ইলিশ ধরার মৌসুম চলছে। কিন্তু পটুয়াখালীর মহিপুর নদীবন্দরের জেলে সিদ্দিক মাঝি (৫৩) হতাশ। এ বছর সাতবার সমুদ্রে গিয়েও তিনি প্রত্যাশা অনুযায়ী মাছ পাননি। সর্বশেষ ১০ দিনের জন্য মাছ ধরতে গিয়ে তাঁর খরচ হয়েছে প্রায় ছয় লাখ টাকা। মাছ বিক্রি করে লাভ পেয়েছেন সামান্য। এর আগে ছয়বার মাছ ধরতে গিয়ে যে খরচ হয়েছে, সেই টাকা ওঠেনি বলে তিনি জানিয়েছেন।
আগে ভরা মৌসুমে মহিপুর থেকে বঙ্গোপসাগরের মোহনার কাছেই পাওয়া যেত বড় ইলিশ। কিন্তু এখন বড় মাছের খোঁজে অনেক গভীরে যেতে হয়, তাতে জ্বালানিসহ অন্যান্য খরচ বাড়ে। সিদ্দিক মাঝি বলেন, ‘এবারের মতো এমন কম মাছ আগে দেহি নাই। সাত-আষ্ট বছর হইলো মাছের গতিক ভালো না। বড় মাছ পাইতে অনেক দূরে যাইতে অয়।’ ২০-২৫ বছর আগের কথা মনে করে তিনি বলেন, ‘তখন নৌকা ভর্তি হইরে ইলিশ আনতাম। সেই ইলিশ সেই সময়েই ১০ থেকে ১২ লাখ টাকায় বেচা হইতে। মালিক খুশি থাকত, আমরাও থাকতাম।’
এবারের মতো এমন কম মাছ আগে দেহি নাই। সাত-আষ্ট বছর হইলো মাছের গতিক ভালো না। বড় মাছ পাইতে অনেক দূরে যাইতে অয়।সিদ্দিক মাঝি
সিদ্দিক মাঝির মতো আরও অনেক জেলের কাছে সবকিছু যেন অচেনা হয়ে গেছে। মহিপুর, আলীপুর, ভোলা ও কক্সবাজারের একাধিক জেলের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইলিশের উৎপাদন কমার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে।
প্রজনন মৌসুমে ইলিশ ধরা বন্ধ, জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান বা সহায়তা ইত্যাদি নানা উদ্যোগে কয়েক বছর দেশে ইলিশ উৎপাদন বেড়েছিল। সরকারের দেওয়া হিসাবের সঙ্গে অবশ্য বাস্তবের মিল কতটা, তা নিয়ে অনেকেরই সন্দেহ ছিল বা আছে। কিন্তু খোদ মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাবেই দেখা গেছে, গত মৌসুমে অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আগের বছরের চেয়ে অন্তত ৭ শতাংশ উৎপাদন কম হয়েছে।
দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের প্রায় ১২ শতাংশই আসে ইলিশ প্রজাতি থেকে। উপকূলীয় জেলেদের জীবিকা, গ্রামীণ বাজারের প্রাণচাঞ্চল্য, এমনকি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে এর ভূমিকা অপরিসীম। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইলিশের উৎপাদন কমে যাচ্ছে, যার পেছনে রয়েছে একাধিক প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণ।
