
আজ থেকে ঠিক ৫৩ বছর আগে ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের দীক্ষা নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। কেন, কীভাবে এই দল হলো, ভাঙন হলো কীভাবে, পরিণতি কেমন সেসব ফিরে দেখা যাক এই লেখায়।
১৯৭২ সালের ২০ মে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ, ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের মধ্যে বিবদমান দুই গ্রুপ আলাদা প্যানেল দেয়। নির্বাচন ছিল ৩ জুন। বঙ্গবন্ধুর ভাগনে শেখ ফজলুল হক মনি গ্রুপের পক্ষ থেকে শেখ শহিদুল ইসলামকে ভিপি ও মনিরুল হক চৌধুরীকে জিএস পদে মনোনয়ন দেওয়া হয়।
অন্যদিকে, সাবেক ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খানপন্থীরা ভিপি পদে জিনাত আলী ও জিএস পদে মোয়াজ্জেম হোসেন খান মজলিশকে প্রার্থী দেয়। নির্বাচনে ছাত্রলীগের দুটি প্যানেল হওয়ায়, ভোট ভাগ হয়ে যায়। ফলে, ছাত্র ইউনিয়নের মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও মাহবুব জামান ভিপি ও জিএস পদে বিজয়ী হন। ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগে পালটাপালটি বহিষ্কার হয়। সিরাজুল আলম খানের সমর্থকরা নূরে আলম সিদ্দিকীকে বহিষ্কার করে শরীফ নুরুল আম্বিয়াকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেন। অন্যদিকে শেখ মনির সমর্থকেরা শাজাহান সিরাজকে বহিষ্কার করে ইসমত কাদির গামাকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেন। সবশেষে ছাত্রলীগের বিভক্তি চূড়ান্ত হয় জাতীয় সম্মেলনকে কেন্দ্র করে।
১৯৭২ সালের ২১-২৩ জুলাই ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। সিরাজুল আলম খানের সমর্থনপুষ্টরা পলটন ময়দানে সম্মেলনের স্থান ঠিক করে। আর শেখ ফজলুল হক মনির সমর্থক মুজিববাদপন্থীরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্মেলনের স্থান ঘোষণা করে। উভয় গ্রুপ প্রধান অতিথি হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ঘোষণা করেন। উভয় গ্রুপই নিশ্চিত ছিল, বঙ্গবন্ধু তাদের সম্মেলনে যাবেন। ২১ জুলাই বঙ্গবন্ধু পলটন ময়দানে না গিয়ে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মুজিববাদ পন্থীদের সম্মেলনে যান। তাঁর সেই সিদ্ধান্তে হতবাক হন ছাত্রলীগের সিরাজ গ্রুপের নেতা–কর্মীরা।
মূলত : সেদিনই ছাত্রলীগ চূড়ান্তভাবে বিভক্ত হয়। পল্টনের সম্মেলনে কবি আল–মাহমুদ উপস্থিত ছিলেন। স্থানীয়দের মধ্যে গণসংগীত শিল্পী ফকির আলমগীর মুজিববাদকে কটাক্ষ করে একটি গান পরিবেশন করেন। গানের একটি লাইন ছিল, ‘একটি টাকা চালের দাম, মুজিববাদের অপর নাম।’(দাসগুপ্ত, স্বপন, ২০২৫)
কে এই সিরাজুল আলম খান ?
জাসদের সুপ্রিম লিডার ছিলেন সিরাজুল আলম খান। পার্টির মধ্যে সবাই তাকে ‘দাদাভাই’ বলে ডাকতেন। ছিলেন ‘নিউক্লিয়াস’–এর প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৬২ সালে ‘হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন’ রিপোর্টের বিরুদ্ধে ও পাকিস্তানে একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান তৈরির দাবিতে, দীর্ঘদিন ধরে ছাত্র আন্দোলন চলে।
সেই আন্দোলন সিরাজুল আলম খানের মধ্যে ‘স্বাধীনতার বীজ’ বপন করে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে জাগিয়ে তোলেন। আন্দোলন চলাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ইকবাল হলে (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক) স্বাধীনতা আন্দোলনের ‘অঙ্কুর’ সংগঠন হিসেবে সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ আহমদ ও আবুল কালাম আজাদ মিলে ‘স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস’ নামে বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলেন।
১৯৬৫ সালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা সিরাজুল আলম খান ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ৬ দফা আন্দোলনের অন্যতম কাণ্ডারি ছিলেন।
১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেন। এই উদ্যোগের মূল কারিগর ছিলেন সিরাজুল আলম খান।
মুক্তিযুদ্ধের সময় শেখ ফজলুল হক মনি,সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স, বিএলএফ। এর সদস্যরাই পরে পরিচিতি পান ‘মুজিব বাহিনী’ নামে।
স্বাধীন দেশের প্রথম দল ‘জাসদ’–এর আত্মপ্রকাশ
১৯৭২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবস উপলক্ষ্যে পলটন ময়দানে ছাত্রলীগের জনসভায় আ স ম আব্দুর রব একটা পার্টি গঠনের ইঙ্গিত দেন। (ইসলাম, নজরুল, ২০১৩)
১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর মেজর (অব.) এম এ জলিল এবং আ স ম আবদুর রবকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ঘোষণা করা হয়। এই দলে ৭ সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়।
