‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা গত ২৮ আগস্ট অনুষ্ঠিত হয়
‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা গত ২৮ আগস্ট অনুষ্ঠিত হয়

প্রোস্টেট ক্যানসার: প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত হলে দেশেই চিকিৎসা সম্ভব

পুরুষদের জন্য বার্তা হলো, যদি পরিবারের কারও প্রোস্টেট কিংবা স্তন ক্যানসারের ইতিহাস থাকে তবে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং সতর্কতা অবলম্বন জরুরি। প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত করা গেলে প্রোস্টেট ক্যানসারের চিকিৎসা দেশেই করা সম্ভব।

‘বিশ্বমানের ক্যানসার-চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. রকিব উদ্দীন আহমেদ এ কথা বলেন। এই অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে অংশ নেন তিনি। অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন নাসিহা তাহসিন। ক্যানসার বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে এসকেএফ অনকোলজি।

এখনো প্রোস্টেট ক্যানসার নিয়ে রয়েছে নানা ভ্রান্ত ধারণা ও সচেতনতার অভাব। তাই এ পর্বে প্রোস্টেট ক্যানসার নিয়ে বিভিন্ন সচেতনতামূলক পরামর্শ দেন অধ্যাপক ডা. রকিব উদ্দীন আহমেদ। পর্বটি গত বৃহস্পতিবার (২৮ আগস্ট) সরাসরি প্রচারিত হয় প্রথম আলো ডটকম এবং প্রথম আলো, এসকেএফ অনকোলজি ও এসকেএফের ফেসবুক পেজে।

বিশ্বব্যাপী ক্যানসারের প্রকোপ, রোগীর সংখ্যা, মৃত্যুহারসহ নানা তথ্য নিয়ে বিশ্লেষণকারী প্ল্যাটফর্ম ‘গ্লোবাল ক্যানসার অবজারভেটরি’র তথ্যমতে, ২০২২ সালে বাংলাদেশে প্রোস্টেট ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৩৩৫ জন। সংখ্যাটি ধীরে ধীরে বাড়ছে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাই আলোচনার শুরুতেই উপস্থাপক জানতে চান বাংলাদেশে প্রোস্টেট ক্যানসারের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে। উত্তরে ডা. রকিব উদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘প্রোস্টেট থেকে যে ক্যানসারের উৎপত্তি, সেটিই প্রোস্টেট ক্যানসার। প্রোস্টেট পুরুষ প্রজননতন্ত্রের একটি অংশ। তাই প্রোস্টেট ক্যানসার শুধু পুরুষদেরই হয়ে থাকে।’

প্রোস্টেট ক্যানসারের দুই ধরনের স্ক্রিনিং

প্রসঙ্গক্রমে উপস্থাপক জানতে চান, কত বছর বয়স থেকে প্রোস্টেট ক্যানসারের স্ক্রিনিং করা উচিত? ডা. রকিব উদ্দীন আহমেদ বলেন, প্রোস্টেট ক্যানসার মূলত বয়স্কদের হয়ে থাকে। তাই এই ক্যানসারের স্ক্রিনিং সাধারণত ৫০ থেকে ৭০ বছর বয়সের মধ্যে করানো উচিত। তবে যাঁদের রিস্ক বেশি রয়েছে তাঁদের ৪৫ বছর বয়সেই স্ক্রিনিং করা উচিত।

ডা. রকিব উদ্দীন আহমেদ বলেন, প্রোস্টেট ক্যানসারের ক্ষেত্রে দুই ধরনের স্ক্রিনিং করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে একটি হলো প্রোস্টেট স্পেসিফিক অ্যান্টিজেন (সিরাম পিএসএ), আরেকটি হলো ডিজিটাল রেকটাল এক্সামিনেশন (ডিআরই)। তবে একেবারেই শেষ পর্যায়ে গিয়ে এই স্ক্রিনিং করালে বিশেষ লাভ হয় না। প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা গেলে সঠিক চিকিৎসা-ব্যবস্থার মাধ্যমে রোগীর সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।

প্রোস্টেট ক্যানসারের লক্ষণ

এ রোগের লক্ষণগুলো সম্পর্কে ডা. রকিব উদ্দীন আহমেদ বলেন, প্রোস্টেট ক্যানসারের লক্ষণগুলো দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়। ক্যানসার যখন শুধু প্রোস্টেট গ্রন্থিতে সীমাবদ্ধ থাকে এবং ক্যানসার যখন শরীরের অন্য অংশে, বিশেষত হাড়ে ছড়িয়ে যায়।

ডা. রকিব উদ্দীন আহমেদ বলেন, ক্যানসার শুধু প্রোস্টেট গ্রন্থিতে সীমাবদ্ধ থাকলে ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ অনুভূত হয়, প্রস্রাব করার সময় বিভিন্ন অসুবিধা দেখা দেয়, প্রস্রাব করার পরেও অসম্পূর্ণতা বোধ থাকে, তলপেটে হালকা ব্যথা অনুভূত হয়, রাতের বেলা বারবার প্রস্রাবের জন্য উঠতে হয় এবং কিছু ক্ষেত্রে প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত বের হয়। আর ক্যানসার শরীরের অন্য অংশে ছড়িয়ে গেলে হাড়ে তীব্র ব্যথা দেখা দেয়, যা সাধারণত মেরুদণ্ড, পেলভিস বা পাঁজরে হয়ে থাকে। এতে হাড় দুর্বল হয়ে যায়, যার ফলে সামান্য আঘাতেও হাড়ে ফাটল বা ফ্র্যাকচার হতে পারে। এমনকি মেরুদণ্ডের ওপর চাপ সৃষ্টি হলে প্যারালাইসিস পর্যন্ত হতে পারে।

