ফিরে দেখা

থ্রিলারকে হার মানানো বিমান ছিনতাইয়ের সেই রুদ্ধশ্বাস সাত দিনের যত ঘটনা

টালমাটাল একসময়ে জাপানের একটি বিমান ছিনতাই করে জোর করে ঢাকায় নিয়ে এসেছিল জাপানিজ রেড আর্মি। এক সপ্তাহ ধরে দর-কষাকষির পরে নাটকীয়ভাবে সেই ঘটনার অবসান হয়েছিল। এর মধ্যেই বাংলাদেশে ঘটে আরেক নাটকীয় ঘটনা। এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা চলে। এতে প্রাণহানি ঘটে ব্যাপক। ফাঁসি দেওয়া হয় অসংখ্য নানা স্তরের সৈনিককে। সেই ঘটনার প্রভাবে অবসরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন তৎকালীন বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ জি মাহমুদকে।

ঘটনার শুরু

২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭৭, বুধবার। জাপানের স্থানীয় সময় বেলা পৌনে ১১টা। ভারতের বোম্বে (বর্তমানে মুম্বাই) বিমানবন্দর ছাড়ার পর আকাশে ১১ হাজার ফুট উচ্চতায় জাপান এয়ারলাইনসের (জাল) বিমানটির ক্যাপ্টেন সাংকেতিক বার্তা পাঠিয়ে জানান যে তাঁদের উড়োজাহাজটি ছিনতাই করা হয়েছে। ফ্লাইট নম্বর ৪৭২-এর ডিসি ৮ বিমানটি প্যারিস থেকে মুম্বাই হয়ে ব্যাংককে যাচ্ছিল। বিমানের আরোহী ছিলেন ক্যাপ্টেন শিল্পেও তাকাহাশিসহ ১৪ জন ক্রু এবং ১৩৭ জন যাত্রী। মোট ১৫১ জন।
১১টা বেজে ৭ মিনিটে বোম্বেতে জালের অফিসের কর্মীরা বিমান এবং বোম্বে বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ টাওয়ারের মধ্যে বেতার সংকেত শুনতে পান। সেই কথোপকথনের মধ্যে জাপানিজ রেড আর্মি (জাপানি লাল ফৌজ) শব্দটা তাঁদের কানে আসে।

বিমানটি বোম্বে বিমানবন্দর থেকে রওনা হওয়ার ১২ মিনিট পর ‘ফ্যাসন ইয়োর সিটবেল্ট’ সংকেতটি নিভে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই ঘটনাটা ঘটে।
জাপানি সময় অনুযায়ী ২৮ সেপ্টেম্বর বেলা দেড়টায় (বাংলাদেশ সময় একই দিন সকাল সাড়ে ১০টায়) বিমানটি ঢাকা বিমানবন্দরের ওপরে আকাশে পৌঁছায়। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অবতরণের অনুমতি না পাওয়ায় বিমানটি প্রায় এক ঘণ্টা ধরে আকাশে চক্কর দেয়। তারপর স্থানীয় সময় ১১টা ৩১ মিনিটে নিয়ন্ত্রণ টাওয়ারের আদেশ উপেক্ষা করে বিমানবন্দরে নেমে আসে। রানওয়ের দক্ষিণ প্রান্তে বিমানটি থামিয়ে দেওয়ার পর জঙ্গিরা নিয়ন্ত্রণ টাওয়ারকে বেতারের মাধ্যমে জানিয়ে দেয় যে তারা জাপানি লাল ফৌজের সদস্য। জাপান সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালানোর উদ্দেশ্যে বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটিয়েছে।

বাংলাদেশ সরকার সঙ্গে সঙ্গে বিমানবন্দর বন্ধ করে ছিনতাই করা বিমানের আশপাশে পুলিশ ও সশস্ত্র বাহিনীর কয়েক শ সেনা মোতায়েন করে।

১৯৭৭ সালের ২৯ সেপ্টেম্বরের দৈনিক ইত্তেফাক

দুপুর সাড়ে ১২টায় ছিনতাইকারীরা নিরাপত্তা বাহিনীকে এই বলে সাবধান করে দেয় যে বিমানের ২০০ গজের মধ্যে কেউ প্রবেশ করলে সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীদের গুলি করে হত্যা করা হবে। আরও হুমকি দেওয়া হলো, বোমা মেরে বিমানটি উড়িয়ে দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে তারা বিমানের ইঞ্জিন স্টার্টারের ব্যাটারিতে বিদ্যুৎ চার্জ করা, বিমানের এয়ার কন্ডিশনার চালানোর জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ করা এবং খাবার ও পানীয় পৌঁছে দেওয়ার দাবি জানায়।

বেলা দেড়টা। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ জি মাহমুদ বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ টাওয়ার থেকে ছিনতাইকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করলেন। তাদের কথাবার্তার সবকিছু ঢাকায় অবস্থিত জাপানি দূতাবাসের মাধ্যমে টোকিওর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জানিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

ছিনতাইকারী কারা

জাপানের বামপন্থী গোষ্ঠী জাপানিজ রেড আর্মি এই বিমানটিকে ছিনতাই করেছিল। ছিনতাইয়ের সময় তারা আসল পরিচয় লুকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে একে অন্যকে ১০ নম্বর, ২০ নম্বর, ৩০ নম্বর, ৪০ নম্বর ও ৫০ নম্বরের মতো ছদ্মনামে ডাকত। মাঝেমধ্যে ২৫ ও ৩৫-এর মতো নম্বরও ব্যবহার করা হয়েছে।

