দিনে নতুন করে ৬২ কোটি ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়ার কথা। যুক্ত হয়েছে মাত্র ৯ কোটি ঘনফুট।

দেশে কয়েক বছর ধরে গ্যাসের সংকট চলছে। চড়া দামে এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানি করেও চাহিদা পূরণ করা যাচ্ছে না। দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন টানা কমছে। তাই দেশে গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন বাড়াতে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে উন্নয়ন, সংস্কার ও অনুসন্ধান মিলে ৫০টি কূপের কাজ শেষ করার কথা। এখন পর্যন্ত শেষ হয়েছে মাত্র ২০টির কাজ।
বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) সূত্র বলছে, চার বছরে ৫০টি কূপে কাজ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয় ২০২২ সালে। বিগত সরকারের সময় থেকেই এটি ধীরগতিতে এগোয়। অন্তর্বর্তী সরকার আসার পর গতি বাড়ালেও প্রকল্প অনুমোদন ও দরপত্রে পিছিয়ে যায় কাজ। এটি শেষ করার আগেই আরও ১০০টি কূপ খনন প্রকল্পের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে।
খনন শুরুর পর অনুসন্ধান বা উন্নয়ন কূপের কাজ শেষ করতে লাগে অন্তত সাড়ে তিন মাস। সংস্কার কূপ খননে লাগে দুই মাস। একাধিক বিদেশি কোম্পানিকে দিয়ে কাজ করাতে পারলে হয়তো বেশি কূপ খনন করা সম্ভব।
পেট্রোবাংলা বলছে, ৫০টি কূপের কাজ শেষে দিনে নতুন করে ৬২ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদনে যুক্ত হওয়ার কথা। ২০টি কূপের খনন শেষে দিনে ২১ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদনের সুযোগ তৈরি হয়েছে। যুক্ত হয়েছে মাত্র ৯ কোটি ঘনফুট। ছয়টি কূপের কাজ চলছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানির (বাপেক্স) পাঁচটি রিগ (খননযন্ত্র) ও চুক্তিতে নিয়োজিত কোম্পানির দুটিসহ সাতটি রিগ কাজে আছে। ডিসেম্বরের মধ্যে চুক্তিতে নিয়োজিত কোম্পানির আরও তিনটি রিগ কাজে যুক্ত হবে। এরপর একসঙ্গে ১০টি রিগ খননের কাজ করবে।
দেশের খনিজ সম্পদ উত্তোলনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা পেট্রোবাংলা। তাদের অধীন থাকা তিনটি কোম্পানি গ্যাস উত্তোলনে যুক্ত—বাপেক্স, বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড (বিজিএফসিএল) ও সিলেট গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড (এসজিএফএল)। এর মধ্যে একমাত্র বাপেক্সের কূপ খননের সক্ষমতা আছে। আর বাকি দুটি কোম্পানি ঠিকাদার নিয়োগ করে কাজ করায়।
তাড়াহুড়া করে নেওয়া হয় প্রকল্প
গত এক যুগে দেশে গ্যাস অনুসন্ধানে জোর দেওয়া হয়নি। সরবরাহ ঘাটতি মেটাতে ২০১৮ সাল থেকে শুরু হয় এলএনজি আমদানি। বিশ্ববাজারে দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় ২০২২ সালের জুলাই থেকে টানা সাত মাস খোলাবাজার থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ করে দেয় সরকার। দেশে গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে ওই সময় তাড়াহুড়া করে নেওয়া হয় ৫০টি কূপ বাস্তবায়নের প্রকল্প।
তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করা যাবে না বলে সে সময় শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। পেট্রোবাংলা ও তিন কোম্পানির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, বছরে সর্বোচ্চ দুই থেকে তিনটি কূপ খননের অভিজ্ঞতা আছে বাংলাদেশের। কূপ খননে ডিপিপি অনুমোদনেই লাগে এক বছরের বেশি। জমি অধিগ্রহণ ও যন্ত্রপাতি কিনতে লাগে কয়েক মাস। খনন শুরুর পর অনুসন্ধান বা উন্নয়ন কূপের কাজ শেষ করতে লাগে অন্তত সাড়ে তিন মাস। সংস্কার কূপ খননে লাগে দুই মাস। একাধিক বিদেশি কোম্পানিকে দিয়ে কাজ করাতে পারলে হয়তো বেশি কূপ খনন করা সম্ভব।