পরদিন ১ নভেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকের শিরোনাম ছিল– ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠন।’ পত্রিকাটির খবরে বলা হয়, ‘দেশে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য এই দল সামাজিক বিপ্লব ঘটানোর চেষ্টা করিবে। এই দল সমাজতান্ত্রিক নীতির বাস্তবায়নকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত বলিয়া মনে করে।’
অন্যদিকে, জাসদের মুখপত্র গণকণ্ঠ পত্রিকায় ১ নভেম্বর এম এ জলিল ও আ স ম রবের হাস্যোজ্জ্বল ছবি দিয়ে লিড নিউজ করে। পত্রিকাটির শিরোনাম ছিল–‘শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের লড়াইয়ের শপথে উদ্দীপ্ত নতুন রাজনৈতিক সংগঠন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল।’ তাদের রিপোর্টে বলা হয়– ‘রক্তেরঞ্জিত বাংলার লক্ষ কোটি মেহনতি মানুষের শোষণ, বঞ্চনা, হতাশার গ্লানি অবসানের সংগ্রামী শপথে উদ্দীপ্ত অগণিত মানুষের হৃদয় উৎসারিত সমর্থন ও আশীর্বাদ নিয়ে বিপ্লবী প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে বাংলার রাজনৈতিক গগনে উদিত এক নতুন রাজনৈতিক সংগঠন–জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল।’
গণকণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলা হয়–‘বাংলার রাজনৈতিক গগনে নতুন সূর্য।’
প্রথম সাতজনকে নিয়ে জাসদের যে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছিল তারা হলেন– আ স ম আবদুর রব, এম এ জলিল, শাজাহান সিরাজ, সুলতান উদ্দীন আহমদ, বিধান কৃষ্ণ সেন, নূরে আলম জিকু ও মোহাম্মদ রহমত আলী। এদের মধ্যে নূরে আলম জিকু ও শাজাহান সিরাজ ছিলেন ছাত্রলীগের সাবেক নেতা। সুলতান উদ্দীন আহমদ ও বিধান কৃষ্ণ সেন দুজনেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত হয়েছিলেন। রহমত আলী ছিলেন জাসদে তাজউদ্দীন আহমদের ‘নমিনি।’ তিনি অবশ্য একদিনও জাসদে থাকতে পারেননি। শেখ ফজলুল হক মনির লোকেরা রহমত আলীকে অপহরণ করে তাঁর কাছ থেকে একটি বিবৃতি আদায় করে নেয়। এতে তিনি লিখেছিলেন, ‘জাসদের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই।’(আহমদ, মহিউদ্দিন, ২০২৪)
‘জাসদের প্রধান তাত্ত্বিক নেতা ও চিন্তাবিদ সিরাজুল আলম খানের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তাঁর অপ্রকাশ্য তাত্ত্বিক নেতৃত্ব, দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা, বাস্তব প্রেক্ষাপটে প্র্যাগমেটিক ও যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অভাব এবং সর্বোপরি রাজনীতিতে তাঁর স্বেচ্ছা নির্বাসন জাসদকে ক্রমান্বয়ে শক্তিহীন এবং জনগণের দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।অধ্যাপক আল মাসুদ হাসানুজ্জামান, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী
১৯৬২ সালে তৈরি হওয়া নিউক্লিয়াসের নেতা–কর্মীরাই যোগদান দেন জাসদের আহ্বায়ক কমিটিতে। ১৯৭২ সালের ১৩ নভেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবে আহ্বায়ক কমিটির প্রথম সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৭ নভেম্বর বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেটে হয় জাসদের প্রথম জনসভা। এতে মেজর (অব.) জলিল ও আ স ম আবদুর রব দুর্নীতি, ষড়যন্ত্র ও গুপ্তহত্যার অভিযোগ এনে বঙ্গবন্ধু সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন।
১৯৭২ সালের ২৩ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাসদের প্রথম কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ৫১ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি গঠিত হয়। এতে এম এ জলিল সভাপতি, আ স ম রব সাধারণ সম্পাদক ও শাজাহান সিরাজ যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন।
জাসদ গঠনের আগে তাজউদ্দীন আহমদকে নতুন দলে টানতে সিরাজুল আলম খান তাঁর পেছনে লেগেছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ ৩০ অক্টোবর সিরাজুল আলম খান ও আ স ম আব্দুর রবকে তাঁর বাসায় ‘চা–নাশতার দাওয়াত’ দেন । তারা শাজাহান সিরাজ, মোহাম্মদ শাহজাহান ও নূরে আলম জিকুকে সঙ্গে নিয়ে মিন্টো রোডে তাজউদ্দীন আহমদের বাসায় সারারাত আলোচনা করেন।
তাজউদ্দীনের সঙ্গে ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা ময়েজ উদ্দীন, মো. সিরাজুল ইসলাম, রহমত আলী ও রিয়াজুল হক। এক পর্যায়ে তাজউদ্দীন রীতিমতো ভেঙে পড়েন। তিনি বুঝতে পারছিলেন, আওয়ামী লীগে তিনি যথেষ্ট কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। অথচ এই বৃত্তের বাইরে যাওয়ার মতো সাহস তাঁর ছিল না। তিনি বললেন, বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে তাঁর কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। তবে কথা দেন, ‘নতুন দল গড়তে সিরাজুল আলম খানদের তিনি যতদূর সম্ভব সহায়তা দেবেন। (আহমদ, মহিউদ্দিন, ২০১৪)
‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ’নামটি কীভাবে এলো?