প্রাকৃতিক কারণগুলোর মধ্যে প্রথমেই আছে জলবায়ু পরিবর্তন। বঙ্গোপসাগরের পানির তাপমাত্রা ক্রমেই বাড়ছে, যা ইলিশের প্রজনন ও বর্ধনের জন্য অনুকূল নয়। উজানের নদীগুলোর প্রবাহ কমে যাওয়া, বিশেষত শুকনা মৌসুমে, ইলিশের স্বাভাবিক মাইগ্রেশন বা চলাচল বাধাগ্রস্ত করছে। মেঘনার মোহনায় ডুবোচরের সংখ্যা বাড়ায় ইলিশের চলাচলের প্রধান পথগুলো সংকুচিত হচ্ছে। এ ছাড়া নদী ও উপকূলীয় অঞ্চলের দূষণ, বিশেষত শিল্পবর্জ্য ও প্লাস্টিকের প্রভাব, ইলিশের আবাসস্থল ও খাদ্যশৃঙ্খলকে হুমকির মুখে ফেলেছে। অতিরিক্ত আহরণ এবং এতে কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকাও ইলিশের উৎপাদন কমে যাওয়ার পেছনে ভূমিকা রাখছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
ইলিশের সঙ্গে এত পুরোনো পরিচয় বাঙালির, কিন্তু মাছটির সম্পর্কে এখনো অনেক কিছু অজানা। এমন মন্তব্য ইলিশের জিন রহস্যের প্রথম উন্মোচনকারী বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. শামসুল আলমের। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ইলিশ কিন্তু খুব সংবেদনশীল চরিত্রের মাছ। এর জন্ম সাগরে, কিন্তু ডিম ছাড়ার জন্য তাকে সাগর ছেড়ে মিঠাপানিতে আসতে হয়। আবার সেই ছোট বা জাটকা ইলিশ সাগরে চলে যায়। ইলিশের জন্ম ও বেড়ে ওঠার জন্য তাই পানি দূষণমুক্ত ও পরিচ্ছন্ন হওয়া বাঞ্ছনীয়। ভালো পরিবেশ না পেলে ইলিশ কিন্তু বিমুখ হয়ে যায়। ভিন্ন পথে চলে যায়।
ইলিশ স্বভাবগতভাবে পরিযায়ী মাছ। সমুদ্র থেকে নদী আর নদী থেকে সমুদ্র অবিরাম তার চলাচল। কিন্তু ইলিশের সেই পথে বাধা আসছে।
দেশে এক দশক ধরে ধারাবাহিকভাবে ইলিশ আহরণ বাড়ছিল। কিন্তু মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ইলিশ আহরণ ৪২ হাজার টন কমেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে ইলিশ আহরণ হয় ৫ লাখ ৭১ হাজার টন। গত অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৫ লাখ ২৯ হাজার টন। ইলিশ কি সত্যিই তাহলে ভিন্ন পথে চলে যাচ্ছে?
চাঁদপুর জেলার ষাটনল থেকে লক্ষ্মীপুর জেলার চর আলেকজান্ডারের ১০০ কিলোমিটার, ভোলা জেলার মদনপুর থেকে চর পিয়াল ৯০ কিলোমিটার, ভোলার ভেদুরিয়া থেকে পটুয়াখালী জেলার চর রুস্তমের ১০০ কিলোমিটার, পটুয়াখালীর আন্ধারমানিক জেলার ৪০ কিলোমিটার, শরীয়তপুরের পদ্মার নিম্নাংশের ২০ কিলোমিটার আর বরিশালের হিজলার ৮২ কিলোমিটার—এই ৪৩২ কিলোমিটার এলাকা ইলিশের অভয়াশ্রম হিসেবে চিহ্নিত। সেই অভয়াশ্রমেই ইলিশ কি নিরাপদ?
চাঁদপুরের মৎস্য বণিক সমিতির সভাপতি আবদুল বারী জমাদারের কয়েক পুরুষের মাছের ব্যবসা। তাঁর ধারণা, ইলিশ তার বিচরণক্ষেত্রেই এখন নিরাপদ নয়। তিনি বলছিলেন, শুধু এ বছর নয়, প্রায় চার বছর ধরেই ক্রমাগতভাবে ইলিশের উৎপাদন কম হচ্ছে। আর এ বছরের উৎপাদন গতবারের অন্তত অর্ধেক।
ইলিশের বড় বিস্তার এখন মেঘনা ও এর উপকূলজুড়ে। কিন্তু সেখানে বড় বড় প্রতিবন্ধকতা ইলিশের গতিপথকে রুদ্ধ করে ফেলছে বলে গবেষকদের অনেকেই বলছেন।
বারী জমাদার বলেন, নদীর কিছু জায়গায় নাব্যতা বলে কিছু নেই। নৌকা আটকে যায়। মাছ আসবে কোথা থেকে?
