ঝুঁকিপূর্ণ অভিবাসন

৪ বছরে মাদারীপুরের ৪৫ জনের মৃত্যু

অবৈধ পথে ইউরোপ যাত্রা। নিখোঁজ আছেন তিন শতাধিক ব্যক্তি। ফিরে আসতে পেরেছেন অন্তত সাড়ে তিন শ জন।

২০২১ সালের নভেম্বরে লিবিয়ায় দালালের নির্যাতনে মারা যাওয়া সাব্বির খানের স্বজনদের আহাজারি। মাদারীপুর সদর উপজেলার মধ্য খাগদী এলাকায়
ফাইল ছবি

ইউরোপের কোনো দেশে গেলেই সংসারে সচ্ছলতা আসবে, এমন ধারণা নিয়ে প্রতিবছর মাদারীপুর থেকে শত শত তরুণ সেখানে পাড়ি জমানোর চেষ্টা করছেন। তবে অবৈধ পথে ইউরোপ যেতে গিয়ে অনেকের মৃত্যু হয়েছে। কেউবা দালালের খপ্পরে পড়ে নির্যাতনের শিকার হয়ে কাটাচ্ছেন বন্দিজীবন।

জেলা প্রশাসন ও পুলিশের তথ্য বলছে, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত জেলার ৪৫ জন লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার পথে মারা গেছেন। জেলা প্রশাসনের তথ্য বলছে, এর মধ্যে শুধু সদর উপজেলায় তিন বছরে (২০২০–২২) মারা গেছেন ২৫ জন।

একই সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে নির্যাতনের শিকার হয়ে লিবিয়া থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসতে পেরেছেন অন্তত সাড়ে তিন শ তরুণ। নিখোঁজ আছেন তিন শতাধিক ব্যক্তি। এমন পরিস্থিতিতে ভুক্তভোগীদের স্বজনেরা বিচার কিংবা ক্ষতিপূরণের আশায় ইদানীং মামলা করতে শুরু করেছেন। তবে এসব মামলায় আসামিদের অনেকেই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন। কাউকে কাউকে আইনের আওতায় আনা হলেও উপযুক্ত বিচার না হওয়ার অভিযোগ আছে। তবে এরপরও অবৈধ পথে ইউরোপ যাত্রা থামেনি।

মাদারীপুর সদরের শিরখাড়া ইউনিয়নের শ্রীনদী এলাকার হাবিব ব্যাপারীর ছেলে রফিক ব্যাপারী (২২) ভাগ্যবদলের আশায় ইতালি যেতে চেয়েছিলেন। তবে গত বছরের অক্টোবরে লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার পথে দালালের নির্মম নির্যাতনে মৃত্যু হয় এই তরুণের। এ ঘটনায় হাবিব ব্যাপারী মানব পাচার আইনে মামলা করেন। পুলিশ অভিযুক্ত আসামিকে গ্রেপ্তার করলেও আড়াই মাস কারাভোগের পর জামিনে বেরিয়ে যান।

হাবিব ব্যাপারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার একমাত্র পোলাডারে দালালেরা নির্যাতন কইরা মাইরা ফালাইছে। মামলা করছিলাম বিচারের আশায়। এহন দ্যাখি দালাল আলমগীর খাঁ এলাকা দিয়া ঘুরে। মামলা তুলে নিতে কয়। মীমাংসার জন্য টাকাও সাধে। পোলাডা যাগো কারণে মইরা গেল, ওগের কি বিচার দেইখ্যা আমরা মরতে পারুম না?’

যাঁরা প্রতারণার শিকার হয়েছেন বা ফিরে এসেছেন, তাঁরা আইনি সহযোগিতা চাইলে পুলিশের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতাও করা হচ্ছে
মাদারীপুরের পুলিশ সুপার মো. মাসুদ আলম

বেড়েছে মামলার সংখ্যা

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত জেলায় মানব পাচার প্রতিরোধ আইনে কোনো মামলা হয়নি। তবে ২০১৭ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত মামলা হয়েছে ৬টি। ২০২০–এ সংখ্যা দাঁড়ায় ২৯টি। আর ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত জেলায় মামলা হয়েছে ১০০টি। এর মধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে মামলা হয়েছে ২১টি। থানা ও আদালতে হওয়া এসব মামলায় আসামি ৫৯৫ জন। এর মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন মাত্র ১১৭ জন। এসব মামলার বিপরীতে আদালতে পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে ৩১টির।

এতগুলো মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে পুলিশ সুপার মাসুদ আলম বলেন, তদন্তে দেখা গেছে কিছু মামলা ভুয়া। চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার পরও বাদী নারাজি দেননি।

আমার একমাত্র পোলাডারে দালালেরা নির্যাতন কইরা মাইরা ফালাইছে। মামলা করছিলাম বিচারের আশায়। এহন দ্যাখি দালাল আলমগীর খাঁ এলাকা দিয়া ঘুরে। মামলা তুলে নিতে কয়। মীমাংসার জন্য টাকাও সাধে। পোলাডা যাগো কারণে মইরা গেল, ওগের কি বিচার দেইখ্যা আমরা মরতে পারুম না
হাবিব ব্যাপারী