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল সংক্ষেপে জাসদ। দলের নামকরণ, পরিকল্পনা ও রণকৌশল এককভাবে করেছেন দলটির তাত্ত্বিক নেতা সিরাজুল আলম খান। নামকরণ নির্ধারণ করে পত্রিকায় প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠানো পর্যন্ত তিনি খুব কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন। যাতে এই নাম বেহাত হয়ে না যায়।
জাসদের রাজনীতির বিরোধিতাকারীরা সেই সময় বলতেন, জার্মানিতে হিটলারের ‘ন্যাশনাল স্যোশালিস্ট পার্টি’ থেকে উৎসাহিত হয়ে ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল’ নামটি নেওয়া হয়েছে।
তবে, বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়ার দাবি, ‘দেশ স্বাধীনের পরে কমিউনিস্ট পার্টি, সর্বহারা পার্টি, ন্যাপসহ বেশ কয়েকটি বামদল অ্যাকটিভ ছিল, যাদের আদর্শ ছিল কমিউনিজম। তারা ছিল সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। জাসদের উদ্যোক্তারা ভেবেছিলেন– দল গঠনের ক্ষেত্রে নতুনত্ব ও বৈচিত্র্যময় কিছু করতে হবে। তাই ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে ’বিশ্বাসী হয়ে দলের নাম দিয়েছিলেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল।’
জাসদের প্রথম হঠকারী সিদ্ধান্ত
১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলীর বাসভবন ঘেরাও করে জাসদ। ওই দিন ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫৪ তম জন্মবার্ষিকী। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে ১৭ মার্চ পল্টনে জনসভা করে জাসদ। সভাশেষে দলের সভাপতি এম এ জলিল ও সাধারণ সম্পাদক আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে নেতা–কর্মীরা মিছিল নিয়ে মনসুর আলীর মিন্টো রোডের সরকারি বাসা ঘেরাও করেন। ওই সময় মন্ত্রী কেরানীগঞ্জে ছিলেন। সন্ধ্যা পৌনে ছয়টার দিকে মিছিলকারীরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও করে স্লোগান দিতে থাকেন। তাঁরা বাড়ির লোহার গেটে আগুন ধরানোর চেষ্টা করেন ও ভেতরে ইটপাটকেলও ছোড়েন।
পুলিশও বাসার ভেতর থেকে কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ে মিছিলকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়; শুরু হয় সংঘর্ষ। এ সময় ঘটনাস্থলে আসেন রক্ষীবাহিনীর সদস্যরাও। এক পর্যায়ে পুলিশ বেশ কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে। পুলিশকে সহায়তা দিতে থাকে রক্ষীবাহিনী। তারা বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি করে। মেজর জলিল ও আ স ম রব, শাজাহান সিরাজ, মমতাজ বেগমসহ জাসদের অনেক নেতা–কর্মীকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ির সামনের রাস্তায় আহত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। ওই সময় পুলিশ জাসদের প্রায় অর্ধশত নেতা–কর্মীকে আটকও করে। সে সময়ই গুলিতে নিহত হন ৬ জন। (১৮ মার্চ ১৯৭৪, দৈনিক ইত্তেফাক)
‘গণবাহিনী’ গঠন
মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া বেসামরিক সদস্যদেরকে (ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, পেশাজীবী প্রভৃতি) গণবাহিনী বলা হতো। সেই গণবাহিনী থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে জাসদ সেনাবাহিনীর বিকল্প সশস্ত্র সংগঠন ‘গণবাহিনী’ গড়ে তোলে। এটি ছিল দলটির সশস্ত্র সংগঠন। স্বাধীন দেশে একটি দল এভাবে সশস্ত্র সংগঠন হিসেবে রূপ নেওয়ায় ওই সময়ে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল।
‘দ্বন্দ্ব, ভিন্নতা, পার্থক্য ইত্যাদি কারণে একদিকে দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অন্যদিকে মেহনতি মানুষের মুক্তির লড়াই দূরবর্তী হয়েছে। এটা আমাদের বড় ট্র্যাজেডি।’আ স ম আব্দুর রব, সভাপতি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি)
১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বরে সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগের পর কর্নেল আবু তাহেরের সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের যোগাযোগ গড়ে ওঠে। অক্টোবরে আ স ম আব্দুর রবের সঙ্গে তাহেরের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় তাহের নতুন দলের সিনিয়র সহ–সভাপতি হবেন। তবে কৌশলগত কারণে তাঁর নাম ঘোষণা করা হবে না। শুধু নেতৃবৃন্দই বিষয়টি সম্পর্কে জানবেন।
জাসদে সাংবিধানিকভাবে তাহেরের মূল দায়িত্ব ছিল সামরিক বাহিনীতে সংগঠন গড়ে তোলা। সে সময় জাসদ তার সশস্ত্র ফ্রন্ট হিসেবে গণবাহিনী গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়। গণবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হন কর্নেল (অব.) তাহের। (হোসেন, আনোয়ার, ২০১২)
জাসদ ‘নিষিদ্ধ’
এক সময়ে বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য নেতাদের দল জাসদ তাঁর শাসনামলেই নিষিদ্ধ হয়। ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ স্বাধীন দেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে ২৩৭ টি আসনে জাসদ প্রার্থী দিলে একটি বাদে সব আসনে পরাজিত হয়। একমাত্র নির্বাচিত হন টাঙ্গাইলের আব্দুস সাত্তার। পরে উপ–নির্বাচনে রাজশাহী থেকে জাসদ নেতা মইন উদ্দিন মানিক নির্বাচিত হন। এদিকে, চাঁদপুর থেকে স্বতন্ত্র নির্বাচিত এমপি আবদুল্লাহ সরকার জাসদে যোগ দেন। এতে পার্লামেন্টে জাসদের এমপি হন তিনজন।
