
প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ৯ লাখ মানুষ হেড অ্যান্ড নেক ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। যার মধ্যে প্রায় সাড়ে চার লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। এর মধ্যে দেখা গেছে, প্রায় ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ মানুষ, যাঁরা অপেক্ষাকৃত নিম্ন আর্থসামাজিক অবস্থায় বসবাস করেন, তাঁদের এ ধরনের ক্যানসারের প্রবণতা বেশি থাকে। প্রাথমিক অবস্থায় যদি শনাক্ত করা যায়, তবে এই ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর বেঁচে থাকার হার ৮৬ শতাংশ।
গত মঙ্গলবার অনলাইনে আয়োজিত ‘বিশ্বমানের ক্যানসার–চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক আলোচনায় এ কথাগুলো বলেন ডা. মো. তৌছিফুর রহমান।
ক্যানসার নিয়ে সবার মধ্যে সচেতনতা তৈরিতে এসকেএফ অনকোলজির আয়োজনে এ পর্বের আলোচনার বিষয় ছিল ‘হেড অ্যান্ড নেক ক্যানসার’। এর ঝুঁকি, চিকিৎসা, স্ক্রিনিং, প্রতিরোধ ইত্যাদি নিয়ে পরামর্শ দেন মেডিকেল অ্যান্ড রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট ও বগুড়া টিএমএসএস ক্যানসার সেন্টারের কনসালট্যান্ট ডা. মো. তৌছিফুর রহমান। উপস্থাপনায় ছিলেন নাসিহা তাহসিন। পর্বটি মঙ্গলবার সরাসরি প্রচারিত হয় প্রথম আলো ডটকম এবং প্রথম আলো, এসকেএফ অনকোলজি ও এসকেএফের ফেসবুক পেজে।
আলোচনার শুরুতেই উপস্থাপক জানতে চান, কারা হেড অ্যান্ড নেক ক্যানসারের ঝুঁকিতে রয়েছেন? উত্তরে ডা. মো. তৌছিফুর রহমান বলেন, সাধারণত হেড অ্যান্ড নেক ক্যানসার বলতে মানুষের মাথা থেকে ঘাড় পর্যন্ত নাক, নাকের গহ্বর, সাইনাস, ঠোঁট, জিব, মাড়ি, গালের ভেতরের অংশ, মুখের তালু, গলা, কণ্ঠনালি, শ্বাসনালির ওপরে, খাদ্যনালি, টনসিল, লালাগ্রন্থি ইত্যাদি অংশের ক্যানসারকে বোঝানো হয়। ঝুঁকির বিষয়ে তিনি বলেন, মূলত যাঁরা ধূমপান, মদ্যপান, পান–জর্দা, তামাক–গুল সেবন করেন, অনিয়ন্ত্রিত জীবনাচরণ ও খাদ্যাভ্যাস রয়েছে, পরিবেশ ও বেশি বয়সের দিকে গেলে এ ধরনের ক্যানসার হয়েছে, তাঁরা এর ঝুঁকিতে আছেন। এ ছাড়া ‘হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসে’ আক্রান্ত হলেও এই ক্যানসারের ঝুঁকি বেশি থাকে।
হেড অ্যান্ড নেক ক্যানসারের সঙ্গে মোকাবিলা করে বেঁচে থাকার হার কেমন? এ প্রসঙ্গে ডা. মো. তৌছিফুর রহমান বলেন, এটা ক্যানসারের তিনটি স্টেজের ওপর নির্ভর করে। যেমন প্রাথমিক অবস্থায় যদি থাকে, তবে ৮৬ শতাংশ, রোগীর শরীরে স্থানীয়ভাবে বিস্তৃত হলে ৬৯ শতাংশ, আর দূরবর্তী অঙ্গে যদি ক্যানসার ছড়িয়ে যায়, সে ক্ষেত্রে বেঁচে থাকার হার ৪০ শতাংশ।
