‘শতবর্ষে স্মরণ: ইলা মিত্র ও তেভাগা আন্দোলন’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে (বাঁ থেকে) মতিউর রহমান, হাসনাত কাইয়ূম, আনু মুহাম্মদ, সামিনা লুৎফা ও ফওজিয়া মোসলেম। ডেইলি স্টার কার্যালয়, ৮ নভেম্বর ২০২৫
‘শতবর্ষে স্মরণ: ইলা মিত্র ও তেভাগা আন্দোলন’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে (বাঁ থেকে) মতিউর রহমান, হাসনাত কাইয়ূম, আনু মুহাম্মদ, সামিনা লুৎফা ও ফওজিয়া মোসলেম। ডেইলি স্টার কার্যালয়, ৮ নভেম্বর ২০২৫

জন্মশতবর্ষ আলোচনা

ইলা মিত্র এক কিংবদন্তি, অনুপ্রেরণার উৎস

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোলের ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনের বিপ্লবী নেত্রী ইলা মিত্র এক কিংবদন্তির নাম। তিনি কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সাহসিকতার যে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন, তা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি থাকবেন অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে। জন্মশতবর্ষে তাঁকে স্মরণ করে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তারা এভাবে ইলা মিত্রের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

শনিবার বিকেলে রাজধানীর দ্য ডেইলি স্টার সেন্টারে ‘শতবর্ষে স্মরণ: ইলা মিত্র ও তেভাগা আন্দোলন’ শীর্ষক এই অনুষ্ঠান হয়। ডেইলি স্টার দেশের ইতিহাসে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের স্মরণ করে ‘ইতিহাস আড্ডা’ নামে ধারাবাহিক অনুষ্ঠান আয়োজন করছে। এর তৃতীয় অনুষ্ঠানটি হলো ইলা মিত্রকে নিয়ে। ইতিহাস আড্ডায় এর আগে আলোচনা হয়েছে ঢাকার বিদ্রোহী নবাব শামসউদ্দৌলা ও শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হককে নিয়ে।

শনিবার অনুষ্ঠানের সূচনা করে ডেইলি স্টারের স্পেশাল কনটেন্ট এডিটর সামসুদ্দোজা সাজেন বলেন, ইতিহাসের উজ্জ্বল চরিত্রগুলোর অবদান নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য এই ধারাবাহিক আড্ডার কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে। এরপর ইলা মিত্রকে নিয়ে কবি গোলাম কুদ্দুসের কবিতা আবৃত্তি করেন ইমরান হোসেন।

এবারের আয়োজনের বিশেষ আলোচক ছিলেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। তিনি তাঁর আলোচনায় ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা, ইলা মিত্রের কাজ, তেভাগা আন্দোলন ও বাম রাজনীতির বিকাশ এবং বর্তমান প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করেন।

‘শতবর্ষে স্মরণ: ইলা মিত্র ও তেভাগা আন্দোলন’ শীর্ষক আয়োজনে বিশেষ আলোচক হিসেবে বক্তব্য দেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। ডেইলি স্টার কার্যালয়, ৮ নভেম্বর ২০২৫

তেভাগা আন্দোলন চলাকালে ১৯৪৮ সালে সন্তানের জন্মের জন্য ইলা মিত্রের গোপনে কলকাতায় যাওয়া, সন্তান নরেন মিত্রের জন্মের মাত্র ১৬ দিন পর ফিরে আসা, তাঁর বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেপ্তার, পুলিশের ভয়াবহ নির্যাতনের পর ইলা মিত্রের ঢাকায় চিকিৎসা ও পরে প্যারোলে মুক্তির পর কলকাতায় চলে যাওয়ার মর্মস্পর্শী ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরেন মতিউর রহমান।

কলকাতায় ইলা মিত্রের ১৯৫৭ সালে স্নাতকোত্তর পাস করে শিক্ষকতা ও রাজনীতিতে যুক্ততা, স্বাধীনতার পর তাঁর বাংলাদেশ আসা, ইলা ও রমেন মিত্রের সঙ্গে সখ্যের নানা ঘটনার স্মৃতিচারণা করেন মতিউর রহমান। তিনি বলেন, ‘ইলা মিত্র এখনো একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ, নারীর মর্যাদা ও মানুষের সাহসী নেতৃত্বের প্রতীক হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।’

পরে আলোচনায় অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ইলা মিত্র দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যে আন্দোলন করেছিলেন, তা ছিল গৌরবজনক। একই সঙ্গে এই কারণে তিনি নারকীয় নির্যাতন সহ্য করেছেন। তিনি পুরুষতান্ত্রিক ও সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। আনু মুহাম্মদ বলেন, তরুণ প্রজন্ম অনেক সময় মনে করে, অতীতে কেউ কিছু করেনি। নিজেদের বড় করে দেখার প্রবণতা তারুণ্যের মধ্যে থাকে। সে কারণে তাদের সামনে অতীতের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলোকে সামনে নিয়ে আসা প্রয়োজন।

