এভাবে চললে চট্টগ্রাম বাস–অযোগ্য শহর হয়ে যাবে: আবুল মোমেন

চট্টগ্রামের ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটিতে (ইডিইউ) ‘পলিসি ডায়ালগ সিরিজ অ্যাপিসোড-১’-এ নগর-পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেন বক্তারা। চট্টগ্রাম, ১৬ জুন
ছবি: সংগৃহীত

চট্টগ্রাম অনেক পুরোনো শহর। এ শহরে নদী, খাল, হ্রদ, পাহাড়, সমুদ্র—সবকিছুই আছে। কিন্তু ধীরে ধীরে শহরটা ঘিঞ্জি হয়ে যাচ্ছে। নগরে যেনতেনভাবে ভবন গড়ে উঠছে। পাহাড় কেটে ফেলা হচ্ছে। এভাবে চললে একসময় বাস-অযোগ্য শহর হয়ে যাবে। তাই চট্টগ্রামেও উপশহর তৈরি করতে হবে। শহরকে বাঁচাতে হবে।

চট্টগ্রামের ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটিতে (ইডিইউ) ‘পলিসি ডায়ালগ সিরিজ অ্যাপিসোড-১’-এ প্যানেল আলোচকের বক্তব্যে এসব কথা বলেন কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন। শুক্রবার মোজাফফর নগরে অবস্থিত ইডিইউ ক্যাম্পাসে চট্টগ্রামের টেকসই উন্নয়ন নীতিবিষয়ক এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আয়োজক ছিল ইডিইউর পাবলিক লিডারশিপ, ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড গভর্নেন্স বিভাগ। বেলা সাড়ে তিনটায় অনুষ্ঠান শুরু হয়, যা চলে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত।

অনুষ্ঠানে আবুল মোমেন আরও বলেন, ঢাকায় এক দশক আগেও গাড়ির গতি ছিল ২০ কিলোমিটার। এখন সেটি ৪ কিলোমিটারে এসে ঠেকেছে। ঢাকায় অন্তত দুই কোটি মানুষ বাস করছেন। কিন্তু চট্টগ্রাম নগরের জনসংখ্যা এখনো ৬০ লাখের কম। এই শহরকে এখনো বাঁচানো সম্ভব। এ জন্য রাউজান, হাটহাজারী, নাজিরহাট কিংবা অন্য উপজেলাগুলোতে উপশহর তৈরি করতে হবে।

ইডিউর উপাচার্য অধ্যাপক মু. সিকান্দার খানের সভাপতিত্বে সেমিনারে মূল বক্তা ছিলেন ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির সহ-উপাচার্য নিয়াজ আহমেদ খান। তিনি বলেন, প্রায় ৭০ বছর ধরে পুরো পৃথিবী নগরায়ণের দিকে যাচ্ছে। চট্টগ্রামও ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু নাগরিক সুবিধা সবাই পাচ্ছে না। চট্টগ্রামে নাগরিক সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় নেই। এসব প্রতিষ্ঠান পেশাজীবীদের বক্তব্য শুনতে চায় না। এখানে জনপ্রতিনিধিও পাহাড় কাটার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাচ্ছেন।

প্যানেল আলোচনায় প্রকৌশলী সুভাষ চন্দ্র বড়ুয়া বলেন, যানজট নিরসনে চট্টগ্রামে যে অবকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে, সেগুলো অপরিকল্পিত। ১৯৯৫ সালের মহাপরিকল্পনায় যেসব বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছিল, তার বিপরীত কাজগুলো হয়েছে। এই বন্দরনগরে যানবাহনের জন্য যে সড়ক ও ফ্লাইওভার তৈরি হয়েছে বা হচ্ছে, সেগুলো সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ ঠিকভাবে হয়নি। এমনকি নির্মাণকাজের ব্যবস্থাপনাও ছিল না।