ইলিশ স্বভাবগতভাবে পরিযায়ী মাছ। সমুদ্র থেকে নদী আর নদী থেকে সমুদ্র অবিরাম তার চলাচল। কিন্তু ইলিশের সেই পথে বাধা আসছে।
সম্প্রতি মৎস্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে মেঘনা, তেঁতুলিয়া ও পদ্মা নদীতে মোট ১৭টি স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে, যেগুলোতে মা ইলিশ ও জাটকার যাতায়াত বাধাগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে মেঘনা নদীতেই রয়েছে ১৪টি স্থান। দুটি পদ্মা নদীর আর একটি তেঁতুলিয়া নদীর। ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালী, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী ও শরীয়তপুর জেলার মধ্যে পড়েছে এসব এলাকা।
মা ইলিশ ও জাটকার ‘ইলিশ মাইগ্রেশন রুট’ সম্পর্কিত সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, মেঘনা-তেঁতুলিয়া নদীর মোহনা, চাঁদপুর, ভোলা, পটুয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরের নানা অংশে অসংখ্য ডুবোচর ও চর ইলিশের স্বাভাবিক যাতায়াত ব্যাহত করছে। স্থানীয় জেলেরা জানান, আগের মতো আর মাছ উজানে ওঠে না। বর্ষাকালে প্রবল স্রোতের সময় কিছুটা ইলিশ এলেও শুষ্ক মৌসুমে নদী অনেকটা ফাঁকা।
ভোলার দৌলতখান, পটুয়াখালীর দশানাচর বা চাঁদপুরের হাইমচর—সব জায়গাতেই একই কথা, ‘পানি কম, চর বেশি, মাছও কম।’
মৎস্য গবেষক ও ময়মনসিংহের বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশরাফুল আলম বলেন, ‘নদীর নাব্যতা কমে যাওয়াই এর অন্যতম কারণ। মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর মোহনায় ডুবোচরের সংখ্যা সাম্প্রতিক দশকে বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। জোয়ারে কিছুটা ডুবে গেলেও ভাটায় এই চরগুলো মাছের গতিপথ বন্ধ করে দেয়। বিশেষত মা ইলিশের ডিম ছাড়ার মৌসুমে নদীর স্রোতের সঙ্গে মিল রেখে উজানে যাত্রা বাধাগ্রস্ত হয়। এমনকি জোয়ারের পানিতেও চর পেরোতে গিয়ে অনেক মাছ জালে আটকা পড়ে।’
জেলেদের বর্ণনায় জানা যায়, এই ডুবোচর শুধু ইলিশ নয়, নৌযান চলাচলও ব্যাহত করছে। ঝড় বা খারাপ আবহাওয়ার সময় দ্রুতগতির ট্রলারগুলো চর বা ডুবোচরে ধাক্কা খেয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়, নষ্ট হয় ইঞ্জিন ও নৌযান।
লক্ষ্মীপুরের জেলে আবদুর রহমান জানান, অনেক সময় মাছ ধরতে গিয়ে চর ঘুরে যেতে হয়, তাতে সময় ও খরচ দুটোই বাড়ে।
ইলিশের জীবনচক্রে নদীর গভীরতা ও পানির স্বচ্ছতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডুবোচর ও চর বৃদ্ধি পেলে গভীরতার ঘাটতি তৈরি হয়, আর দূষণ পানির স্বচ্ছতা নষ্ট করে। উজানের নদীগুলোর পানির প্রবাহ কমে যাওয়াও একটি বড় সংকট বাংলাদেশের নদীগুলোর জন্য। ভারত ও নেপালের বিভিন্ন বাঁধ ও পানি প্রত্যাহারের ফলে পদ্মা, যমুনা ও মেঘনা নদীর প্রবাহ বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে ব্যাপকভাবে কমেছে। প্রবাহ কমে গেলে নদীতে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ বাড়ে, যা ইলিশের স্বাভাবিক অভিবাসন চক্র ব্যাহত করে।