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, বাকশাল গঠন করলে এতে যোগ দেন টাঙ্গাইলের আব্দুস সাত্তার। জাসদের অন্য দুই এমপি মইন উদ্দিন মানিক ও আবদুল্লাহ সরকার বাকশালে যোগ না দেওয়ায় বঙ্গবন্ধু তাঁদের উপর ভীষণ ক্ষুব্ধ হন। ফলে তাদের সংসদ সদস্য পদ বাতিল হয়ে যায়। একই সঙ্গে রাজনীতিতে জাসদকে ‘নিষিদ্ধ’ করা হয়।
‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’ গঠন
১৯৭৩ সাল থেকে জাসদ সভাপতি মেজর (অব.) জলিলের নেতৃত্বে ঢাকা সেনানিবাসের প্রায় সব ইউনিটে ও বগুড়া সেনানিবাসে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা গড়ে ওঠে। ঢাকার চারপাশে প্রায় ৪০টি স্থানে ঘাঁটি গঠন করে একটি পরিকল্পনা নেওয়া হয়। সেটি হলো– সেনাবাহিনীর মধ্যে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতৃত্বে সিপাহিদের অভ্যুত্থান এবং ঢাকাসহ শহর এলাকায় ছাত্র, যুবক ও শ্রমিকদের গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করা। এই সুযোগ আসে ১৯৭৫ এর নভেম্বরে।
অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য ছিল ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সংগঠিত সেনা অভ্যুত্থান ও এর প্রতিক্রিয়ায় সেনাবাহিনীতে যে অসন্তোষ হয়েছিল, সেই সুযোগ কাজে লাগানো।
তাহেরকে অভ্যুত্থানের নীলনকশা প্রণয়নের দায়িত্ব দিয়ে ৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় একটি বৈঠক হয়। সেখানে কর্নেল তাহের পুরো পরিকল্পনাটি তুলে ধরেন। সভা শেষে বিদায়ের সময় তাহের সবাইকে বলেন, রাত ঠিক ১টায় অভ্যুত্থান হবে।
অভ্যুত্থানের পর ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে এক ঘোষণায় বলা হয়েছিল– ‘বাংলাদেশের বীর বিপ্লবী জনগণ, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ও বিপ্লবী গণবাহিনীর নেতৃত্বে বাংলাদেশে সিপাহি জনতার বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করা হয়েছে। জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা হয়েছে।’
৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের সেনা প্রধান হওয়া ও জিয়াউর রহমানকে বন্দি করার বিষয়টি সাধারণ সৈনিক ও বেশিরভাগ অফিসার মেনে নিতে পারেননি। ৪, ৫ ও ৬ নভেম্বর অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি চলে। এর মধ্যেই বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার মাধ্যমে কর্নেল তাহেরের কাছে জিয়াউর রহমান বার্তা পাঠান, ‘তাহের আমাকে মুক্ত করো, আমাকে বাঁচাও।
জাসদের গোপন বিপ্লবী প্রক্রিয়া কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটি (সিওসি) ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, ৭ নভেম্বর ভোরে জিয়া ও তাহেরের নেতৃত্বে ক্যান্টনমেন্ট থেকে অফিসার ও সৈনিকরা ট্যাংক, সাঁজোয়া যান ও সামরিক যান নিয়ে শহীদ মিনারে যাবেন। একই সময়ে ছাত্র–যুবক ও শ্রমিকেরা শহীদ মিনারে যাবেন। সেখানেই বিপ্লবী কমান্ড কাউন্সিল গঠন ও সব দল, সৈনিক, শ্রমিক ও ছাত্র যুবকদের নিয়ে ‘জাতীয় সরকার’ গঠন করা হবে।
কিন্তু ক্যান্টনমেন্টে ওই সময় বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ছাড়াও স্বার্থান্বেষী আরো কিছু গোষ্ঠী দ্রুত সক্রিয় হয়ে উঠে। তারাই জিয়াকে তাদের পক্ষে নিতে সক্ষম হন। পরবর্তীতে সিওসি নেতাদের সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের অভাবে অভ্যুত্থান বেহাত হয়ে যায়। (পেয়ারা, শামসুদ্দিন, ২০২৩)
জাসদে প্রথম ‘ভাঙন’
১৯৭২–৭৮ সাল পর্যন্ত জাসদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির মূল্যায়ন রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। লিখেছিলেন মাহমুদুর রহমান মান্না। নাম ছিল–‘শুধুমাত্র সদস্যদের জন্য।’ এটির সারমর্ম হলো– জাসদ শুরুতে বিপ্লবী ধারায় গড়ে উঠেছিল। কিন্তু দলটি পরে বেশ কিছু হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে দক্ষিণপন্থি ধারায় পরিচালিত হয়। আওয়ামী লীগের সঙ্গে ১০ দলীয় ঐক্য গড়ে তোলা তারই লক্ষণ। সেখান থেকে বেরিয়ে বিপ্লবী ধারায় পরিচালিত না হলে, জাসদ বুর্জোয়াপন্থী দলে পরিণত হবে। সেই রিপোর্ট সমর্থন করায় জাসদের ১৩ জন নেতাকে দল থেকে বহিষ্কৃত হন।
বহিষ্কৃত নেতারা ১৯৮০ সালের ৭ নভেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবে এক ঘোষণার মাধ্যমে বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) গঠন করেন। কমরেড খালেকুজ্জামান ছিলেন সেই দলের আহ্বায়ক। সেই ১৩ জনের মধ্যে ৭ জন ছিলেন জাসদের কেন্দ্রীয় নেতা। তারা হলেন খালেকুজ্জামান, আবদুল্লাহ সরকার, আ ফ ম মাহবুবুল হক, একরামুল হক, হাবিবুল্লাহ চৌধুরী, মমতাজ বেগম ও মোস্তাফিজুর রহমান। এছাড়া, মবিনুল হায়দার চৌধুরী, মঈনুদ্দীন খান বাদল, শুভ্রাংশ চক্রবর্তী, মাহমুদুর রহমান মান্না, আবদুস সালাম (খুলনা) ও বাসদে যোগ দেন।
জাসদ আরেকবার হোঁচট খায় ১৯৮৪ সালে। ওই বছর ২০ অক্টোবর দলটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এম এ জলিল জাসদ ছেড়ে ‘জাতীয় মুক্তি আন্দোলন’ নামে নতুন একটি রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এর মাধ্যমে তিনি দেশে ইসলামি আন্দোলন শুরু করেন।
‘ভুল ছাড়া কোনো রাজনীতি হয় না। সব সিদ্ধান্তের মধ্যে কিছু ভুল ত্রুটি থাকে। সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক পরিপক্কতার ঘাটতি থাকায় দলে অত্যধিক ভাঙন হয়েছে। দলের নেতাদের অভিজ্ঞতারও ঘাটতি ছিল। নেতাদের বেশির ভাগেরই বয়স কম ছিল। তাই তারা বেশি ভুল করেছেন।’শরীফ নুরুল আম্বিয়া, সভাপতি, বাংলাদেশ জাসদ