গত বছরের গণ-অভ্যুত্থানের পর বৈষম্যহীন রাজনৈতিক পরিবেশের যে প্রত্যাশা ছিল, তা যেন এখন আটকে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, পূর্ব বাংলার তেভাগা আন্দোলনের কিংবদন্তির নাম ইলা মিত্র। তাঁর জীবনসঙ্গী রমেন মিত্র ছিলেন দুজনে দুজনের পরিপূরক।

রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনে প্রধান সমন্বয়কারী হাসনাত কাইয়ূম বলেন, তেভাগা আন্দোলনের ইতিহাস ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়, সে কারণেই ইলা মিত্রও স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তিনি বলেন, এখনো বাংলার কৃষকেরা তাঁদের ফসলের ন্যায্যমূল্যের অধিকারের জন্য আন্দোলন করছেন। গাইবান্ধায় এখনো সাঁওতালরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। ইলা মিত্রের সংগ্রাম আজও প্রাসঙ্গিক।

‘ইতিহাস আড্ডা’য় অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের একাংশ। ডেইলি স্টার কার্যালয়, ৮ নভেম্বর ২০২৫

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সামিনা লুৎফা বলেন, ‘ইলা মিত্র শুধু কমিউনিস্ট আন্দোলন বা কৃষক আন্দোলনই করেননি, তিনি নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যও আন্দোলন করেছেন। মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি করেছিলেন। এক শতাব্দী পেরিয়ে এসেও এখনো আমরা নারীর সুরক্ষার কথা বলছি, সাঁওতালদের অধিকার, কৃষকের অধিকারের কথা বলছি। এখনো তিনি প্রেরণার উৎস।’

আলোচনার পরে ছিল আলোচকদের সঙ্গে শ্রোতাদের কথোপকথন পর্ব। অনুষ্ঠানে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনাম উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন কবি ইমরান মাহফুজ।

ইলা মিত্রের জন্ম ১৯২৫ সালের ১৮ অক্টোবর, কলকাতায়। বাবা নগেন্দ্রনাথ সেন ছিলেন অবিভক্ত বাংলার ডেপুটি অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল। মা মনোরমা সেন। ইলা মিত্র ছিলেন তিন বোন, তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড়। পড়ালেখা করেছেন কলকাতার বিখ্যাত বেথুন স্কুলে। সেখান থেকে ১৯৪০ সালে ম্যাট্রিকুলেশন, ১৯৪২ সালে বেথুন কলেজ থেকে আইএ এবং ১৯৪৪ সালে অনার্সসহ বিএ পাস করেন। এর ১৪ বছর পর ১৯৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে এমএ পাস করেন।

ইলা মিত্র

ছাত্রজীবনেই ইলা মিত্র রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলেন। পর্যায়ক্রমে তিনি যুক্ত হন গার্লস স্টোরস কমিটি, ছাত্র ফেডারেশন, মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে। ইলা মিত্রের আরেকটি পরিচয় তাঁর সংগ্রামী ভূমিকার আড়ালে পড়ে গেছে। শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন একজন দক্ষ ক্রীড়াবিদ। প্রথম দিকে অ্যাথলেটিক, পরে সাঁতারে তুখোড় ছিলেন। প্রথম বাঙালি নারী হিসেবে তিনি ১৯৪০ সালে জাপান অলিম্পিকে অংশগ্রহণের জন্য নির্বাচিত হন। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে অলিম্পিক বাতিল হয়ে যাওয়ায় তাঁর অংশগ্রহণ করা হয়নি। খেলাধুলা ছাড়াও গান, অভিনয়েও পারদর্শী ছিলেন।

স্নাতক পাসের পরই ইলা মিত্রের বিয়ে হয়েছিল তৎকালীন মালদহের চাঁপাইনবাবঞ্জ থানার রামচন্দ্রপুরের জমিদার মহিম চন্দ্র মিত্রের ছেলে রমেন্দ্রনাথ মিত্রের সঙ্গে। বিয়ের পর তিনি শ্বশুরবাড়ি চলে আসেন। প্রাতিষ্ঠানিক পড়ায় তখন একটা লম্বা বিরতি পড়ে। তবে সময়টি নিষ্ক্রিয় যায়নি।

ইলা মিত্র গ্রামের নারীদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্বামীর সহযোগিতায়। ফসলের দুই-তৃতীয়াংশের ওপর কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে গড়ে ওঠা তেভাগা আন্দোলনে নাচোলে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রাখেন। ‘হিরোশিমার মেয়ে’সহ সাতটি বই অনুবাদ করেছেন। ইলা মিত্র মারা যান ২০০২ সালে।