
আধুনিক নগরায়ণের পটভূমিতে আমরা প্রতিনিয়ত হাজারো সুউচ্চ দালানকোঠা ও স্থাপনা প্রত্যক্ষ করি। দূর থেকে এসব ভবনকে হয়তো স্থির বা নিথর কাঠামো মনে হতে পারে। বর্তমানের অত্যাধুনিক স্থাপত্যশৈলী ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এই ধারণাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। আজকের ভবন আর নিছকই জড়বস্তু নয়; বরং এক একটি স্বয়ংক্রিয় ও বুদ্ধিমান সত্তা। নিজেদের নিরাপত্তা, স্থায়িত্ব এবং পরিবেশগত ভারসাম্যের জন্য নিরন্তর কাজ হচ্ছে এসব ভবনে। স্মার্ট ভবন ধারণা বিকাশের মাধ্যমে আমাদের জীবনযাত্রা আরও নিরাপদ, আরামদায়ক ও পরিবেশবান্ধব হয়ে উঠেছে।
স্মার্ট ভবন প্রযুক্তি ও নির্মাণকৌশলের সমন্বয়
সহজ কথায়, স্মার্ট ভবন হলো এমন এক স্থাপনা, যেখানে বিভিন্ন প্রযুক্তি নির্মাণকৌশল ও ভবন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ভবনকে পরিবেশবান্ধব ও ব্যবহারবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলে। শক্তি (এনার্জি) সাশ্রয় করে ভবনকে সুচারুরূপে কার্যকর করাই একটি স্মার্ট ভবনের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। এসব ভবনে বিভিন্ন সেন্সর, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ও ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) যন্ত্রের সমন্বয়ে একটি কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা সিস্টেম (সেন্ট্রালাইজড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম) কাজ করে। এই সিস্টেম ভবনের অভ্যন্তরের বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যে আলোকসজ্জা, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, বায়ু চলাচল, নিরাপত্তাব্যবস্থা ও শক্তি ব্যবহারকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো ভবনের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি, শক্তি সাশ্রয়, নিরাপত্তা জোরদার করা ও বসবাসকারীদের জন্য একটি অনুকূল ও আরামদায়ক পরিবেশ তৈরি করা।
নানা ধরনের স্মার্ট টুলসের ব্যবহার
স্মার্ট ভবনে ব্যবহৃত বিভিন্ন প্রযুক্তিগত টুলসগুলোকে আমরা ভবনের প্রাণ বলতে পারি। আলোক ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে। সূর্যের আলোর সর্বোচ্চ ব্যবহারকে নিশ্চিত করার মাধ্যমে ভবনে একটি প্রাকৃতিক পরিবেশ রাখা হয়। এ ছাড়া স্মার্ট আলোব্যবস্থায় এলইডি লাইটিং, ডেলাইট হার্ভেস্টিংসহ বিভিন্ন সেন্সর ব্যবহার করা হয়।
স্মার্ট এইচভিএসি সিস্টেম ব্যবহার করা হয় এখন। ঐতিহ্যবাহী এসি ব্যবস্থার তুলনায় স্মার্ট এইচভিএসি সিস্টেম তাপমাত্রা, আর্দ্রতা এবং কার্বন ডাই–অক্সাইডের মাত্রা পরিমাপের জন্য সেন্সর ব্যবহার করে।
ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) যন্ত্রের ব্যবহার করা হয় এখন। আইওটি যন্ত্রগুলো ভবনের বিভিন্ন সেন্সর এবং যন্ত্রকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সংযুক্ত করে। এটি রিয়েল-টাইম ডেটা সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণের সুবিধা দেয়। এতে ভবনের কর্মক্ষমতা নিরীক্ষণ করা যায় কার্যকরভাবে। একটি স্মার্ট ভবনে সংযুক্ত ক্যামেরা, স্মোক ডিটেক্টর, দরজা-জানালার সেন্সর থাকে। এসব আইওটি নেটওয়ার্কের অংশ।
এখন বিভিন্ন ভবনে বিল্ডিং অটোমেশন সিস্টেম (বিএএস) ব্যবহার করা হচ্ছে। এই ব্যবস্থা স্মার্ট ভবনের মস্তিষ্কস্বরূপ। এর মাধ্যমে ভবনের প্রতিটি উপাদান একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে ও সামগ্রিক কর্মক্ষমতাকে অপ্টিমাইজ করতে পারে।
শক্তি সাশ্রয় ও পরিবেশগত প্রভাব
স্মার্ট ভবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এর শক্তি সাশ্রয়ী বৈশিষ্ট্য। স্মার্ট সিস্টেম ঐতিহ্যবাহী ভবনের তুলনায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে শক্তি সাশ্রয় করতে পারে। ডেটা বিশ্লেষণ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার করে ভবনের শক্তি খরচ প্যাটার্ন বোঝা যায়। সে অনুযায়ী অপচয় রোধ করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এটি শুধু বিদ্যুৎ বিলই কমায় না, কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমাতেও সহায়তা করে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তাবলয়
স্মার্ট ভবনগুলোর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কৌশল অনেক উন্নত। অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, ধোঁয়া শনাক্তকরণ ও এবং স্বয়ংক্রিয় স্প্রিঙ্কলার সিস্টেম ঐতিহ্যবাহী ভবনগুলোর চেয়ে দ্রুত ও কার্যকরভাবে কাজ করে। কোনো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ইন্টিগ্রেটেড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফায়ার অ্যালার্ম বাজানো, নির্দিষ্ট অঞ্চলের দরজা লক করা, বায়ু চলাচল সিস্টেম বন্ধ করা যায়।
চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও ভবিষ্যতের প্রয়োজনীয়তা
স্মার্ট ভবন নির্মাণে প্রাথমিক বিনিয়োগ কিছুটা বেশি মনে করেন অনেকে। দীর্ঘ মেয়াদে এ ধরনের ভবন শক্তি সাশ্রয়, উন্নত নিরাপত্তা ও উন্নত জীবনযাত্রার মান নিশ্চিত করে। আধুনিক ও নিরাপদ জীবনযাপনের জন্য স্মার্ট ভবন এখন বলা যায় সময়ের দাবি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুরক্ষিত, টেকসই রাখতে স্থাপত্য, প্রকৌশল এবং প্রযুক্তির অসাধারণ মেলবন্ধন প্রয়োজন। সেই দিকেই আমাদের কাজ করতে হবে।
মোহাম্মদ ফয়েজ উল্লাহ
স্থপতি। প্রতিষ্ঠাতা, ভলিউমজিরো লিমিটেড
ই–মেইল: foyez@volumezeroltd.com