১৯৮৪ সালের আরেকটি ধাক্কা খায় জাসদ। রাষ্ট্রপতি এরশাদের দেশব্যাপী উপজেলা নির্বাচন করার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেন আ স ম রব। এ নিয়ে দলের মধ্যে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়লে রব তাঁর দীর্ঘদিনের আস্থাভাজন নূরে আলম জিকুকে নিয়ে জাসদ (রব) গঠন করেন।
ভাঙা গড়ার খেলায় জাসদ আবারও মেতে ওঠে ১৯৮৬ সালে। ওই বছর ৭মে এরশাদের অধীনে অনুষ্ঠিত তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রশ্নে শাজাহান সিরাজ ও মির্জা সুলতান রাজা দল থেকে বের হয়ে আলাদা জাসদ গঠন করেন। সেই সময় জাসদের আরেকটি অংশের নেতৃত্বে ছিলেন কাজী আরেফ আহমেদ, শরীফ নুরুল আম্বিয়া ও হাসানুল হক ইনুসহ অন্যরা। এই অংশ ৫ দলীয় ঐক্যজোট গঠন করে।
জাসদ ‘গৃহপালিত বিরোধীদল’
স্বৈরশাসক এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চে চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বেশিরভাগ দল ভোট বর্জন করে। মাত্র ছয়টি দল নির্বাচনে অংশ নেয়। জাতীয় পার্টি ২৫২টি আসনে বিজয়ী হয়। অন্যদিকে, আ স ম রবের নেতৃত্বে জাসদের একাংশ, জাসদ (শাজাহান সিরাজ) ও ছোট ছোট দল ১৯টি আসন পেয়েছিল। সংসদ নেতা হন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ আর সম্মিলিত বিরোধীদলের নেতা হন আ স ম আব্দুর রব। চতুর্থ সংসদের এই বিরোধী দল তখন ‘গৃহপালিত’ খেতাব পেয়েছিল।
সংসদীয় রাজনীতিতে জাসদের অর্জন
১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত প্রথম সংসদ নির্বাচনে জাসদ মশাল প্রতীকে নির্বাচন করে ২৩৭টি আসনে প্রার্থী দিয়ে ১টি আসনে বিজয়ী হয়।
দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। এতে জাসদ ২৪০ টি আসনে প্রার্থী দিয়ে ৮টিতে বিজয়ী হয়।
১৯৮৬ সালের ৭মে অনুষ্ঠিত তৃতীয় সংসদ নির্বাচন অংশ নেয় জাসদ (রব) ও জাসদ (শাজাহান সিরাজ) । ১৩৭ টি আসনে প্রার্থী দিয়ে জাসদ (রব) পায় ৪টি আসন। অন্যদিকে, ১৪টি আসনে প্রার্থী দিয়ে জাসদ (সিরাজ) পায় ৩টি আসন।
১৯৮৮ সালের চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে আ স ম রবের নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত বিরোধী দল ২৬৯টি আসনে প্রার্থী দিয়ে ১৯ টিতে বিজয়ী হয়।
পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। সেই নির্বাচনে জাসদ (শাজাহান সিরাজ), জাসদ ( ইনু) ও জাসদ ( রব) অংশ নিলেও নির্বাচিত হন কেবল শাজাহান সিরাজ।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াত ভোট বর্জন করে। নির্বাচনে বিএনপির ৪৯ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।
১৯৯৬ সালের ১২ জুনের (সপ্তম সংসদ) নির্বাচনে জাসদ (রব) ৭৬ টি আসনে প্রার্থী দিয়ে একটি আসনে জয়ী হয়। ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত অষ্টম সংসদ নির্বাচনে জাসদের কোনো প্রার্থী বিজয়ী হতে পারেননি।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম সংসদ নির্বাচনে জাসদ (ইনু) ৬টি আসনে প্রার্থী দিয়ে ৩টিতে বিজয়ী হয়। অন্যদিকে, জেএসডি (রব) তারা প্রতীকে ৪৪টি আসনে নির্বাচন করে সবগুলো আসনে পরাজিত হয়।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালে। হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাসদ ৫টি আসনে বিজয়ী হয়।
একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর। সেই নির্বাচনে জাসদ (ইনু) ১২টি আসনে প্রার্থী দিয়ে ৩টিতে বিজয়ী হয়। অন্যদিকে, রবের নেতৃত্বাধীন জেএসডির কেউ বিজয়ী হতে পারেননি।
সবশেষ ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে জাসদের (ইনু) প্রার্থী একেএম রেজাউল করিম তানসেন বগুড়া–৪ আসনে বিজয়ী হন। তবে কুষ্টিয়া-২ আসনে পরাজিত হন নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করা দলের সভাপতি হাসানুল হক ইনু। বাংলাদেশ জাসদ (আম্বিয়া) ও জেএসডি (রব) এই নির্বাচন বর্জন করে।
জাসদে আবারও ভাঙন
আ স ম আব্দুর রব যখন মহাজোট সরকারের মন্ত্রী তখন ১৯৯৭ সালে জাসদ (রব) ও জাসদ ( ইনু) এক হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সঙ্গে যোগ দেন জাসদ থেকে বাসদে যাওয়া চট্টগ্রামের মঈন উদ্দিন খান বাদল। তারা সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধ জাসদ তৈরি করেন।
ঐক্যবদ্ধ জাসদের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হন আ স ম আব্দুর রব ও হাসানুল হক ইনু। আর কার্যকরী সভাপতি হন মঈন উদ্দিন খান বাদল। তবে সেই ঐক্য বেশিদিন টিকেনি। ২০০১ সালে মতাদর্শিক দ্বন্দ্বে জাসদে আবারও ভাঙন ধরে। ইনু ও রবের নেতৃত্বে জাসদ আলাদা হয়। ২০০৪ সালে ইনুর নেতৃত্বে জাসদ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটে যায়।
২০০৮ সালের ১৪ দলীয় জোটে থেকে নির্বাচন করে হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাসদ। দলটি ৩ টি আসনে বিজয়ী হয়। এছাড়া, ২০১৪ সালের নির্বাচনে তারা ৫ টি আসন পায়। মহাজোট সরকারের মন্ত্রী হন ইনু।
এদিকে, সাধারণ সম্পাদক নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ২০১৬ সালের জাতীয় সম্মেলনে দলে আবার ভাঙন ধরে। ইনুর নেতৃত্বাধীন জাসদ থেকে বের হয়ে যায় শরীফ নুরুল আম্বিয়া, নাজমুল হক প্রধান, ডা. এম মুশতাক হোসেনসহ অন্যান্য নেতারা। ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের পরে জাসদ (আম্বিয়া) ১৪ দলীয় জোট ত্যাগ করে। এ অংশ বাংলাদেশ জাসদ নামে পরিচিত হয়।
সেই থেকে জাসদ তিনটি ভাগে জাসদ, বাংলাদেশ জাসদ ও জেএসডি হিসেবে আলাদা রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে।
বর্তমানে কতটি দল জাসদের অস্তিত্ব বহন করছে?
নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন আছে জাসদের তিনটি অংশেরই। এগুলো হলো : শরীফ নুরুল আম্বিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাসদ, হাসানুল হক ইনুর জাসদ এবং আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন জেএসডি। বাংলাদেশ জাসদের প্রতীক মোটর গাড়ি, জাসদের মশাল এবং জেএসডির প্রতীক তারা।
বিশ্লেষকরা কী বলছেন?
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক আল মাসুদ হাসানুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রথম থেকেই জাসদ সরকারি দলের আক্রোশ, দমন এবং জুলুম নির্যাতনের শিকার হয়। ১৯৭৫ সালের পরবর্তীত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জাসদের বিকাশ চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয় মূলত এ দলের আনুষ্ঠানিক ভাঙনে, ফলে কয়েকটি বিভক্তি ও দল তৈরি হয়।
পরবর্তীতে এসব সংগঠনে দলের নেতাদের মধ্যে ‘রাজনৈতিক সুবিধাবাদ’নীতি দৃশ্যমান হতে থাকে এবং প্রধান দুটি দল যথাক্রমে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে তাদের যুক্ত হয়ে সরকারে অংশ নিতে দেখা যায়। মতাদর্শিক দৃঢ়তার অভাবে ও চলমান বিভাজনে জাসদ ক্রমান্বয়ে বিপ্লবী সংগঠন থেকে প্রান্তিক রাজনৈতিক গোষ্ঠী হিসেবে টিকে থাকে।’
অধ্যাপক আল মাসুদ হাসানুজ্জামান বলেন, ‘জাসদের প্রধান তাত্ত্বিক নেতা ও চিন্তাবিদ সিরাজুল আলম খানের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তাঁর অপ্রকাশ্য তাত্ত্বিক নেতৃত্ব, দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা, বাস্তব প্রেক্ষাপটে প্র্যাগমেটিক ও যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অভাব এবং সর্বোপরি রাজনীতিতে তাঁর স্বেচ্ছা নির্বাসন জাসদকে ক্রমান্বয়ে শক্তিহীন এবং জনগণের দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আদর্শিক চিন্তা, চেতনা, প্রজ্ঞা নির্মাণে সিরাজুল আলম খানের অবদান অনস্বীকার্য। গণ রাজনৈতিক দলে জাসদের রূপান্তরে তাঁর ব্যর্থতা থাকলেও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ও দেশের ইতিহাসের সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে তাঁর অবদান আলোচিত হতে থাকবে।’
লেখক ও বিশ্লেষক মোরশেদ শফিউল হাসান বলেন, ‘মস্কোর ভূমণ্ডলীয় রাজনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের এদেশীয় এজেন্ট হতে গিয়ে মস্কোপন্থি কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ এবং ছাত্র ইউনিয়নসহ তাদের অঙ্গ সংগঠনগুলো বিরোধী রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেওয়ার সে সুযোগকে কাজে লাগাতে পারেনি। বরং ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারির ঘটনার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় তাদেরকে ক্রমে পিছু হঠতে, কিংবা আরও সঠিক অর্থে বললে উলটো পথে হাঁটতে দেখি আমরা।’
মোরশেদ শফিউল হাসান বলেন, ‘যে-প্রক্রিয়ায় পরবর্তীকালে গণঐক্য জোট গঠন এবং বাকশালে তাদের সোৎসাহে লীন হওয়ার ব্যাপারগুলো ঘটে। এমনিতেও উন্নত-অনুন্নত নির্বিশেষে সব দেশে ও সব কালেই তরুণ সমাজ হয় স্বভাবগতভাবে ‘স্টাবলিশমেনট’বিরোধী। সে কারণেও স্বাধীনতা-উত্তর সে অস্থির সময়টিতে মস্কোপন্থীদের 'গঠনমূলক সমালোচনা'র রাজনীতি কিংবা ছাত্র ইউনিয়নের 'এসো দেশ গড়ি' স্লোগান কোনো আবেদন সৃষ্টি করতে পারেনি। জাসদ এই অবস্থাটির সুযোগ পেয়েছিল।’
রাজনীতিবিদদের ভাষ্য:
ডাকসুর সাবেক জিএস ও বাংলাদেশে জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এম মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাসদ জন্মলগ্নে সঠিক রণনীতি বাছাই করতে পারলেও যথাযথ রণকৌশল বাছাই করতে পারেনি। রাজনীতির ধারার পরিবর্তনের বাঁকে বাঁকে নেতা- কর্মীদের খাপ খাইয়ে নেয়া অত সহজ ছিল না। একদিকে আদর্শিক তর্ক-বিতর্ক, অন্যদিকে সংগঠন গড়ে তোলার কৌশল নিয়ে জাসদের অভ্যন্তরে তীব্র মতাদর্শিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। বিপ্লবী রাজনীতির সাথে সংসদীয় রাজনীতির সমন্বয় ও রূপান্তর ছিল বিরাট চ্যালেঞ্জ। দ্রুপদী সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির ধারায় কমিউনিস্ট ধাঁচের সংগঠন গড়ে তোলা, নাকি সংসদীয় রাজনীতির উপযোগী সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট দল গঠন - এ বিতর্কে জাসদ থেকে বাসদ সৃষ্টি হয়। আবার নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে লিবারেল ডেমোক্র্যাট দলসমূহের সাথে ঐক্য করতে গিয়ে জাসদকেই লিবারেল ধারায় রূপান্তরিত করার চেষ্টা থেকেও দলে একাধিকবার ভাঙন ধরে। ফলে রাজনীতির বাঁক বদলের মুহূর্তে বড় নেতারা ছিটকে পড়েছেন।’
