারী ব্যক্তির ওপর বর্তাবে। অর্থাৎ, যিনি দাবি করছেন, তিনি ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষার অধিকার প্রয়োগ করে হত্যা বা ক্ষতি সংঘটন করেছেন, তাকেই প্রমাণ করতে হবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি আক্রমণ করেছিলেন এবং তিনি ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষার অধিকার প্রয়োগ করেছেন।
আইনের সৌন্দর্য আইনের মধ্যে নয়, আইনের সৌন্দর্য থাকে আইনের ব্যাখ্যায়। কোনো আক্রমণকারী যখন কারও ওপর আক্রমণ চালান, তখন আইন তাঁকে নির্বিকারভাবে সবকিছু মেনে নিতে বলেন না। আইনের নির্দেশনা হলো, আক্রমণকারীকে রুখবার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু করতে, এমনকি আক্রমণ ঠেকানোর জন্য প্রয়োজনমতো প্রতি-আক্রমণ করে আক্রমণকারীর ক্ষতি সাধনও করা যায়। নির্বিঘ্নে জীবনযাপন মানুষের জন্মগত, আইনগত এবং সাংবিধানিক অধিকার। নির্বিঘ্নে জীবনযাপনের জন্য পরিবেশ-পরিস্থিতির বিবেচনায় আইনানুগ এবং আইনবহির্ভূত কাজ সম্পর্কে আমাদের স্পষ্ট ধারণা রাখা উচিত।
মো. সাজিদুর রহমান আইনজীবী