হেড অ্যান্ড নেক ক্যানসারের প্রাথমিক লক্ষণগুলো সম্পর্কে ডা. মো. তৌছিফুর রহমান বলেন, এ ধরনের ক্যানসার বিস্তৃত জায়গাজুড়ে হয়ে থাকে। তাই স্থানভেদে এর লক্ষণ একেক জায়গায় একেক রকম হয়ে থাকে। মোটাদাগে বলতে চাই, গলায় দীর্ঘ সময় ধরে ব্যথা, গলায় গুটি হওয়া, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া, শ্বাস নিতে গেলে শব্দ হওয়া, গন্ধের অনুভূতি কমে যাওয়া, অতিমাত্রায় কাশি, দীর্ঘদিন সর্দি, নাক থেকে রক্তক্ষরণ, গলার স্বর পরিবর্তন হয়ে যাওয়া, কথা বলতে কষ্ট হওয়া, মুখে ব্যথা ও মুখ খুলতে সমস্যা, কানে ব্যথা, এক কানে শুনতে সমস্যা, দাঁতে ব্যথা ইত্যাদি। যদি দেখা যায়, এ ধরনের লক্ষণ দুই সপ্তাহেও সারছে না, সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
স্ক্রিনিং ও ডায়াগনসিসের মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে ডা. মো. তৌছিফুর রহমান বলেন, এটার পার্থক্য হলো উদ্দেশ্যে। স্ক্রিনিংয়ের জন্য রোগী আমাদের কাছে আসেন। আর স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে যখন কোনো আশঙ্কা হয় যে তাঁর শরীরে ক্যানসারের উপসর্গ পাওয়া গেছে, সেটাকে প্রতিরোধ ও চিকিৎসা দিতেই ডায়াগনসিস করা হয়ে থাকে।
হেড অ্যান্ড নেক ক্যানসারের কী ধরনের ডায়াগনসিস রয়েছে? উপস্থাপক জানতে চাইলে ডা. মো. তৌছিফুর রহমান বলেন, ‘যেকোনো ক্যানসারের জন্য আদর্শ পরীক্ষা হচ্ছে “হিস্টোপ্যাথলজি”। এর মাধ্যমে রোগীর জেনেটিক মিউটেশন আছে কি না এবং থেরাপি দরকার আছে কি না, এ সম্পর্কে নিশ্চিত হই। তারপর ইমেজিং টেস্টের মাধ্যমে স্টেজিং নির্ধারণ করি। অনেকে বলে থাকেন, ক্যানসার রোগীদের এত টেস্ট করা হয় কেন? মনে রাখতে হবে, চিকিৎসা শেষেও আমরা রোগীর অবস্থা জানার জন্য বিভিন্ন টেস্ট করি, যেখানে চিকিৎসার আগে ও পরের অবস্থা সম্পর্কে বোঝা যায়। এ জন্য কিছু টেস্ট আবার করতে হয়। আর এর প্রায় সবই বাংলাদেশে রয়েছে।’
হেড অ্যান্ড নেক ক্যানসারের চিকিৎসাপদ্ধতি সম্পর্কে ডা. মো. তৌছিফুর রহমান বলেন, ‘চিকিৎসার পদ্ধতিটা রোগীর ক্যানসারের পর্যায় ও কোন অংশে হয়েছে, তার ওপর নির্ভর করে। সাধারণত প্রথম পর্যায়ের ক্ষেত্রে আমরা সার্জারি করে থাকি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ের ক্ষেত্রে রেডিওথেরাপি বা কেমোথেরাপি দিয়ে থাকি। চতুর্থ পর্যায়ের ক্ষেত্রে কেমোথেরাপি দিলেই চলে। এ ক্ষেত্রে রেডিওথেরাপি ও সার্জারির প্রয়োজন হয় না। তবে দরকার হলে ইমিউনোথেরাপিও দিয়ে থাকি। তবে কোন ধরনের পদ্ধতিতে চিকিৎসা হবে, সেটি সিদ্ধান্ত নেবেন “মাল্টিডিসিপ্লিনারি মেডিকেল বোর্ড”। তাই চিকিৎসার জন্য কাউকে দেশের বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। দেশে থেকেই বিশ্বমানের চিকিৎসা করা সম্ভব।’