একসময়ের দূরালাপনের একমাত্র ভরসা টেলিফোনের সেই জৌলুশ নেই। সেই জায়গা করে নিয়েছে মুঠোফোন।

১৯৯২ বা ৯৩ সালের দিকে ১০ হাজার টাকা দিয়ে একটি টেলিফোন সংযোগ নিয়েছিলেন মঞ্জুলা চৌধুরী। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত এই অধ্যাপকের কাছে টেলিফোনটি ছিল আত্মীয়স্বজন, কর্মস্থলসহ দূরালাপনের একমাত্র ভরসা। এখন অবশ্য অতটা ভরসা না থাকলেও সেই টেলিফোনের সঙ্গে রয়েছে তাঁর আবেগ ও স্মৃতির টান।
৩০ বছর আগে যেতে হবে না, ১৭ বছর আগেও টেলিফোন ছিল বেশির ভাগ মানুষের দূরালাপনের মূল মাধ্যম। উনিশ শতকের আবিষ্কার টেলিফোন একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসেই চাহিদা হারাতে শুরু করে। তবে টেলিফোন এখনো টিকে আছে। হয়তো আরও কিছুকাল থাকবে।
টেলিফোনটি বাদ দেওয়ার ইচ্ছা আছে কি না জানতে চাইলে মঞ্জুলা চৌধুরী বলেন, এর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটা স্মৃতির, আবেগের। এ ছাড়া এতে জড়িয়ে আছে স্বামীর স্মৃতিও। তাই সংযোগটি তিনি রেখে দেবেন।
মঞ্জুলা চৌধুরীর টেলিফোনটি আগে প্রায় সারাক্ষণই ব্যস্ত থাকত। এখনো হয়তো দু-একবার বেজে ওঠে। সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ বা দাপ্তরিক কাজে যেখানে টেলিফোন আছে, সেখানে তিনি এখনো এই ফোনই ব্যবহারের চেষ্টা করেন। বললেন, টেলিফোনে কথা শোনা যায় খুব স্পষ্ট। এর সঙ্গে ইন্টারনেট সংযোগও আছে। খরচও কম। টেলিফোনটি বাদ দেওয়ার ইচ্ছা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটা স্মৃতির, আবেগের। এ ছাড়া এতে জড়িয়ে আছে স্বামীর স্মৃতিও। তাই সংযোগটি তিনি রেখে দেবেন।
১৭ মে বিশ্ব টেলিযোগাযোগ ও তথ্য সংঘ দিবস। দিবসটি উপলক্ষে গতকাল শুক্রবার বাণী দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। বাসসের খবর অনুযায়ী, বাণীতে তিনি বলেছেন, জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা ধারণ করে অন্তর্বর্তী সরকার ডিজিটাল রূপান্তরের সব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান সুযোগ ও অধিকার নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, টেলিযোগাযোগ সেবা, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারসহ ডিজিটাল রূপান্তরে নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণ বৈষম্যমুক্ত ও আধুনিক সমাজ বিনির্মাণের পূর্বশর্ত।
বিটিসিএল সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সাল পর্যন্ত দেশে টেলিফোনের গ্রাহক ছিল ৩ লাখের কিছু বেশি, ১০ বছর আগেও যা ছিল ৭ লাখের বেশি।
বিটিটিবি থেকে বিটিসিএল
টেলিফোন একসময় পরিচিত ছিল টিঅ্যান্ডটি ফোন নামে। বাংলাদেশ তার ও টেলিফোন বোর্ডের (বিটিটিবি) অধীনে টেলিফোন সেবাদান কার্যক্রম পরিচালিত হতো। তখন বিটিটিবি ছিল দেশের টেলিযোগাযোগ সেবার একমাত্র প্রতিষ্ঠান। বিটিটিবি বিলুপ্ত করে ২০০৮ সালে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) গঠন করা হয়। টেলিযোগাযোগের আরও কিছু কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে সরকার। পাশাপাশি বেসরকারি খাতেও টেলিযোগাযোগ ব্যবসার বিস্তার ঘটে। এতে একসময়ের দাপুটে টিঅ্যান্ডটি ধীরে ধীরে তার জৌলুশ হারায়।
দেশে টেলিফোনের গ্রাহকের সংখ্যাসহ এ-সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য জানতে চেয়ে বিটিসিএলে ১৪ মে লিখিত প্রশ্ন দেওয়া হলেও প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে বিটিসিএল সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সাল পর্যন্ত দেশে টেলিফোনের গ্রাহক ছিল ৩ লাখের কিছু বেশি, ১০ বছর আগেও যা ছিল ৭ লাখের বেশি।