৪৮টি কূপের ডিপিপি অনুমোদন হয়ে গেছে, মাত্র দুটি বাকি আছে। এরই মধ্যে ২০টি কূপের কাজ শেষ হয়েছে। নভেম্বরে দুটি ও ডিসেম্বরে চারটি কূপের কাজ শেষ করার কথা। বাকি কাজ আগামী বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান মো. রেজানুর রহমান
পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, দরপত্র ছাড়াই চীন, উজবেকিস্তান ও রাশিয়ার তিনটি কোম্পানিকে কূপ খননের কাজ চূড়ান্ত করেছিল বিগত সরকার। অন্তর্বর্তী সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন বাতিল করে। দরপত্র ডেকে চুক্তি করায় সময় বেশি লেগেছে। তবে আগের চেয়ে খরচ অনেক কমে গেছে।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান মো. রেজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ৪৮টি কূপের ডিপিপি অনুমোদন হয়ে গেছে, মাত্র দুটি বাকি আছে। এরই মধ্যে ২০টি কূপের কাজ শেষ হয়েছে। নভেম্বরে দুটি ও ডিসেম্বরে চারটি কূপের কাজ শেষ করার কথা। বাকি কাজ আগামী বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।
আগামী বছরেও কাজ শেষ হবে না
এসজিএফএলের ১৬টির মধ্যে শেষ হয়েছে ৯টির কাজ। বিজিএফসিএলের ১৪টির মধ্যে শেষ হয়েছে তিনটির। তবে সবচেয়ে বেশি ২০টি কূপ খননের কথা বাপেক্সের। এর মধ্যে আটটি কূপের কাজ শেষ হয়েছে। একটির কাজ চলছে। আরও পাঁচটি কূপ খননে চীনের কোম্পানি সিনোপ্যাকের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। বাপেক্স বলছে, আগামী বছরের মধ্যে সব কূপ শেষ করা যাবে না।
স্থলভাগে গ্যাসকূপ খননের যখন এই অবস্থা, তখন সমুদ্রে অনুসন্ধান আরও পিছিয়ে। সমুদ্রে অনুসন্ধান কার্যক্রম চলছে না। নতুন করে দরপত্র আহ্বান করতে উৎপাদন অংশীদারি চুক্তির খসড়া তৈরি করে জ্বালানি বিভাগে পাঠানো হয়েছে। তবে দরপত্র আহ্বানের কাজটি রাজনৈতিক সরকারের হাতে ছেড়ে দিতে চায় জ্বালানি বিভাগ।
নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই ৫০টি কূপের কাজ শেষ করা সম্ভব ছিল। সরকার পরিবর্তনের পর প্রক্রিয়া বদলে গেছে। কূপ খননে আরও বেশি জোর দেওয়া উচিত। বিশেষ করে অনুসন্ধান কূপ খনন করে গ্যাস আবিষ্কারে বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার।ভূতত্ত্ববিদ বদরূল ইমাম
দেশে দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। বর্তমানে সরবরাহ করা হচ্ছে ২৭০ থেকে ২৮০ কোটি ঘনফুট। এদিকে স্থলভাগের গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন বছর বছর কমছে। বিদেশ থেকে চাইলেও ১১০ কোটি ঘনফুটের বেশি আমদানি করা সম্ভব নয়। কারণ, এলএনজি রূপান্তর ও সঞ্চালনে বিদ্যমান অবকাঠামোর সক্ষমতা অতটুকুই। তাই গ্যাস–সংকট কাটাতে গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন বাড়ানোর বিকল্প নেই বলে মত বিশেষজ্ঞদের।
ভূতত্ত্ববিদ বদরূল ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই ৫০টি কূপের কাজ শেষ করা সম্ভব ছিল। সরকার পরিবর্তনের পর প্রক্রিয়া বদলে গেছে। কূপ খননে আরও বেশি জোর দেওয়া উচিত। বিশেষ করে অনুসন্ধান কূপ খনন করে গ্যাস আবিষ্কারে বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার।