
বাংলাদেশে বিক্ষোভের এক প্রখ্যাত নেতার হত্যাকাণ্ড ঘিরে নতুন করে সহিংসতার প্রেক্ষাপটে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। আগামী বছরের শুরুর দিকে নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশ প্রস্তুতি নেওয়ার এই সময়ে রাজনৈতিক সহিংসতা ও নাগরিক সমাজের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে সংস্থাটি।
বাংলাদেশে গত বছরের বিক্ষোভের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি শরিফ ওসমান বিন হাদি হত্যার নিন্দা জানিয়ে এ ঘটনায় দায়ীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। একই সঙ্গে তিনি সবার প্রতি শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় শুক্রবার জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, জাতিসংঘের মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক নিয়মিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেছেন, জাতিসংঘের মহাসচিব ওসমান হাদি হত্যার ঘটনায় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের সঙ্গে সংগতি রেখে একটি ‘দ্রুত, নিরপেক্ষ, পুঙ্খানুপুঙ্খ ও স্বচ্ছ তদন্তের’ জন্য কর্তৃপক্ষগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছেন, যেহেতু বাংলাদেশ ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় সংসদ নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
শান্ত থাকার অনুরোধ জানিয়ে আন্তোনিও গুতেরেস সব পক্ষকে ‘সহিংসতা থেকে বিরত থাকতে, উত্তেজনা প্রশমন করতে এবং একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচনী পরিবেশ বজায় রাখতে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শন’ করার আহ্বান জানান।
এই হত্যাকাণ্ড জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্কেরও একই ধরনের উদ্বেগ তৈরি করেছে। তিনি বলেছেন, গত সপ্তাহে গুলিবিদ্ধ হয়ে ওসমান হাদির মৃত্যুর ঘটনায় তিনি ‘গভীরভাবে মর্মাহত’।
জেনেভা থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহির আহ্বান জানিয়ে ফলকার টুর্ক বলেন, ‘প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসা কেবল বিভাজনকেই গভীর করবে এবং সবার অধিকারকে ক্ষুণ্ন করবে।’
সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১২ ডিসেম্বর ঢাকা মহানগরীর একটি মসজিদ থেকে বের হওয়ার পর মুখোশধারী হামলাকীরারা ৩২ বছর বয়সী তরুণ নেতা ওসমান হাদিকে গুলি করে। চিকিৎসার জন্য তাঁকে বিমানে করে (এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে) সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়।
বৃহস্পতিবার ওসমান হাদির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, রাজধানীর রাস্তায় হাজারো বিক্ষোভকারী নেমে আসে এবং কিছু ভবনে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর চালানো হয়। কর্তৃপক্ষগুলো জানিয়েছে, প্রধান সংবাদপত্রগুলোর কার্যালয়সহ বেশ কিছু স্থাপনায় আগুন দেওয়া হয় এবং এই অস্থিরতার সময় সাংবাদিকদের লাঞ্ছিত করা হয় বলেও খবর পাওয়া গেছে।
‘আমি এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা সমুন্নত রাখতে এবং অস্থিরতার আরও বিস্তার রোধে পদক্ষেপ নিতে কর্তৃপক্ষগুলোর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’ফলকার টুর্ক, জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার
গত বছরের নাটকীয় রাজনৈতিক পরিবর্তনের পটভূমিতে এই অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে শুরু হওয়া আন্দোলন নিরাপত্তা বাহিনী এবং সরকার–সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর সহিংস দমন-পীড়নের মুখে পড়ে।
পরবর্তী সময়ে কোটা পদ্ধতি প্রত্যাহার করা হলেও ওই আন্দোলন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং বিক্ষোভ দমনে চালানো সহিংসতার বিচারের দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলনে রূপ নেয়।
আগস্টের শুরু নাগাদ পরিস্থিতির ব্যাপকভাবে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে ২০০৯ সাল থেকে টানা ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা (যিনি ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত মেয়াদেও দেশ শাসন করেন) ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।
জাতিসংঘের নেতৃত্বাধীন তদন্তে পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে, জুলাই ও আগস্টের বিক্ষোভের সময় অনেক শিশুসহ প্রায় ১ হাজার ৪০০ জন নিহত হয়ে থাকতে পারেন। আরও হাজার হাজার মানুষ আহত হন।
ওসমান হাদি ওই আন্দোলনের সবচেয়ে প্রখ্যাত নেতাদের একজন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, তিনি ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার পরিকল্পনা করেছিলেন।
নির্বাচনী প্রচার শিগগিরই শুরু হতে যাওয়ায় জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক প্রধান ফলকার টুর্ক জোর দিয়ে বলেছেন, এমন একটি পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি, যেখানে সবাই নিরাপদে ও শান্তিপূর্ণভাবে ‘পাবলিক লাইফে’ (নাগরিক জীবনে) অংশগ্রহণ করতে পারেন এবং অবাধে ভিন্নমত প্রকাশ করতে পারেন।
ফলকার টুর্ক আরও বলেন, ‘আমি এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা সমুন্নত রাখতে এবং অস্থিরতার আরও বিস্তার রোধে পদক্ষেপ নিতে কর্তৃপক্ষগুলোর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’