বাংলাদেশে প্রোস্টেট ক্যানসারের বর্তমান অবস্থা, রোগ নির্ণয়, ডায়াগনোসিস ও চিকিৎসা-সুবিধা বিষয়ে পরামর্শ দেন অধ্যাপক ডা. রকিব উদ্দীন আহমেদ

বয়সের সঙ্গে প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে

প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি ফ্যাক্টরগুলো সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে ডা. রকিব উদ্দীন আহমেদ বলেন, এ ক্ষেত্রে বয়স একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে যদি পরিবারে কারও প্রোস্টেট ক্যানসার কিংবা ব্রেস্ট ক্যানসারের ইতিহাস থাকে, তাহলেও ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া অতিরিক্ত ওজন প্রোস্টেট ক্যানসারের একটি ঝুঁকির কারণ। যাঁরা অতিরিক্ত চর্বিজাতীয় খাবার খান, ধূমপান করেন এবং শারীরিকভাবে নিষ্ক্রিয় থাকেন, তাঁদের প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি বেশি থাকে।

স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে কি না—উপস্থাপকের এমন প্রশ্নের উত্তরে ডা. রকিব উদ্দীন আহমেদ বলেন, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন শুধু প্রোস্টেট ক্যানসার নয়, সব ধরনের ক্যানসারের ঝুঁকি হ্রাস করে। যেমন অতিরিক্ত চর্বিজাতীয় খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকা, ধূমপান না করা, শারীরিক কার্যকলাপ করা ইত্যাদি।

চিকিৎসা নির্ভর করে ক্যানসারের পর্যায়ের ওপর

প্রোস্টেট ক্যানসারের চিকিৎসা প্রসঙ্গে ডা. রকিব উদ্দীন আহমেদ বলেন, প্রোস্টেট ক্যানসারের চিকিৎসা নির্ভর করে ক্যানসার কোন পর্যায়ে আছে তার ওপর। যদি ক্যানসার কেবল প্রোস্টেটে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে অবজারভেশন, সার্জারি (র‍্যাডিকাল প্রোস্টেটমি) অথবা রেডিয়েশন থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা করা যায়। আর যদি ক্যানসার হাড় বা অন্য কোথাও ছড়িয়ে পড়ে, তবে মূল চিকিৎসা হলো হরমোন থেরাপি। অনেক সময় হরমোনের পাশাপাশি কেমোথেরাপি কিংবা ইমিউনোথেরাপিও ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে সার্জারি, রেডিয়েশন ও হরমোনাল ট্রিটমেন্ট—সবই সম্ভব, তবে রোবোটিক সার্জারি এখনো চালু হয়নি।

ডা. রকিব উদ্দীন আহমেদ আরও বলেন, ‘প্রায় ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে আমাদের দেশে প্রোস্টেট ক্যানসারের যে ধরনটি বেশি দেখা যায়, সেটি হলো অ্যাডিনোকারসিনোমা। এর বাইরে স্মল সেল কারসিনোমা, সারকোমা বা লিমফোমার মতো কিছু বিরল ধরনও আছে।’

চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে অধ্যাপক ডা. রকিব উদ্দীন আহমেদ বলেন, প্রোস্টেট ক্যানসারের চিকিৎসা কার্যকর হলেও কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। হরমোনাল চিকিৎসায় যৌন সমস্যা, যেমন ইরেক্টাইল ডিসফাংশন দেখা দিতে পারে। মাংসপেশি কমে গিয়ে শরীরে চর্বি জমে যায়, হট ফ্ল্যাশ হয়, ক্লান্তি ও অবসাদ তৈরি হয়। তবু এসব চিকিৎসার মাধ্যমেই রোগীকে দীর্ঘদিন ভালো রাখা সম্ভব।

আলোচনার শেষ পর্যায়ে দর্শকদের উদ্দেশে অধ্যাপক ডা. রকিব উদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘যে অসুবিধাগুলোর কথা আমি ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি, তার মধ্যে কোনো একটি যদি দেখা দেয়, তবে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন এবং প্রয়োজনীয় স্ক্রিনিং টেস্টগুলো করে নিন। যদি প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা সম্ভব হয়, তবে প্রোস্টেট ক্যানসার দেশেই নিরাময় সম্ভব। তাই কখনো অপচিকিৎসা বা বৈজ্ঞানিকভাবে অস্বীকৃত কারও পরামর্শ গ্রহণ করবেন না। বরং সরাসরি কোনো ইউরোলজিস্ট বা অনকোলজিস্টের শরণাপন্ন হোন।’