চট্টগ্রামে প্রকল্পগুলো শেষ পর্যন্ত ‘সাদা হাতি’তে রূপান্তর হবে কি না সে প্রশ্ন তুলে সুভাষ চন্দ্র বড়ুয়া বলেন, টানেল নির্মাণ করা হয়েছে। টানেল হওয়ায় টু টাউন ওয়ান সিটি হয়েছে। এর আগেই কর্ণফুলীর ওপারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। টানেল অনেক ব্যয়বহুল। টানেল দিয়ে শুধু সাড়ে তিন কিলোমিটার পার হওয়া যাবে। এরপর কক্সবাজার পর্যন্ত আরও প্রায় ১৪৮ কিলোমিটার যেতে হবে। পাশাপাশি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত আরও কয়েক শ কিলোমিটার যেতে হবে। ওই পথের জন্য কী পরিকল্পনা আছে? টানেল পার হলেই তো দেশের সব কর্নারে যাওয়া যাবে না।

স্থপতি জেরিনা হোসেন বলেন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ অনেকগুলো আবাসন প্রকল্প (হাউজিং প্রজেক্ট) করেছে। কিন্তু এসব প্রকল্পের পরিকল্পনায় ঘাটতি আছে। নগরের অনেক এলাকা প্লাবন ভূমি ছিল। সেখানে প্লট করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু একজনও সেখানে বাসা বানাননি। শহরে প্রকৌশলী আছে, কিন্তু পরিকল্পনাবিদ নেই।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সাবেক প্রধান প্রকৌশলী এম এমদাদুল ইসলামের বক্তব্যে চট্টগ্রামের নগরায়ণের নানা সমস্যা উঠে আসে। তিনি বলেন, একসময় চট্টগ্রামে খাল, পাহাড় ও জলাশয় ছিল। কিন্তু এখন সব শেষের পথে। ঢাকার অবস্থাও একই। সেখানেও জলাশয় ছিল, যা এখন ভরাট হয়ে যাচ্ছে।

বিএসআরএমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমীর আলী হুসেইন বলেন, সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমেই এ শহরকে বাঁচাতে হবে। এখন যেটুকু সবুজ আছে, সেটুকু রক্ষা করতে হবে।

চট্টগ্রামে সুপেয় পানির তীব্র সংকট চলছে বলে উল্লেখ করেন ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ডিন হামিদুল হক। তিনি বলেন, কোনো এক নথিতে উল্লেখ আছে, চট্টগ্রামে একসময় ৫৭টি খাল ছিল। এখন নেই। পৃথিবীর কোনো শহর সরকারের ওপর নির্ভর করে রক্ষা পায়নি। নাগরিক আন্দোলনই হচ্ছে গ্রাম ও শহর রক্ষার প্রধান হাতিয়ার।

চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানে আধুনিক মহাপরিকল্পনা ও ডিটেইল স্ট্রাকচার প্ল্যান প্রয়োজন বলে মনে করেন ইডিইউর প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চেয়ারম্যান সাঈদ আল নোমান। তিনি বলেন, পলিসি তৈরিতে নাগরিকদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। এই শহরে জলাবদ্ধতার সমস্যা আছে। লবণাক্ত পানিতেও মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। এসব সমাধানে সমন্বিত উদ্যোগ দরকার।

সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক মু. সিকান্দার খান অতিথিদের ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, উন্নয়নের সুফল পেতে সঠিক নেতৃত্ব দরকার। পরিকল্পনা করতে হবে নগরবাসীর সঙ্গে কথা বলে, মতামত নিয়ে। তবেই সুফল মিলবে।

অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচক হিসেবে আরও ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা (বীর প্রতীক) ফারুক-ই-আজম, সিটি ইউনিভার্সিটির সহ-উপাচার্য কাজী শাহদাত কবির, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য সৈয়দ মোহাম্মদ আবু দাউদ, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি আবদুল্লাহ আল ওমর, একুশে টেলিভিশনের আবাসিক সম্পাদক রফিকুল বাহার। প্যানেল আলোচনা পরিচালনা করেন ইডিইউর সহকারী অধ্যাপক তাসমীম চৌধুরী।