আমেরিকান জার্নাল অব ক্লাইমেট চেঞ্জ নামক সাময়িকীতে ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড অ্যানথ্রোপোজেনিক ইন্টারফেয়ারেন্সেস ফর দ্য মরফোলজিক্যাল চেঞ্জেস অব দ্য পদ্মা রিভার ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, বৃষ্টিপাতের ধরনে পরিবর্তনের ফলে বন্যার ধরনে যে পরিবর্তন ঘটে, তা পদ্মা নদীর ভূ-আকৃতিকে প্রভাবিত করতে পারে। বৃষ্টিপাতের অস্বাভাবিকতা নদীর পলির পরিমাণও বদলে দেয়। ফলে নদীকে তার প্রবাহের ধরন ও ভূ-আকৃতিগত বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মানিয়ে নিতে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে।
ইলিশ বলতে পদ্মার ইলিশকেই মনে করা হতো একসময়। কিন্তু পদ্মার সেই সুদিন আর নেই। নদীটি এখন অনেক বেশি বিপর্যস্ত। নদীর প্রবাহে টান পড়ায় ইলিশের উৎপাদন যে অনেক কমে গেছে, তা পাওয়া গেছে এশিয়ান ফিশারিজ সায়েন্স নামের সাময়িকীতে।
তাপমাত্রা বৃদ্ধির এই বৈশ্বিক প্রবণতায় বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদ বিশেষ করে ইলিশ খাত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এখনো হচ্ছে, তা বলাই যায়।জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশীদ
ইলিশ–গবেষক আনিছুর রহমান বলেন, যদি পদ্মার হার্ডিঞ্জ সেতুর কাছে পানির প্রবাহ ৩৮ থেকে ৪০ শতাংশ কমে যায়, তাহলে ইলিশের প্রাপ্যতা বা উৎপাদন অন্তত ২৬ শতাংশ কমে যায়। দেখা গেছে, এ অবস্থায় পদ্মা ও মেঘনা অঞ্চলে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। পানির প্রবাহ যদি আরও কমে যায়, তবে ইলিশের ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়তে বাধ্য।
যখনই নদীতে মিঠাপানির প্রবাহ কমে আসে, তখন সাগর-সংলগ্ন নদী এলাকায় লবণাক্ততা বাড়ে। মেঘনার মোহনায় জরিপে দেখা গেছে, শুষ্ক মৌসুমে লবণাক্ততা বেড়ে ১০ পিপিটি পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে, যা ১০ বছর আগের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর এবং নরওয়েজিয়ান মেটিওরোলজিক্যাল ইনস্টিটিউটের একটি যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের প্রায় সর্বত্র বৃষ্টির পরিমাণ কমে গেছে। আর সেই সঙ্গে বেড়েছে তাপমাত্রা।
গবেষণা অনুযায়ী, ১৯০১ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের বার্ষিক গড় তাপমাত্রা প্রায় ২°সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০৫০ সালের মধ্যে এ অঞ্চলের গড় সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বর্তমানের তুলনায় প্রায় ১ দশমিক ২ থেকে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি হতে পারে। ইলিশের প্রজনন ও বর্ধনের জন্য আদর্শ তাপমাত্রা ২৬ থেকে ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রা বেড়ে গেলে ডিম ফোটার হার কমে যায়, বাচ্চা মাছের মৃত্যুহার বেড়ে যায়, আর খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত প্ল্যাঙ্কটনের গুণগত মানও বদলে যায়।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশীদ বলেন, ‘তাপমাত্রা বৃদ্ধির এই বৈশ্বিক প্রবণতায় বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদ বিশেষ করে ইলিশ খাত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এখনো হচ্ছে, তা বলাই যায়।’