১৯৭১ সালে ফুসাকো শিগেনোবু নামের এক তরুণী জাপানে মার্ক্সবাদী ছাত্র আন্দোলন থেকে উঠে এসে জাপানিজ রেড আর্মি বা জেআরএ সংগঠনটি গড়ে তোলেন। আদর্শগতভাবে তারা ছিল চরমপন্থী মার্ক্সবাদী, যারা মনে করত জাপানে রাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদকে ধ্বংস করে বৈশ্বিক বিপ্লব ছড়িয়ে দিতে হবে। জাপানিজ রেড আর্মির ইতিহাস শুরু হয় ১৯৭০ সালের ৩১ মার্চ এক নাটকীয় ছিনতাইয়ের মধ্য দিয়ে। জাপান এয়ার লাইনসের টোকিও-ফুকুওকা অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটটি তারা ছিনতাই করে উত্তর কোরিয়ায় নিয়ে যায়। এই ঘটনা ‘ইয়োদোগো হাইজ্যাক’ নামে পরিচিত হয়। যাত্রীরা মুক্তি পেলেও ছিনতাইকারীরা উত্তর কোরিয়ায় আশ্রয় পায় এবং সেখানেই দীর্ঘ সময় অবস্থান করে। এটিই ছিল জাপানের প্রথম বড় বিমান ছিনতাই এবং এখান থেকেই জেআরএর নাম ছড়িয়ে পড়ে।

এরপর ১৯৭২ সালের ৩০ মে ইসরায়েলের বিমানবন্দরে তারা চালায় ভয়াবহ হামলা। তিনজন জেআরএ সদস্য মেশিনগান ও গ্রেনেড নিয়ে যাত্রীদের ওপর নির্বিচার হামলা চালায়। এতে ২৬ জন নিহত হয়, আহত হয় ৮০ জনের বেশি। হামলাকারী দুজন ঘটনাস্থলেই মারা যায়, একজন ধরা পড়ে।

১৯৭৩ সালের ২০ জুলাই তারা আবারও ছিনতাইয়ে নামে। এবার লক্ষ্য ছিল জাপান এয়ারলাইনসের ফ্লাইট ৪০৪। আমস্টারডাম থেকে টোকিওগামী এই বিমানটি জেআরএ এবং প্যালেস্টাইন মুক্তি ফ্রন্ট যৌথভাবে ছিনতাই করে লিবিয়ায় নিয়ে যায়। যাত্রীরা পরে মুক্তি পায়।

জাপানিজ রেড আর্মির প্রতিষ্ঠাতা ফুসাকো শিগেনোবু

১৯৭৪ সালে নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে ফরাসি দূতাবাসে প্রবেশ করে জেআরএ সদস্যরা। তারা কূটনীতিকদের জিম্মি করে দাবি জানায় জাপান ও ফ্রান্সে আটক তাদের সদস্যদের মুক্তি দিতে। শেষ পর্যন্ত জিম্মি বিনিময় হয় এবং ছিনতাইকারীরা সিরিয়ায় পালিয়ে যায়। ১৯৭৫ সালে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে তারা মার্কিন ও সুইডিশ দূতাবাসে হামলা চালায়। কয়েকজন কূটনীতিককে জিম্মি করা হয় এবং আবারও জাপান সরকারের হাতে আটক জেআরএ সদস্যদের মুক্তি দাবি করা হয়। সরকারের নতি স্বীকারের ফলে তাদের দাবি পূরণ হয়।

১৯৭৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর বিমান ছিনতাই করে ঢাকায় আনা হয়। একই বছর তারা আরও একটি ছিনতাই চালায়। এবার জার্মানির লুফথানসা ফ্লাইট ৬০৪ সিঙ্গাপুর থেকে উড্ডয়ন করার পর ছিনতাইয়ের কবলে পড়ে। এটি মূলত মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত যাত্রীরা মুক্তি পেয়েছিল।

১৯৮০-এর দশক থেকে ধীরে ধীরে সংগঠনের শক্তি ক্ষয় হতে থাকে। একে একে বহু সদস্য গ্রেপ্তার হয়। প্রতিষ্ঠাতা ফুসাকো শিগেনোবু ২০০০ সালে ধরা পড়েন এবং দীর্ঘ কারাবাসের পর ২০২২ সালে মুক্তি পান। ২০০১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে সংগঠনটির অবসান ঘোষণা করা হয়।

ছিনতাইকারীদের দাবি

সে সময় ছিনতাইকারীদের সঙ্গে দর-কষাকষি করতে ঢাকায় এসেছিল জাপানের একটি প্রতিনিধিদল। তার নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন পরিবহন প্রতিমন্ত্রী হাজিমে ইশিই। তিনি এ নিয়ে একটি বই লিখেছেন। বইটি বাংলায় অনূদিত হয়ে প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন। বইটির নাম: ‘ঢাকায় জাপানি বিমান ছিনতাই ১৯৭৭: জাপানি মন্ত্রীর স্মৃতিকথা’।

হাজিমে ইশিই লিখেছেন, ‘জাপানের সময় সন্ধ্যা ৬টা ১৯ মিনিটে ভারতের বার্তা প্রতিষ্ঠান ইউপিআই জানায় যে জঙ্গিরা জাপানে জেলে আটক জাপানি লাল ফৌজের পাঁচজন সদস্যকে মুক্ত করার দাবি জানাচ্ছে। এই দাবি মানা না হলে ছিনতাই করা বিমানে বিস্ফোরণ ঘটাবে বলে তারা নাকি বাংলাদেশ সরকারকে জানিয়েও দিয়েছে।