মুশতাক হোসেনের মতে, ‘বর্তমানে বাংলাদেশ জাসদের সংগঠক ও কর্মীরা দলের গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক সংগ্রামী ধারা ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু জাসদের জনপরিচিত নেতারা মূলধারা ত্যাগ করে লিবারেল ধারায় চলে যাওয়ায় জনগণ জাসদকে আগের মতো আস্থায় নিতে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগে। তাই বাংলাদেশ জাসদকে রাজনীতির মাঠে টিকে থাকতে ও সামনে এগোতে অনেক কষ্ট করতে হচ্ছে। সম্ভাবনা অবশ্যই আছে। তবে সেটা আপনা আপনি ধরা দেবে না, সেটা অর্জন করতে হবে।’
জাসদের রাজনীতি প্রসঙ্গে দলটির সাবেক নেতা ও বর্তমানে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর সিপাহি–জনতার অভ্যুত্থানের নামে যেটা করা হলো, সেটাকে শ্রেণি সংগ্রামে রূপ দেওয়ার চেষ্টা হলো। সেটার একটা নাম দেওয়া হলো ‘সিপাহি ভার্সেস অফিসারদের লড়াই।’ সেটাও ব্যর্থতায় পর্যবর্সিত হলো। এবং এই হঠকারিতার কারণে জাসদ ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’ চলে গেলো। আর ঠিকমতো ফিরে আসতে পারলো না সহজেই।’
মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘অনেকদিন পর জিয়াউর রহমানের শাসনামলে জাসদ আবারও পিপিআর–পলিটিক্যাল পার্টি রেগুলেশনে চলে আসলো। মূল লড়াইটাই ছিল– আমরা গণসংগ্রামের লাইনে যাবো, নাকি সশস্ত্র মাধ্যমে যাবো। আমরা কি বুঝে–শুনে গোছানো একটা আন্দোলন করবো, নাকি হঠকারিতা পথে যাবো। এটাকেই বলে বাম হঠকারিতা। দক্ষিণপন্থি সুবিধাবাদ। জাসদ দুই ধরনের প্রবণতাতেই আক্রান্ত হয়েছিল।
দক্ষিণপন্থি সুবিধাবাদটা এই–যখন প্রচণ্ড হঠকারিতা থেকে উঠে আসলো জাসদ, জিয়াউর রহমানের আমলে দলটা রাজনীতি করার অনুমতি পেলো। অভিযোগ আছে, জাসদ ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান বেহাত হয়ে যাওয়ার পরে আবার নভেম্বরেই একটা অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়েছিল। সেই কথিত অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ায়, অভ্যুত্থানের নায়ক কর্নেল তাহেরসহ অনেককে শাস্তি দেওয়া হয়। কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দেওয়া হয়। তারপর জাসদ ধীরে ধীরে নতুন একটা তত্ত্বের কথা বললো। গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার গঠন করতে হবে। যেখানে শাসকচক্র বুর্জোয়াদেরসহ একটা জাতীয় সরকার গঠন করা হবে। ইংরেজিতে বলা হলো– ডিএনজি বা গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার। এর বাইরে ছাত্রলীগের যারা যারা নেতা ছিলেন, তাদের নেতৃত্বে মাহমুদুর রহমানের মান্নার নেতৃত্বে ছিল অ্যান্টি ডিএনজি আরেকটা গ্রুপ হলো। সব কিছু মিলিয়েই জাসদ একদিকে বাম হঠকারিতা, অন্যদিকে দক্ষিণপন্থি সুবিধাবাদের খপ্পরে পড়ে শেষ পর্যন্ত নিজেদের ক্ষতি করে ফেলেছে।’
জাসদ নেতাদের এখন কী অবস্থা?
জাসদ (ইনু) এর সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বর্তমানে জেলে আছেন। জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রবের বয়স এখন প্রায় ৮০। তিনি জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও ডাকসুর সাবেক ভিপি। বর্তমানে বার্ধক্যজনিত নানা অসুখে ভুগছেন।
অন্যদিকে, বীর মুক্তিযোদ্ধা শরীফ নুরুল আম্বিয়া বাংলাদেশ জাসদের সভাপতির দায়িত্বে আছেন। ৭২ সালের ৩১ অক্টোবর যখন জাসদ গঠন হয় তখন তিনি ছাত্রলীগ (সিরাজপন্থী) অংশের সভাপতি ছিলেন। পরে মূল দলে অন্তর্ভুক্ত হন।
আ স ম আব্দুর রব ও শরীফ নূরুল আম্বিয়া কী বলছেন?