এই গবেষক বলেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি কেবল মানুষের জীবনযাত্রাই নয়, ইলিশের মতো শীতল পানির প্রাণীর জীবনধারণকেও কঠিন করে তুলছে। পানির তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ইলিশ তার প্রজনন ও বিচরণ ক্ষেত্র পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছে, যা তাদের জীবনচক্রের স্বাভাবিক ধারাকে ব্যাহত করে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, সাধারণত মে মাসের শেষের দিক থেকে জুনের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই কক্সবাজার উপকূলীয় এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে মৌসুমি বায়ু প্রবেশ করে। আর সেপ্টেম্বরের মধ্যে এই বায়ু সরে যেতে থাকে। গবেষণার তথ্য থেকে জানা যায়, ২০০০ সালের পর থেকে কখনো কখনো বর্ষা আসতে জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ হয়ে যাচ্ছে। গত বছর বর্ষা এসেছে ৮ জুন। একইভাবে বর্ষা যাচ্ছেও দেরি করে। গত ১০ বছরে কখনো কখনো ২৩ অক্টোবর পর্যন্তও মৌসুমি বায়ুর প্রভাব ছিল।
বর্ষার মৌসুমে কম বৃষ্টি আবার অন্য সময়ে বেশি বৃষ্টি ইলিশের প্রজননে জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করেন খ্যাতনামা ইলিশ–গবেষক আনিছুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্ষাকালে কম বৃষ্টি, সেই সঙ্গে উষ্ণতা ইলিশের প্রজননকে নিঃসন্দেহে প্রভাবিত করছে। এটা আমাদের জন্য ভালো খবর নয়।’
বাংলাদেশে তাপমাত্রা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সামগ্রিকভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধির একটি প্রবণতা রয়েছে। গবেষণার ফল বলছে, পদ্মা নদীর কাছে চাঁদপুর স্টেশনে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার ক্ষেত্রে এই বৃদ্ধি তুলনামূলকভাবে বেশি। বার্ষিক বৃষ্টিপাতের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা সবচেয়ে বেশি ছিল (+১০ মিমি প্রতিবছর) বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের পার্বত্য জেলাগুলোতে। তবে রাজশাহী, বগুড়া, ঈশ্বরদী, ঢাকা, ফরিদপুর, কুমিল্লা, সাতক্ষীরা ও বরিশাল স্টেশনগুলোতে বার্ষিক বৃষ্টিপাত কমে আসার প্রবণতা পাওয়া গেছে (০.৩০ থেকে−৭.৯৩ মিমি প্রতিবছর)।
শিল্পবর্জ্য, কৃষিতে অতিরিক্ত কীটনাশক ও প্লাস্টিক বর্জ্যের কারণে নদীতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাচ্ছে, যা মাছের শ্বাসপ্রশ্বাস ও খাদ্য সংগ্রহে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ইলিশের অন্যতম অভয়াশ্রম চাঁদপুরের ষাটনল থেকে লক্ষ্মীপুরের চর আলেকজান্ডারে প্রায় তিন বছর ধরে অন্তত একবার করে মাছের মড়ক দেখা দিয়েছে। কিন্তু গত শুকনা মৌসুমে দুই দফায় মাছের মড়ক দেখা যায়।
পদ্মা ও মেঘনা নদীতে ইলিশের বিচরণক্ষেত্রে পানির গুণগত মানের অবনতি হচ্ছে। সেই সঙ্গে কমছে ইলিশের জন্য প্রয়োজনীয় খাবারের পরিমাণ। বিশেষজ্ঞ ও গবেষকেরা বলছেন, এর ফলে ইলিশ উৎপাদনের ওপর একসময় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ইতিমধ্যে নদীতে ইলিশের উৎপাদন কমে গেছে। এর অন্যতম কারণ, দূষণ।
ইলিশের যেসব বিচরণক্ষেত্র আছে, সেসব স্থানে পানির মান দীর্ঘ সময় ধরে পর্যবেক্ষণ করে আসছে চাঁদপুরে অবস্থিত সরকারের মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট নদী কেন্দ্র। এ প্রতিষ্ঠানের গবেষকেরা প্রতিবছর পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন (ডিও-ডিসলভ অক্সিজেন), পিএইচ, পানি ও বায়ুর তাপ, হার্ডনেস (ক্ষারত্ব), অ্যামোনিয়ার পরিমাণ ইত্যাদি দেখেন।