রাত নয়টায় বৈরুতে জাপানি লাল ফৌজের প্রচারিত বিবৃতিতে ঘোষণা করা হয় যে তাদের ঢাকা-কমান্ডো গ্রুপের হাতে এবারের বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটানো হয়েছে। এই বিবৃতিতে ৮০ হাজার পাউন্ডের পেট্রল সরবরাহের দাবি করা হয়। এ ছাড়া টোকিওর কয়েকটি জাপানি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ঢাকায় অবস্থিত তাদের শাখা অফিসের কাছ থেকে এ রকম অনিশ্চিত খবর আসতে শুরু করে যে জঙ্গিরা ৬ অথবা ৬০ লাখ ডলারের মুক্তিপণ দাবি করছে। এর আগে টোকিওতে মন্ত্রিপরিষদ দপ্তরের কর্মকর্তারা ছিনতাইকারীদের কাছ থেকে কী ধরনের দাবি আসতে পারে, সে কথা ভেবে অস্বস্তিকর সময় কাটাচ্ছিলেন। এবার বাস্তব দাবির মুখে পড়ে তাঁদের উত্তেজনা হঠাৎ আরও বেড়ে যায়।

ঢাকায় জাপানি বিমান ডিসি–৪

এরপর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং একটি প্রধান ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান মারুবেনির সদর দপ্তরের মাধ্যমে ঢাকা থেকে এমন খবর পাওয়া যায় যে জঙ্গিরা জাপানে কারারুদ্ধ ১০ জন কমরেডের মুক্তি ও ৬০ লাখ ডলারের মুক্তিপণ দাবি করছে। জাপানের স্থানীয় সময় ২৯ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে জঙ্গিরা এয়ার ভাইস মার্শাল মাহমুদের মাধ্যমে জাপান সরকারের প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে জাপানে জেলবন্দী জাপানি লাল ফৌজের পদস্থ কর্মী জুনযো ওকুদাইরাসহ সাতজন উগ্রপন্থী ও দুজন খুনির মুক্তি, সেই সঙ্গে ৬০ লাখ মার্কিন ডলারের মুক্তিপণের দাবি জানায়। তারা জোর দিয়ে বলে, ২৯ তারিখ রাত তিনটার মধ্যে সরকারকে অবশ্যই উত্তর দিতে হবে। তারা এই হুমকিও দেয় যে এই সময়সীমা পার হয়ে গেলে তারা জিম্মিদের এক এক করে হত্যা করবে। প্রথমে যাঁকে মেরে ফেলা হবে, তাঁর নামও ঘোষণা করা হয়। তিনি হলেন জন গাব্রিয়েল। এই মার্কিন নাগরিক নাকি প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের ব্যক্তিগত বন্ধু।’

প্রথম খাবার সরবরাহ

ঘটনা ঘটে যাওয়ার পুরো এক দিন পর ঢাকায় ২৯ তারিখ সকালে (বাংলাদেশের স্থানীয় সময়) ছিনতাই করা বিমানে প্রথমবারের মতো বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে খাবার পৌঁছে দেওয়া হয়। বিমানের প্রত্যেক আরোহীর জন্য একটি করে লাঞ্চ বাক্স দেওয়া হয়। পানির অভাবের কারণে কাগজের গ্লাসে তিন ভাগের এক ভাগ ভরে পানি দেওয়া হয় একেকজনকে।

ছিনতাইকারীরা কিন্তু খাবারে হাত দেয়নি। তারা বিমানে চড়ে আসার সময় যে বিস্কুট নিয়ে এসেছিল, শুধু তা-ই খেয়ে খিদে মেটায়। এমনকি গ্লাসে ভরা পানির ৮০ শতাংশ যাত্রীদের খেতে দিয়ে অবশিষ্ট পানি দিয়ে তারা গলা ভিজিয়ে নেয়। খাবার ও পানির মধ্যে ঘুমের ওষুধ মেশানো হতে পারে, সে কথা ভেবে এত সতর্কতা।

টোকিওতে বেলা সাড়ে ১১টায় জাপান সরকার ঘোষণা দিয়ে জানায় যে নয়জন কারাবন্দীকে মুক্তি ও মুক্তিপণ প্রদানে সরকার নীতিগতভাবে রাজি হয়েছে। এই ঘোষণা শুনে ছিনতাইকারীরা বিবৃতি দিয়ে জানিয়ে দেয় যে ১৮ ঘণ্টার মধ্যে তাদের হাতে টাকা তুলে দিতে হবে। তাদের কমরেডদের কারাগার থেকে ছেড়ে দিতে হবে। তারা এই দাবি জানিয়ে বলে, ‘এটাই অন্তিম ঘোষণা। এটা মেনে নেওয়া না হলে জিম্মিদের একের পর এক মেরে ফেলা হবে।’

দুপুর পৌনে ১২টায় পাঁচজন জিম্মিকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তাঁদের মধ্যে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক কার্ট ক্রুগার, যাঁর হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল।

বাংলাদেশের নীতি ও দর-কষাকষি শুরু

বাংলাদেশ সরকারের নীতি ছিল রক্তপাত এড়িয়ে নিজের হাতে এই ঘটনার আশু নিষ্পত্তি করা। এর আগে জাপান সরকার গোপনে বাংলাদেশ সরকারের কাছে প্রস্তাব দিয়েছিল যে জাপান থেকে সন্ত্রাস দমনের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী পাঠানোর অনুমতি যেন দেওয়া হয়। বাংলাদেশ সরকার অবশ্য সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে জানায় যে জাপান থেকে কোনো ধরনের অস্ত্র বাংলাদেশে আনা যাবে না।

পরিবহন প্রতিমন্ত্রী হাজিমে ইশিই এ নিয়ে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ সরকার কেন এমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল? আমি এখন অনুমান করি, এর পেছনে তিনটি বিষয় কাজ করেছে। প্রথমত, ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হওয়া নবীন দেশ বাংলাদেশের পক্ষে এই বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনাকে নিজের হাতে অল্প সময়ের মধ্যে রক্তপাত ছাড়াই সমাধান করে দেওয়া ছিল আন্তর্জাতিক সমাজে দেশটির মর্যাদা বাড়ানোর এক সুযোগ। সেই সঙ্গে দেশটির অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি এখনো অস্থিতিশীল হওয়ায় ঘটনাটির আশু নিষ্পত্তি বাংলাদেশের জন্য জরুরি ছিল।