গ্রাহক কমার সঙ্গে সঙ্গে এক সময়কার লাভজনক এই সেবা খাত থেকে রাজস্বও কমছে। বিটিসিএলের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের স্বাধীন নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত টেলিফোন থেকে রাজস্ব আয় ছিল ৯৪ কোটি ৪৯ লাখ টাকার বেশি। এর আগের অর্থবছরেই যা ছিল প্রায় ১০৯ কোটি টাকা। টেলিফোন থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব আয় ছিল প্রায় ২২৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ গ্রাহকের সঙ্গে এই খাতে রাজস্ব আয়ও দ্রুত কমছে।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্য অনুযায়ী, দেশে গত মার্চ পর্যন্ত মুঠোফোন গ্রাহকের সংখ্যা ছিল ১৮ কোটি ৬২ লাখের বেশি (এক ব্যক্তির একাধিক সিম থাকতে পারে)।
মুঠোফোন এসে কমে টেলিফোনের কদর
দেশে মুঠোফোনসেবা চালু হয় ১৯৯৩ সালে। তবে প্রথম দিকে মুঠোফোনসেবা সহজলভ্য ছিল না। উচ্চবিত্তরাই মুঠোফোন কেনার সামর্থ্য রাখতেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মুঠোফোন এখন হাতে হাতে। মুঠোফোন সহজলভ্য হওয়ায় টেলিফোনের চাহিদা কমে এসেছে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্য অনুযায়ী, দেশে গত মার্চ পর্যন্ত মুঠোফোন গ্রাহকের সংখ্যা ছিল ১৮ কোটি ৬২ লাখের বেশি (এক ব্যক্তির একাধিক সিম থাকতে পারে)।
চাহিদা তুঙ্গে থাকার সময় টেলিফোন সংযোগের জন্য আবেদন করে দু-তিন মাস অপেক্ষা করতে হতো। তবে এখন আবেদনের পর তিন কার্যদিবসের মধ্যেই সংযোগ পাওয়া যায়। বিটিসিএলের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকাসহ নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে একটি টেলিফোন সংযোগ নিতে খরচ হয় দুই হাজার টাকা। চট্টগ্রামে ১ হাজার এবং অন্যান্য শহরে মাত্র ৬০০ টাকা। বিটিসিএলের একটি সংযোগে থেকে আরেকটিতে টেলিফোন কলের বিল মাসে ১৫০ টাকা। অন্য অপারেটরে ৫২ পয়সা প্রতি মিনিটে।
বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মুনতাসির হাফিজ জানান, তাঁর বাসার টেলিফোন সংযোগের বয়স ৩০ বছরের বেশি। ছোটবেলার স্মৃতি মনে করে তিনি বলেন, মা-বাবা বা দাদা-দাদির অধীনেই থাকত ফোনটি। বন্ধুর কাছে একটু ফোন করার জন্য সুযোগ খুঁজতে হতো, কখন খালি পাওয়া যাবে।
বিটিসিএলের টেলিফোনের চাহিদা কমলেও দেশে অফিস-আদালত, করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোয় ইন্টারনেট টেলিফোনের চাহিদা রয়েছে। ইন্টারনেট প্রটোকল (আইপি) সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন ১০ লাখের মতো ইন্টারনেট টেলিফোন সংযোগ রয়েছে।
তরুণ প্রজন্ম টেলিফোনে অভ্যস্ত না হলেও প্রবীণেরা এখনো এটাকে আপন মনে করেন। বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মুনতাসির হাফিজ জানান, তাঁর বাসার টেলিফোন সংযোগের বয়স ৩০ বছরের বেশি। ছোটবেলার স্মৃতি মনে করে তিনি বলেন, মা-বাবা বা দাদা-দাদির অধীনেই থাকত ফোনটি। বন্ধুর কাছে একটু ফোন করার জন্য সুযোগ খুঁজতে হতো, কখন খালি পাওয়া যাবে।
নিজে টেলিফোন ব্যবহার না করলেও তাঁর বাবা এই টেলিফোনেই বেশি অভ্যস্ত বলে জানালেন এই শিক্ষক। বললেন, যেসব জায়গায় টেলিফোন আছে, সেখানে টেলিফোনেই কথা বলেন তাঁর বাবা। এ ছাড়া বিভিন্ন সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে এখনো টেলিফোনই তাঁর প্রথম পছন্দ। তবে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় আওয়ামী লীগ সরকার যখন পুরো দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়, তখন তাঁদের বাসায় এই টেলিফোনের কদর বেড়েছিল বলে জানালেন তিনি।