গবেষণায় ২০টি ইলিশের নমুনা নেওয়া হয়েছিল। সব কটিতেই ১০টি করে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। গবেষণার আরেক গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এখানে ইলিশে পাওয়া গেছে সিসা, ক্যাডমিয়াম, পারদ, আর্সেনিক ও ক্রোমিয়াম। এগুলোর সবই ভারী ধাতু।
পানির মান বিচারে অন্যতম নিয়ামক হলো পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন বা ডিও। যদি ডিওর পরিমাণ প্রতি লিটারে পাঁচ মিলিগ্রামের কম হয়, তবে তা জলজ পরিবেশের জন্য কম উপযোগী বলে বিবেচিত হয়। দেখা গেছে, পদ্মায় গত পাঁচ বছরে ডিওর মান কমেছে। ২০১৮ সালে এ নদীর পানিতে ডিও-এর গড় মান ছিল ৮ দশমিক ৭০। এর পর থেকে কমছে প্রায় প্রতিবছর। ২০২২ সালে ডিও-এর মান ছিল ৫ দশমিক ৪১।
এরই মধ্যে ইলিশের শরীরে মাইক্রো প্লাস্টিকের নমুনা খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এ নিয়ে গত এপ্রিলে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক খ্যাতনামা বিজ্ঞান সাময়িকী ওয়াটার, এয়ার, অ্যান্ড সয়েল পলিউশন-এ। গবেষণাটি করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অ্যাকুয়াটিক জুওলজি রিসার্চ গ্রুপ এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের একদল বিজ্ঞানী।
গবেষণায় ২০টি ইলিশের নমুনা নেওয়া হয়েছিল। সব কটিতেই ১০টি করে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। গবেষণার আরেক গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এখানে ইলিশে পাওয়া গেছে সিসা, ক্যাডমিয়াম, পারদ, আর্সেনিক ও ক্রোমিয়াম। এগুলোর সবই ভারী ধাতু।
প্রাকৃতিক বাধার পাশাপাশি মানুষের কর্মকাণ্ডও সমানভাবে দায়ী ইলিশের উৎপাদন কমে যাওয়ার জন্য। এটা যেমন গবেষকেরা মানেন, তেমনি মানেন জেলেরাও। আধুনিক জালের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, বিশেষ করে ‘কারেন্ট জাল’ও বড় ফাঁদের মতো চর জাল, নদীর জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করছে। এই জালগুলো এত সূক্ষ্ম যে জাটকা থেকে শুরু করে ছোট মাছ পর্যন্ত ধরা পড়ে যায়। ফলে মাছ প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই ভবিষ্যতের সম্ভাব্য প্রজননশীল মজুত ধ্বংস হয়ে যায়।
পটুয়াখালীর মহীপুরের জেলে নেপাল হালদার বলেন, ‘এহন জলের নিচে জালের রাজত্ব। যেয়ানে যাবেন সেয়ানে জাল।’ দিন যত যাচ্ছে, ইলিশ বা মাছ ধরার ব্যবসায় পুঁজির লগ্নি বাড়ছে। আর আসছে অত্যাধুনিক সব জাল। ৬ সেন্টিমিটারের কম ব্যাসার্ধের জালে এখন নদীর তলদেশ ভরা। তাই কেবল ইলিশের জাটকাই যে আটকা পড়ে তা নয়, নষ্ট হয় বিপুল মৎস্যসম্পদ।
এহন জলের নিচে জালের রাজত্ব। যেয়ানে যাবেন সেয়ানে জাল।পটুয়াখালীর মহীপুরের জেলে নেপাল হালদার
আগে জালের বহর বড়জোর হাজার মিটার হতো। এখন দুই থেকে তিন হাজার মিটার লম্বা জালও পেতে রাখা হয়। নেপাল হালদারের মতো জেলেদের কাছে এ এক বড় বিড়ম্বনা। আবার মাছের জন্য বিপদ। তিনি বলেন, ‘নদীর এধার থেকে ওধার পুরোটাই জাল দে ঘিরে ফেলা হয়। যাওয়ার জায়গা পাইবে না মাছ।’