১৯৭৭ সালের ১ অক্টোবরের দৈনিক বাংলা

দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র ও ইন্দোনেশিয়ার সরকারের কাছ থেকে বাংলাদেশকে ‘আশু ও রক্তপাতবিহীন সমাধান’-এর জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছিল বলে অনুমান করা হয়। এই চাপের কারণ ছিল বিমানে আটক যাত্রীদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মি. জন গাব্রিয়েল এবং কারাবিয়ান দম্পতি, সেই সঙ্গে ইন্দোনেশিয়ার কার্দোনো দম্পতি অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
ছিনতাইকারীরা পণবন্দীদের মধ্যে সবার আগে মি. গাব্রিয়েলকে হত্যা করার হুমকি দিয়েছিল। তিনি সেই সময় ছিলেন ক্যালিফোর্নিয়ার গারফিল্ড ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট। জঙ্গিরা তাঁর পাসপোর্ট দেখে বুঝতে পেরেছিল যে তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব।

গণমাধ্যমে জানানো হয়েছিল, তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তবে পরে জানা গেল, মি. গাব্রিয়েলের চেয়ে বরং মি. কারাবিয়ান প্রেসিডেন্ট কার্টারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। মি. ওয়াল্টার কারাবিয়ান একজন আইনজীবী। তিনি বহুদিন ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের আইনসভার সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন। এই ঢাকার ঘটনার সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৪১ বছর। তিনি ভ্রমণ করছিলেন স্ত্রী কারোলের সঙ্গে। মার্কিন সরকার মি. কারাবিয়ানকে উদ্ধার করার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালিয়েছিল।

এদিকে ইন্দোনেশীয় নাগরিক মি. কার্দোনো ছিলেন সে দেশের বিমান পরিবহন বিভাগের মহাপরিচালক। ইন্দোনেশিয়া সরকার ২৯ সেপ্টেম্বরের পর ১ অক্টোবরও জাপান সরকারকে মি. কার্দোনোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অনুরোধ জানায়।’
তৃতীয় কারণ ছিল ছিনতাইকারীরা জাপান সরকারের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা প্রত্যাখ্যান করে কেবল বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল। ২৯ সেপ্টেম্বর রাত পৌনে নয়টায় জাপান সরকারের জোরালো অনুরোধে বাংলাদেশ সরকার জাপানি রাষ্ট্রদূত ইয়োশিওকাকে একবার জঙ্গিদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার সুযোগ দিলেও তাতে কোনো ফল হয়নি।

রাত ৯টা ২০ মিনিট থেকে এয়ার ভাইস মার্শাল মাহমুদের সঙ্গে আলোচনা আবার শুরু হয়। ছিনতাইকারীরা জানতে চেয়েছিল তাদের দাবি মেটানোর ব্যাপারে জাপান সরকার কী রকম প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা জানিয়ে দেয়, জাপান সরকার যদি সময়সীমা লঙ্ঘন করে, তবে জিম্মিদের মেরে ফেলা হবে।

‘ঢাকায় জাপানি বিমান ছিনতাই ১৯৭৭: জাপানি মন্ত্রীর স্মৃতিকথা’।

ঢাকায় এল জাপানি প্রতিনিধিদল

পয়লা অক্টোবর সকালে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে জাপানের সরকারি প্রতিনিধিদল। ওই দলে ছিলেন ৩৯ জন। এ ছাড়া জাপান এয়ারলাইনস থেকেও ২৯ জনের একটি দল ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেয়।

হাজিমে ইশিই যে বিমানে করে ঢাকায় আসছিলেন তাতে নেওয়া হয়েছিল ৬ জন কয়েদিকে। রেড আর্মি যে মুক্তিপণ দাবি করেছে, সেটা মেটাতে নগদ টাকায় ৬০ লাখ ডলারও তিনটি বস্তায় করে তোলা হয় বিমানের ভেতরে।

জাপানি প্রতিনিধিদলকে সঙ্গে নিয়ে বিমানটি ঢাকায় অবতরণ করে ১ অক্টোবর। এই বিমানটির পাশেই ছিল ছিনতাই হওয়া বিমানটি।

জাপানি মন্ত্রী হাজিমে ইশিই

হাজিমে ইশিই লিখেছেন, জাপান সরকারের প্রতিনিধিদল ঢাকায় যাচ্ছে এই খবর পেয়েই জঙ্গিরা আলোচনায় আরও বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। তখন মি. মাহমুদের সঙ্গে জঙ্গিদের যোগাযোগের মাত্রা দ্রুত বেড়ে যেতে থাকে।

হাজিমে ইশিইর সঙ্গে যখন এ জি মাহমুদের পরিচয় হয় তখন তিনি নিয়ন্ত্রণ টাওয়ার থেকে ছিনতাইকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করছিলেন। এ জি মাহমুদ সম্পর্কে হাজিমে ইশিই লিখেছেন, ‘গত তিন দিন নাকি একদম না ঘুমিয়ে জঙ্গিদের সঙ্গে বেতার যোগাযোগ চালাচ্ছেন। কিন্তু তার ওপর ক্লান্তির কোনো রকম ছায়া পড়েনি।’

হাজিমে ইশিইর উপস্থিতিতে এ জি মাহমুদ ছিনতাইকারীদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় তাদের মধ্যে ৫২ থেকে ৫৩ জন জিম্মিকে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে কথাবার্তা হয়। কিন্তু এ জি মাহমুদ আরও বেশিসংখ্যক যাত্রীকে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ জানাতে থাকেন। কিন্তু জঙ্গিরা তাতে কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। কিন্তু ধীরে ধীরে তারা এই সংখ্যা বাড়িয়ে ৮২ জনকে ছেড়ে দিতে রাজি হয়।