জনপ্রতিনিধিরাই যখন দালাল

জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, গত এক বছরে অবৈধ পথে ইউরোপ যাওয়ার পথে লিবিয়ার বন্দিশালা থেকে ২০০ তরুণকে জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। ফিরে আসা তরুণদের দেওয়া বর্ণনায় বন্দিশালায় নির্মম নির্যাতনের পেছনে জনপ্রতিনিধিদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত থাকার অভিযোগ এসেছে। ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সদর উপজেলার বাহাদুরপুর, ধুরাইল, শিরখাড়া, কুনিয়া, পেয়ারপুর, কালিকাপুর ও রাজৈর উপজেলার ইশিবপুর, কবিরাজপুর, বদরপাশা, হোসেনপুর এলাকার অন্তত ১০ জন সাবেক ও বর্তমান জনপ্রতিনিধি মানব পাচার চক্রে জড়িত।

গত ৬ ডিসেম্বর মানব পাচার আইনে করা মামলায় পেয়ারপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ছবুর খানকে (৪৫) মূল

অভিযুক্ত করে আদালতে একটি অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। এ ছাড়া এই ইউপির সাবেক সদস্য আম্বিয়া বেগমের বিরুদ্ধেও মানব পাচার আইনে মামলা রয়েছে।

জানতে চাইলে মাদারীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ঝোটন চন্দ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের জেলার বর্তমান ও সাবেক কিছু জনপ্রতিনিধি এই চক্রে জড়িত রয়েছেন বলে আমরা বিদেশফেরত ও ভুক্তভোগীর কাছ থেকে জেনেছি। তাঁদের তালিকা করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’

ঝোটন চন্দ বলেন, ‘আমাদের উদ্যোগে যেসব তরুণকে লিবিয়ার বন্দিশালা থেকে দেশে ফেরত আনা হয়েছে, তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে হতাশাগ্রস্ত তরুণদের ফ্রিল্যান্সিং ও উদ্যোক্তা তৈরির জন্য প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে।’

ধরাছোঁয়ার বাইরে মূল দালালেরা

মানব পাচার চক্রের মূল হোতাদের বড় একটি অংশ লিবিয়ায় বসবাসকারী বাংলাদেশি। তাঁদের মধ্যে অন্যতম শরীফ হোসেন লিবিয়ায় পশ্চিমাঞ্চল শহরের একটি ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণ করেন। শরীফের বাড়ি কুমিল্লায় হলেও শ্বশুরবাড়ি মাদারীপুর সদরে। মাদারীপুর থেকে লিবিয়া যেতে ইচ্ছুক তরুণদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করেন শরীফের স্ত্রী সুমি আক্তার।

শরীফের একান্ত সহযোগী মাদারীপুর সদরের কালিকাপুরের আজিজুল হক (২৭)। সম্প্রতি লিবিয়া থেকে গ্রামে এলে তাঁর সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। নির্যাতনের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায় করার বিষয়ে আজিজুল হক বলেন, ‘টাকাপয়সার ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। শুনেছি, ওখানে সাড়ে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা করে নেওয়া হয়। তবে আমি কারও কাছ থেকে কোনো টাকাপয়সা নিইনি। আমি শুধু সবাইকে চুপচাপ রাখার জন্য শাসনের কাজটা করতাম।’

মানব পাচারকারী দালাল চক্রের অন্যতম হোতা মাদারীপুর সদরের ধুরাইল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি আলমগীর খাঁ (৪৮)। তিনি মানব পাচার আইনে একবার গ্রেপ্তার হয়ে আড়াই মাস জেল খেটে এখন আবারও এই পেশায় ফিরেছেন। আলমগীর খাঁর মাধ্যমে সদর উপজেলার শিরখাড়া ইউনিয়নের শ্রীনদী এলাকার হাবিব ব্যাপারীর ছেলে রফিক ব্যাপারী ইতালি যেতে চেয়েছিলেন। ইতালি যাওয়ার পথেই লিবিয়ায় দালালদের নির্যাতনে মারা যান রফিক।

তবে আলমগীর খাঁ দাবি করেছেন, তিনি মানব পাচার কিংবা বিদেশে কর্মী পাঠানোর সঙ্গে জড়িত নন। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা ষড়যন্ত্রমূলক একটি মামলা দেওয়া হয়েছে। আমি বিদেশে কোনো লোক পাঠাই না, ঢাকায় ব্যবসা–বাণিজ্য করি। ইতালি যাওয়ার পথে মারা যাওয়া রফিককে এই পথে পাঠান রাজৈর উপজেলার বাঁশকান্দি এলাকার কুদ্দুস। আমাকে শুধু শুধু আসামি করে জেল খাটানো হয়েছে।’

মাদারীপুরের পুলিশ সুপার মো. মাসুদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশ সচেতনতামূলক প্রচার করছে। এ কারণে মামলার সংখ্যাও বাড়ছে। বিদেশগামী তরুণদের জীবনকে যাঁরা ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছেন, সেসব দালালকে চিহ্নিত করে আমরা আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছি। যাঁরা প্রতারণার শিকার হয়েছেন বা ফিরে এসেছেন, তাঁরা আইনি সহযোগিতা চাইলে পুলিশের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতাও করা হচ্ছে।’