সমুদ্রে বা নদীতে বিস্তর এলাকাজুড়ে মাছ ধরার জালের বিস্তৃতি বড় এক সমস্যারও জন্ম দিয়েছে। মৎস্য আহরণের ক্ষেত্রে ঘোস্ট ফিশিং বা ভৌতিক মৎস্য আহরণ বলে একটি পদবাচ্য আছে। নদীতে বা সাগরে পাতা জাল অনেক সময় পরিত্যক্ত হয়ে সেখানে পড়ে থাকে। অনেক সময় মাছ ধরার নৌকা ডুবে যায় বা অন্য যেকোনো কারণে নদী বা সাগরের জাল সেখানেই রয়ে যায়। এভাবে জাল পড়ে থাকলে তাতে আটকা পড়ে অনেক মাছ ও জলজ প্রাণী। এটা ভৌতিক মৎস্য আহরণ। কেউ ইচ্ছে করে মাছ আহরণ না করলেও স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা হয়ে যায়।
মৎস্য অধিদপ্তরের পটুয়াখালী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. কামরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভৌতিক মৎস্য আহরণের প্রভাব মারাত্মক। এটা এখন আমাদের উপকূলের একটা বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে।’
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক সাজেদুল হক তিন বছর ধরে এসব জাল সংগ্রহ ও সমুদ্রের দূষণ রোধে একটি প্রকল্পের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিন বছরে ১৩ হাজার কেজি জাল উদ্ধার করা হয়েছে। এসব নদী বা সাগরে পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল।
সাজেদুল হক বলেন, মেঘনার উপকূল শুধু নয়, কক্সবাজার, লক্ষ্মীপুর—সবখানেই পাওয়া গেছে পরিত্যক্ত জাল। আর সেই সঙ্গে প্লাস্টিক ও অন্যান্য ক্ষতিকর দ্রব্য তো পাওয়া যাচ্ছেই।
মহীপুর ও আলীপুর মৎস্য বন্দরে স্থানীয় মানুষের মাছ ধরার বড় নৌকার সংখ্যা এখন প্রায় ২০০। এ নদীর জেলে মো. নুরু মাঝি অন্তত ৪৫ বছর ধরে মাছ ধরছেন। তিনি জানান, ২০ বছর আগেও এখানে নৌকার সংখ্যা ছিল ২০টি। অতিরিক্ত আহরণ ও অনিয়ন্ত্রিত শিকার ইলিশের জন্য বিপদ ডেকে আনছে।
এখন বিভিন্ন উপকূলে ছোট আকারের নৌযান অন্তত ৩০ হাজার এবং বড় আকারের নৌযানের সংখ্যা অন্তত ৮ হাজার। বছরের কয়েক দফায় নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ না থাকলে ইলিশ ধরতে কারও বাধা নেই। এভাবে অনিয়ন্ত্রিত মৎস্য আহরণ কতটা ঠিক?
গবেষকেরা মনে করেন, বর্তমানে গড়ে প্রায় ছয় লাখ মেট্রিক টন ইলিশ ধরা হয়। এই পরিমাণটা অতিরিক্ত। এখন ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ইলিশ বেশি ধরা হয় বলে মনে করেন ইলিশ–গবেষক আনিছুর রহমান। এটা বন্ধ করে নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
কিন্তু সাগরে গিয়ে একটি নৌযান কতটা মাছ ধরবে, তা কি নির্দিষ্ট করা সম্ভব?
ইলিশের সংকট থেকে উত্তরণের জন্য একটি সমন্বিত ও টেকসই মডেল প্রয়োজন বলে মনে করেন গবেষকেরা। এই মডেলের মূল ভিত্তি হবে ইলিশের প্রজনন ও জীবনচক্র সম্পর্কে বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা এবং সে অনুযায়ী নীতি নির্ধারণ। গবেষণার মাধ্যমে ইলিশের নতুন প্রজননক্ষেত্র ও বিচরণক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করা এবং সেগুলোকে অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা করা জরুরি। ইলিশ সংরক্ষণে প্রযুক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। জিপিএস ট্র্যাকিং সিস্টেম ব্যবহার করে ইলিশের চলাচল পর্যবেক্ষণ করা এবং ইলিশ আহরণকারী নৌযানগুলোর ওপর নজরদারি রাখা সম্ভব। এ ছাড়া অত্যাধুনিক ড্রোন প্রযুক্তির মাধ্যমে অভয়াশ্রমগুলোতে অবৈধ মাছ ধরা প্রতিরোধ করা যেতে পারে।