হাজিমে ইশিই জানান, ইতিমধ্যে জাপান সরকার মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের ২১টি দেশ এবং যাত্রীদের নিজ নিজ দেশের সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিমানটি গ্রহণের অনুরোধ করে। কিন্তু কোনো দেশ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি।

টোকিওতে নিজের লেখা বইয়ের বাংলা অনুবাদের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে হাজিমে ইশিই।

ইতিমধ্যে জঙ্গিরা জিম্মিদের একে একে মেরে ফেলবে বলেও ঘোষণা দেয়। সে সময় হাজিমে ইশিই নিজেই মাইক্রোফোন নিয়ে ছিনতাইকারীদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন। জাপানি ভাষায় তিনি সব যাত্রীর বিনিময়ে তাঁকে নতুন জিম্মি হিসেবে নেওয়ার কথা জানান। কিন্তু তাঁর সেই প্রস্তাব তারা গ্রহণ করেনি। বরং বিমানটি রানওয়ের মাঝামাঝি জায়গায় চলে যায়। তখন বিমানটিকে বাধা দেওয়া হলে ককপিটের জানালা খুলে একজন জঙ্গি পিস্তল বের করে চারটি গুলি ছোড়ে। এতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দুজন সৈন্য আহত হন।

বন্দী বিনিময় যেভাবে শুরু

পরে ছিনতাইকারীদের সঙ্গে আবার আলোচনা শুরু হলে তারা বিমানটির মুখ ঘুরিয়ে আগের স্থানে চলে যায়। তারপর কিছুক্ষণ আলোচনার পর শুরু হয় জিম্মি হওয়া যাত্রীদের মুক্তির প্রক্রিয়া। ওই রাতে জাপানের প্রধানমন্ত্রী তাকেও ফুকুদার সঙ্গে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কথা হয় টেলিফোনে।

পয়লা অক্টোবর রাত ১০টার দিকে একজন কয়েদি ও ২০ লাখ ডলারের বিনিময়ে ১০ জন নারী যাত্রীকে উদ্ধার করা হয়। একধরনের আইনগত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই বিনিময়ের কাজ চলে। জেলখানা থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত অপরাধী ও নগদ অর্থ প্রথমে জাপানের পক্ষ থেকে সাময়িকভাবে বাংলাদেশ সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তারপর সেই লোকজন ও অর্থ ছিনতাই হওয়া বিমান পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া এবং জঙ্গিদের হাতে তুলে দেওয়ার দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারের ওপর বর্তায়।

তখন ছিনতাইকারীরা টাকা গুনে এবং জাপানি কয়েদিদের বুঝে নিয়ে কয়েক দফায় ৬১ জন যাত্রীকে মুক্তি দেয়। কিন্তু তখনো থেকে গিয়েছিল ৭১ জন যাত্রী ও ৯ জন ক্রু। ছিনতাইয়ের ঘটনা শুরু হওয়ার পর ততক্ষণে তিন দিন ১৮ ঘণ্টা পার হয়ে গেছে।

ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান

২ অক্টোবর ১৯৭৭। জাপানি বিমান ছিনতাই ঘটনার সময়েই সশস্ত্র বাহিনীতে সংঘটিত হয়েছিল একটি ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান। এ অভ্যুত্থানে বিমানবাহিনীর সৈনিকেরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। এর দুই দিন আগে ৩০ সেপ্টেম্বর বগুড়া সেনানিবাসে ২২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে সংঘটিত হয়েছিল আরেকটি ব্যর্থ অভ্যুত্থান।

পরদিন ভোর পাঁচটার দিকে তিনি বাজুকা কামান ও মেশিনগানের শব্দ শুনতে থাকেন হাজিমে ইশিই। কিন্তু তখনো তিনি বুঝতে পারেননি যে কী হচ্ছিল। কিন্তু পরে তিনি জানতে পারেন যে ঢাকা বিমানবন্দর সে সময় প্রায় বিদ্রোহীদের দখলে চলে যাচ্ছিল।
এ নিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘পরিস্থিতি এমন উত্তেজনাপূর্ণ থাকা সত্ত্বেও আমরা বুঝতে পারিনি যে একই ভবনের ভেতরে হত্যাকাণ্ড চলছে। রাত পার হয়ে সকাল হলে সবকিছু যখন পরিষ্কার দেখা যেতে শুরু করে, তখন প্রথম আমরা জানতে পেরেছিলাম পরিস্থিতির ভয়াবহতা। টার্মিনাল বিল্ডিং, মূল ভবনের ভেতরটা রক্তের সাগরে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। বিদ্রোহী সৈন্যরা সেখানে মোতায়েন বিমানবাহিনীর সেনাদের নির্মমভাবে নির্বিচার হত্যা করতে থাকে।’

১৯৭৭ সালের ৪ অক্টোবরের দৈনিক বাংলা

বিদ্রোহী সেনারা সকাল পৌনে সাতটার মধ্যে বিমানবন্দরের মূল ভবনকে তাদের দখলে নিয়েছিল। সে সময় তিনি কিছু রক্তাক্ত মৃতদেহ এখানে–সেখানে পড়ে থাকতে দেখেন। এ সময় নিয়ন্ত্রণ টাওয়ার বিদ্রোহীদের দখলে চলে যায়। সশস্ত্র বাহিনী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ শুরু করে সকাল আটটার দিকে। নিয়মিত বাহিনীর সৈন্যরা মূল ভবনে প্রবেশ করলে দুই পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড লড়াই শুরু হয়। তারপর ধীরে ধীরে বিদ্রোহীরা পরাজিত হয়।