জাসদ কেন এত ব্র্যাকেট বন্দি দল? কেন দলটি এতবার খণ্ডিত হয়েছে– এমন লিখিত প্রশ্ন ছিল আ স ম আব্দুর রবের কাছে। এর উত্তরে তিনি বলেন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠনের পরিকল্পনাকারী ছিলেন সিরাজুল আলম খান। দলের নামকরণও তিনি এককভাবে করেছেন। দাদাভাই ছিলেন আমাদের রাজনৈতিক, তাত্ত্বিক ও নৈতিক অভিভাবক। আমরা ছিলাম সদ্য মুক্তিযুদ্ধ সমাপ্তকারী সৈনিক। চেতনা ছিল স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্রের প্রেরণায় উদ্দীপ্ত। একটি রাষ্ট্রে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অসংখ্য দ্বন্দ্ব থাকে। বাস্তবতা উপলব্ধি করে আন্দোলন করা, সংগঠনের বিকাশ ঘটানো, দ্বন্দ্ব নির্ণয় করা, রণনীতি নির্ধারণ ও কৌশল গ্রহণ করা এবং তা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের পক্ষে সদ্ব্যবহার করার প্রশ্নে দলে অনেক মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। আমরা ব্যর্থ হয়েছি দলকে অখণ্ড রাখতে। নিশ্চয়ই ভুলভ্রান্তি হয়েছে। এ জন্য আমার সহকর্মী কাউকে অভিযুক্ত করতে চাই না, কিন্তু আমি ক্রমাগত অভিযুক্ত হয়েছি। যাঁরা এই রাজনীতির জন্য প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের তুলনায় আমার ভূমিকা খুবই গৌণ। অথচ এই আমরাই বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগান দিয়ে আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জেল-জুলুম-মৃত্যুকে উপেক্ষা করে প্রচণ্ড সাহস আর ঝুঁকি নিয়ে রুখে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
আ স ম আবদুর রব বলেন, ‘আমি ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘদিন কারাগারে থাকায় পার্টির অনেক গোপন বা প্রকাশ্যে কর্মকাণ্ডে আমার জড়িত থাকার সুযোগ হয়নি, অনেক কিছুই ঘটেছে জানার বাইরে।’
মূলত, জলিল–রব ৮ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে মুক্তি পান। ২৩ নভেম্বর আবার গ্রেপ্তার হন। পুন:অভ্যুত্থান চেষ্টায় তাদের ২ জনকেও কর্নেল (অব.) তাহেরের সঙ্গে মামলা দেওয়া হয়।
আ স ম আব্দুর রব বলেন, ‘দ্বন্দ্ব, ভিন্নতা, পার্থক্য ইত্যাদি কারণে একদিকে দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অন্যদিকে মেহনতি মানুষের মুক্তির লড়াই দূরবর্তী হয়েছে। এটা আমাদের বড় ট্র্যাজেডি।’
এদিকে, বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘লক্ষ্য এখনও অর্জন হয় নাই। অতীতে যারা ক্ষমতায় গেছেন, তারা লুটপাট করেছেন। আমরা তাদেরকে মোকাবিলা করতে পারি নাই। সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন করে অনেক নির্যাতন ও জেল–জুলুম সহ্য করেছি। তারপরও আপোশ করি নাই।’
তাঁর মতে, ওই সময় গণবাহিনী গঠন যুক্তিযুক্ত ছিল। নিজেদের আত্মরক্ষায় এটা ছাড়া বিকল্প ছিল না। একদিকে রক্ষীবাহিনী, আওয়ামী লীগ, যুব লীগ, ছাত্র লীগ ও শ্রমিক লীগ এবং পিকিং পন্থী পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির হামলা থেকে বাঁচতে আত্মরক্ষায় গণবাহিনী গঠন করা হয়।
শরীফ নুরুল আম্বিয়া বলেন, ‘ভুল ছাড়া কোনো রাজনীতি হয় না। সব সিদ্ধান্তের মধ্যে কিছু ভুল ত্রুটি থাকে। সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক পরিপক্কতার ঘাটতি থাকায় দলে অত্যধিক ভাঙন হয়েছে। দলের নেতাদের অভিজ্ঞতারও ঘাটতি ছিল। নেতাদের বেশির ভাগেরই বয়স কম ছিল। তাই তারা বেশি ভুল করেছেন।’
তথ্য সূত্র:
১. দাসগুপ্ত, স্বপন (২০২৫), বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিক্রমা ১৯৭২–১৯৭৫, মাওলা ব্রাদার্স, পৃ: ৩৯, ঢাকা, বাংলাদেশ
২. ইসলাম, নজরুল (২০১৩), আগামী দিনের বাংলাদেশ ও জাসদের রাজনীতি, অনন্যা, পৃ: ৯৫, ঢাকা, বাংলাদেশ
৩. হোসেন, ড. মো. আনোয়ার (২০১২), মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ৭ই নভেম্বর অভ্যুত্থানে কর্নেল তাহের, আগামী প্রকাশনী, পৃ: ৬৬, ৬৭ ও ৬৮, ঢাকা, বাংলাদেশ
৪. আহমদ, মহিউদ্দিন (২০২৪), প্রতিনায়ক, সিরাজুল আলম খান, প্রথমা প্রকাশন, পৃষ্ঠা ১৫১–১৫৩, ঢাকা, বাংলাদেশ
৫. আহমদ, মহিউদ্দিন (২০১৪), জাসদের উত্থান পতন, অস্থির সময়ের রাজনীতি, প্রথমা প্রকাশন, পৃ: ৮৬–৮৭, ঢাকা, বাংলাদেশ
৬. দৈনিক ইত্তেফাক, ১৮ মার্চ ১৯৭৪
৭. পেয়ারা, শামসুদ্দিন (২০২৩) আমি সিরাজুল আলম খান, একটি রাজনৈতিক জীবনালেখ্য, সূচীপত্র প্রকাশনী, পৃষ্ঠা ১৫১–১৫৩, ঢাকা, বাংলাদেশ
৮. জাতীয় সংসদ হ্যান্ডবুক, আরএফইডি, ২০০৬
৯. জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ১৯৮৬, নির্বাচন কমিশন
১০. পরিসংখ্যান প্রতিবেদন, ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন
১১. Report on the First General Election to Parliament in Bangladesh, Bangladesh Election Commission, 22 June 1973, Dacca