হাজিমে ইশিই লিখেছেন, ‘এই ব্যর্থ অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল স্থল ও বিমানবাহিনীর প্রায় ১০০ জন সেপাই। এতে বিমানবাহিনীর একজন অফিসারসহ ২১ জন অফিসার ও সেনা নিহত হন। বিদ্রোহী সেনা মিলে মোট ২০০ জনের বেশি এই ঘটনায় প্রাণ হারান বলে জানা গেছে।’

বদলে যায় পরিস্থিতি

অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা দমন করার পর বিমান ছিনতাইকারী জঙ্গিদের সঙ্গে আবারও আলাপ–আলোচনা শুরু হয়। কিন্তু ততক্ষণে তাদের কথাবার্তা অনেকটাই নরম হয়ে আসে। তখন হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়। ২ অক্টোবর সকালে হাজিমে ইশিই জাপানি প্রধানমন্ত্রী ফুকুদার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছিল বলে তিনি তাঁকে অনুরোধ করেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য।

দুপুরের দিকে আবার নতুন করে দর-কষাকষি শুরু হয়। একপর্যায়ে বিকেল সোয়া পাঁচটায় তারা আরও ৪২ জন যাত্রী ও পাঁচজন ক্রুকে ছেড়ে দেয়। ওই দিন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সামরিক আইন শাসক হিসেবে রাত ১০টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করেন।

কিন্তু তার আগে পরিস্থিতি ব্যাপকভাবে বদলে যেতে শুরু করে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ফোন করেন কন্ট্রোল টাওয়ারে। তিনি আদেশ দেন বিমানটিকে অনতিবিলম্বে ঢাকা ত্যাগ করতে দেওয়ার জন্য। জাপানি জঙ্গিদের জানানো হয় তাদের এখনই ঢাকা ছেড়ে চলে যেতে হবে। তখন বিমানটিকে আটকে রাখার জন্য দাঁড় করিয়ে রাখা ফায়ার সার্ভিসের গাড়িগুলো সরে যেতে শুরু করে।

২ অক্টোবরের দৈনিক বাংলা

তারপর বিমানটি উড়ান শুরু করে নতুন গন্তব্য আলজেরিয়ার উদ্দেশে। আকাশ থেকে ছিনতাইকারীরা বেতারযন্ত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলে যে তাদের মিশন সফল হয়েছে। ৩ অক্টোবর সকালে বিমানটি গিয়ে পৌঁছায় কুয়েতে। তখন কুয়েতে দিবাগত রাত ১টা ৪৩ মিনিট। সেখানে ৬০ হাজার পাউন্ডের তেল নেওয়ার পর বিমানটি ২৯ জন আরোহী ও জঙ্গিদের নিয়ে বিমানটি কুয়েত ত্যাগ করে।
এবার বিমানটি গিয়ে পৌঁছায় সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে। সেখানে আরও ১০ জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তখনো থেকে যায় ১৯ জন। সেদিনই স্থানীয় সময় বিকেল চারটার পর বিমানটি আলজিয়ার্সের উপকণ্ঠে আল বাইদা শহরের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। সেখানে ছেড়ে দেওয়া হয় বাকি জিম্মিদের।

এ জি মাহমুদ যা লিখেছিলেন

এয়ার ভাইস মার্শাল এ জি মাহমুদ (অব.) ২০১৫ সালে ‘মাই ডেসটিনি’ নামে একটি বই প্রকাশ করেছিলেন। সেখানে একটি অধ্যায় রয়েছে জাপানি বিমান ছিনতাই। তিনি লিখেছেন, ‘দেশে একটা গুরুতর সংকট দেখা দিল ১৯৭৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। এতে জাতীয় নিরাপত্তাব্যবস্থার দুর্বলতা প্রকাশ হয়ে পড়ল। বিমানবাহিনীর বহু মানুষের জীবন বদলে গেল এই ঘটনায়। আমিও বাদ পড়লাম না।

১৯৭৭ সালের ২৮ শে সেপ্টেম্বর, বঙ্গভবনে আমি মন্ত্রিসভায় মিটিংয়ে ছিলাম। সকাল প্রায় সাড়ে ১০টার দিকে আমার এডিসি আমার হাতে একটা ছোট কাগজের টুকরো দিল। তাতে লেখা ছিল, একটা ছিনতাইকৃত বিমান তেজগাঁও বিমান বন্দরের ওপর দিয়ে ঘুরছে এবং বন্দরে অবতরণের অনুমতি চাইছে। আমার পাশেই বসে ছিলেন জেনারেল জিয়া। আমি তাঁর হাতে দিলাম কাগজের টুকরোটা। লেখা পড়ে তিনি আমাকে বিমানবন্দরে গিয়ে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে বললেন।

ছিনতাইকারীদের সঙ্গে কথা বলছেন এ জি মাহমুদ

তাড়াতাড়ি আমি বিমানবন্দরের কন্ট্রোল টাওয়ারের দিকে ছুটলাম। সেখানে পৌঁছেই আমি জাপানি বিমানের সঙ্গে যোগাযোগ করে পরামর্শ দিলাম যে তারা যেন অন্য কোথাও যায়। কারণ এই নতুন দেশে তাদের চাহিদা মোতাবেক সেবা দেওয়ার যোগ্যতা আমাদের না–ও থাকতে পারে। উত্তরে তারা জানাল যে তাদের জ্বালানি কমে গেছে বিধায় যেকোনোভাবেই হোক তারা ঢাকাতেই অবতরণ করছে এবং তারা অবতরণ করল। বিমানের ভেতরে থাকা যাত্রীদের বিপদের কথা চিন্তা করে আমি তাদের অবতরণ বন্ধ করার চেষ্টা করলাম না। অবতরণের পর রানওয়ের শেষ মাথায় গিয়ে বিমান পার্ক করার নির্দেশ দেওয়া হলো পাইলটকে। এমন জায়গায় তাকে পার্ক করতে হবে, যাতে অন্য বিমানের অপারেশন বাধাগ্রস্ত না হয়। ওটা ছিল জাপান এয়ারলাইনসের বিমান ডিসি-৮, ফ্লাইট নম্বর ৪৭২। বিমানটা যাত্রা শুরু করেছিল প্যারিস থেকে। তারপর অবতরণ করেছিল এথেন্স, কায়রো, করাচি ও মুম্বাই বন্দরে। এটার গন্তব্য ছিল ব্যাংকক। বিমানে ছিল ১৫৬ জন যাত্রী এবং ১৪ জন ক্রু।’

ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান নিয়ে এ জি মাহমুদ লিখেছেন, ‘১৯৭৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর বগুড়া সেনানিবাসে একটা বিদ্রোহ হয়েছিল। লেফটেন্যান্ট হাসান নামের এক অফিসারকে হত্যা করে সৈন্যরা। শুনেছিলাম, কিছু বিদ্রোহী সৈন্য ঢাকার পথে আসছিল। সেপ্টেম্বরের ২৮ তারিখ থেকে ২ অক্টোবর পর্যন্ত আমি কন্ট্রোল টাওয়ারেই ছিলাম। মাত্র দুবার মন্ত্রিসভার মিটিংয়ে গিয়েছি। ১৯৭৭ সালের পয়লা অক্টোবর রাতে ঢাকায় আর্মি সিগন্যাল ব্যাটালিয়নের সৈন্যরা বিদ্রোহ করেছিল। আর্মি সিগন্যাল ব্যাটালিয়ন ছিল কুর্মিটোলা বিমানবন্দরের লাগোয়া। বিদ্রোহীরা সীমানাদেয়াল ভেঙে শূন্যে গুলি ছুড়ছিল আর বিপ্লবী স্লোগান দিচ্ছিল।

বিমানের লোকজন (এয়ারমেন) তখন ঘুমিয়ে ছিলেন ব্যারাকে। বিদ্রোহীরা যূথবদ্ধ হয়ে এয়ারম্যানদের সঙ্গে নিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে অবস্থিত অর্ডিন্যান্স ডিপোতে গিয়েছিল। তারা অস্ত্র বের করেও নিয়েছিল কিন্তু গোলগুলি পায়নি। একটা দল ঢাকা রেডিওর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল। খুব ভোরে সার্জেন্ট আফসারের নেতৃত্বে একদল সশস্ত্র এয়ারম্যান বিমানবন্দরে প্রবেশ করে আমাদের অফিসারদের নির্বিচার গুলি করতে শুরু করে। বিমানবন্দরের ডিজি অফিসে ছিলাম আমি। সেখান থেকে একদল এয়ারম্যান আমাকে গ্রাউন্ড ফ্লোরে নিয়ে গেল।’

এ জি মাহমুদ এরপর লিখেছেন, ‘বগুড়ায় বিদ্রোহ হয়েছিল ২৮ সেপ্টেম্বর। বিমানবন্দরে কর্তব্যরত বিমানবাহিনীর অফিসারকে গুলি করে হত্যা করা হয় দোসরা অক্টোবর ১৯৭৭, ভোরবেলায়। সেনা সদর দপ্তর চার দিন সময় পেয়েছিল বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে আনার। ছিনতাইকারীদের প্রসঙ্গে আবার আসতে চাই। আমি বলেছিলাম, সমস্ত যাত্রীকে মুক্ত করে না দিলে ঢাকা ছাড়ার অনুমতি তারা পাবে না। এই মিটিংয়ে কাজ হয়েছিল। ছিনতাইকারীদের সম্ভাব্য গন্তব্য সম্পর্কে জাপানি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আলোচনা হয়েছিল আমার। তিনি জানিয়েছিলেন যে আলজেরিয়ার সরকার তাদের সাময়িক রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে সম্মত হয়েছে। তাদের আলজেরিয়া যাওয়ার জন্য আমরা প্রয়োজনীয় ম্যাপ এবং চার্ট দিয়েছি। ছাব্বিশজন যাত্রী নিয়ে ছিনতাইকারীরা চলে গেল। সমস্যার ইতি হলো সেখানে। ওরা যখন চলে যায়, তখন আমি ছিলাম না বিমানবন্দরে। আমি চলে আসার পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শেখ জালাল বিমানবন্দরে জাপানি ডেলিগেটদের দেখা শোনার দায়িত্বে থাকলেন। তিনি খুব ভালো জাপানি ভাষা জানতেন এবং অবিরত ওই ভাষায় কথা বলতে পারতেন।’

ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের একটি ছবি

পরদিন সকালে, ১৯৭৭ সালের ৩ অক্টোবর, নবম ডিভিশনের কিছু সেনাসদস্য, এয়ার কমোডর ওয়াহিদুল্লাহ এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন সাইফুল আজমসহ কুর্মিটোলা গেলাম এয়ারম্যানদের নিরস্ত্র করতে। সবাই বের হয়ে এল এবং শৃঙ্খলার সঙ্গে সমবেত হলো। আমি তাদের অস্ত্র সমর্পণ করতে বললাম। একের পর এক সমস্ত অস্ত্র জমা পড়ল আমার সামনে। তারপর আমি অফিসে গিয়ে পরিস্থিতির মূল সমস্যাটা বুঝলাম। সব অফিসারের মুখে বিপদের ছায়া। আমাদের মোট ১১ জন অফিসার নিহত হয়েছিলেন।

ছিনতাইকারীরা চলে যাওয়ার কদিন পর আমি জানতে পেরেছিলাম যে ওরা আলজেরিয়ায় পৌঁছে সব যাত্রীকে ছেড়ে দিয়েছে। কমরেডদের এবং সমস্ত টাকা নিয়ে উধাও হয়েছে তারাও। পরে ওকদাইরা ছাড়া ছিনতাইকারীরা সবাই ধরা পড়েছিল।
এমপি মিস্টার হায়া কাওয়ার নেতৃত্বে জাপান থেকে এক সংসদীয় প্রতিনিধিদল ঢাকায় ছিল। আমাদের জীবনের মূল্যে জাপনিদের প্রাণ বাঁচিয়েছি বলে তাঁরা বাংলাদেশে এসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে অন্য এমপি, বিশেষ করে মহিলা এমপি ইয়ামাগুতিও সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে এসেছিলেন।

প্রায় ঘুমন্ত অবস্থায় থাকা বাংলাদেশ জাপান ফ্রেন্ডশিপ অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক টুলুকে তলব করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্মানিত জাপানি প্রতিনিধিদের ভালোভাবে দেখাশোনা করার জন্য বলেছিল। প্রকৃতপক্ষে দায়িত্ব ছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরই। জাপানি প্রতিনিধিরা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন। আমার পরামর্শে মিস্টার হায়াকাওয়া একটা বোয়িং ৭০৭ বিমান কেনার জন্য আমাদের দিয়েছিলেন নগদ ষাট লাখ ডলার।’

শেষ কথা

জাপানের মন্ত্রী হাজিমে ইশিইর লেখা বইটির বাংলায় অনুবাদ করেছেন কাজুহিরো ওয়াতানাবে। বইটির মুখবন্ধে তিনি লিখেছেন, ছিনতাই হওয়া বিমানে আটক ১৫১ জন জিম্মিকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে জাপান সরকার সন্ত্রাসীদের দাবি মেনে নিয়ে বিপুল পরিমাণের মুক্তিপণ দিতে এবং জাপানের কারাগারে আটক কয়েকজন সন্ত্রাসী ও অন্যান্য অপরাধীকে ছেড়ে দিতে রাজি হয়। সরকারের এই আইনবহির্ভূত পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত দেশের ভেতরে ও বাইরে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় তোলে।

ঘটনাচক্রে প্রায় একই সময় জার্মানির লুফৎহানসা বিমান সংস্থার একটি যাত্রীবাহী বিমান হাইজ্যাকারদের হাতে ছিনতাই হয়েছিল। তদানীন্তন পশ্চিম জার্মানি সরকার ছিনতাইকারীদের দাবি অগ্রাহ্য করে সন্ত্রাস দমনের জন্য গঠিত বিশেষ ইউনিট পাঠিয়ে অতর্কিত হামলা চালিয়ে সন্ত্রাসীদের হত্যা বা গ্রেপ্তার করার পাশাপাশি সব জিম্মিকে নিরাপদে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। পশ্চিম জার্মানির এই সাফল্যের পরিপ্রেক্ষিতে জাপান সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে সমালোচকেরা আবারও সোচ্চার হয়ে উঠে বলতে থাকেন যে জাপানের দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল। অবশ্য জিম্মিদের কীভাবে নিরাপদে উদ্ধার করা যায়, তা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিয়েছিল। এ কারণে এয়ার ভাইস মার্শাল এ জি মাহমুদ, যিনি বিমান ছিনতাইকারীদের সঙ্গে দর-কষাকষির দায়িত্বে ছিলেন এবং জাপানি প্রতিনিধিদলের প্রধান ও তৎকালীন উপপরিবহনমন্ত্রী হাজিমে ইশিইর মধ্যে যে বিবাদ দেখা দিয়েছিল, সেই বর্ণনা আমরা মি. ইশিইর লেখার মধ্যে পাই।

ঢাকায় আসা জাপানি প্রতিনিধি দল

মি. ইশিই জাপানি প্রতিনিধির দৃষ্টিকোণ থেকে এই বই লিখেছেন। তাঁর মতো করে ঘটনাবলির ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছেন। মি. মাহমুদসহ বাংলাদেশি পক্ষ মি. ইশিইর ধারণার সঙ্গে পুরোপুরি সম্মত না-ও হতে পারে। কিন্তু এ কথা নিশ্চয়ই বলা যায় যে মি. মাহমুদ এবং মি. ইশিই অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনের জন্য মরিয়া হয়ে প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন এবং তাঁরা ছিলেন রণাঙ্গনে মিত্রপক্ষ হিসেবে একই সঙ্গে যুদ্ধ করে যাওয়া দুই যোদ্ধার মতো। এই পুরোনো দুই বন্ধুর হৃদয়ের মিলনের প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার সুযোগ হয়েছে আমার। ২০১৭ সালের মে মাসে এয়ার ভাইস মার্শাল এ জি মাহমুদ জাপান সফরে এলে টোকিওর এক হোটেলে তাঁদের পুনর্মিলন ঘটে। তাঁরা একে অন্যের হাত শক্তভাবে চেপে ধরলেন, তারপর হাসিমুখে গল্পে মত্ত হলেন।

এ বছর জাপান সরকার মি. মাহমুদকে একটি সম্মানজনক পুরস্কারে ভূষিত করেছে। ১৯৭৭ সালে সংকটের সফল মীমাংসায় তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এই সম্মাননা প্রদান করা হয় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর এই সাবেক প্রধানকে। পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য জাপান সরকারের আমন্ত্রণে মি. মাহমুদ জাপানে এসেছিলেন। সেই সুযোগে তিনি মি. ইশিই ছাড়াও ১৯৭৭ সালের কয়েকজন সাবেক জিম্মির সঙ্গেও দেখা করেন। তাঁরা তাঁদের জীবন রক্ষায় প্রাণপণ চেষ্টা চালানোর জন্য অন্তর থেকে এয়ার ভাইস মার্শালকে ধন্যবাদ জানান।