স্টেথোস্কোপ দিয়ে পার্সিয়ান বিড়ালটিকে পরীক্ষা করছেন চিকিৎসক
স্টেথোস্কোপ দিয়ে পার্সিয়ান বিড়ালটিকে পরীক্ষা করছেন চিকিৎসক

হাসপাতালে দীর্ঘ লাইন, বেশির ভাগ রোগীই বিড়াল

বিড়ালের ১০৪ ডিগ্রি জ্বর। এই জ্বরে কাতর বিড়ালের মালিক ঋতু। তাই মাথা ও শরীর কাপড়ে ঢেকে বিড়ালটিকে নিয়ে এসেছেন চিকিৎসকের কাছে। মহাখালী থেকে আসা ঋতু নিবন্ধন সেরে অপেক্ষায় আছেন, কখন আসবে চিকিৎসকের ডাক?

ঢাকার ৪৮ কাজী আলাউদ্দিন রোডে অবস্থিত কেন্দ্রীয় ভেটেরিনারি হাসপাতালে গতকাল বুধবার এমন চিত্র দেখা গেছে। পোষা প্রাণীর চিকিৎসার জন্য রাজধানীতে অন্যতম ভরসার জায়গা এটি। হাসপাতালটি ‘পশু হাসপাতাল’ নামেই বেশি পরিচিত।

কেউ কাঁথায় পেঁচিয়ে, কেউবা ঝুড়িতে করে অসুস্থ বিড়াল নিয়ে পশু হাসপাতালে চিকিৎসকের অপেক্ষায় আছেন

অপেক্ষার ভিড়ে বিড়ালের আধিপত্য

সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত এই হাসপাতালের নিবন্ধন কাউন্টারের সামনে রোগীর ভিড় থাকে। এসব রোগীর অধিকাংশই বিড়াল। কেউ কাঁথায় পেঁচিয়ে, কেউবা ঝুড়িতে করে পোষা প্রাণী বিশেষ করে বিড়াল নিয়ে নিবন্ধন কাউন্টারের সামনে হাজির হন। কোন কক্ষে কোন চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে, তা নিবন্ধন করার সময়ই বলে দেওয়া হয়।

রাজধানীর কেন্দ্রীয় ভেটেরিনারি হাসপাতাল ‘পশু হাসপাতাল’ নামেই বেশি পরিচিত

কামরাঙ্গীরচর থেকে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে গৃহিণী শামীমা আক্তার তাঁর বিড়ালকে কোলে নিয়ে এসেছেন। তাঁর বিড়াল কিছুই খাচ্ছে না। তাই অপেক্ষায় আছেন চিকিৎসকের। কিন্তু দুপুর আড়াইটায় দিকেও চিকিৎসকের ডাক পাননি তিনি। বিরক্তি প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘সকাল থেকে বসে আছি, এখনো সিরিয়াল মেলেনি। দুপুরের বিরতি শেষ হলে হয়তো ডাক পড়বে।’

হাসপাতালে কথা বলে জানা গেছে, চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর চাপ অনেক। রোগীর মধ্যে বিড়ালের সংখ্যা প্রায় ৯০ শতাংশ। কিছু কুকুর, খরগোশ চোখে পড়লেও ছাগল বা ঘোড়া আনার ঘটনা প্রায় বিরল।

বিড়ালের জ্বর। তাই কাপড়ে পেঁচিয়ে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন বিড়ালটিকে

হাসপাতালের অতিরিক্ত ভেটেরিনারি কর্মকর্তা চিকিৎসক নাজমুল হুদার কক্ষে ঢুকতেই দেখা গেল, তিনি লালবাগ থেকে আসা স্নাতকের শিক্ষার্থী সিমরান পারভেজ মোসকানের বিড়ালটিকে স্টেথোস্কোপ দিয়ে পরীক্ষা করছেন। আট মাস বয়সী এই পার্সিয়ান বিড়ালটি কয়েক দিন আগে তিনতলা থেকে পড়ে আঘাত পেয়েছিল। তার পর থেকেই খিঁচুনি শুরু হয়। এখন খিঁচুনির সঙ্গে ১০২ ডিগ্রি জ্বর।

চিকিৎসক প্রথমেই ওজন মাপলেন, ৩ দশমিক ২ কেজি। এরপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানালেন, সিমরানের বিড়ালটির নার্ভে সমস্যা। ইনজেকশনসহ কিছু ওষুধ লাগবে। প্রেসক্রিপশন হাতে নিয়ে সিমরান জানালেন, বেশির ভাগ ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার প্রস্তুতিও নিতে হবে তাঁকে।

সেবা অনেক, সংকটও কম নয়

ইতিহাস বলছে, ১৯২০ সালে এই হাসপাতালের যাত্রা শুরু হয়। ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ ঘোড়ার চিকিৎসাকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ১৯১৮ সালে ৩ দশমিক ৪ একর জমি দান করেছিলেন। সেই সূত্রেই তৈরি হয় এই কেন্দ্রীয় ভেটেরিনারি হাসপাতাল।

সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত এই হাসপাতালের নিবন্ধন কাউন্টারের সামনে রোগীর ভিড় থাকে

হাসপাতালের পরিচালক চিকিৎসক মো. আবদুল আজিজ আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, এখানে প্রতিদিন গড়ে ৩০০-৩৫০টি নিবন্ধন হলেও চিকিৎসার জন্য প্রাণী আসে ৭০০ থেকে ৮০০টি। কারণ, অনেকেই একসঙ্গে একাধিক পোষা প্রাণী নিয়ে আসেন। তাঁদের নিবন্ধন একটাই হয়।

হাসপাতালের পরিচালক বলেন, এখানে প্রাণীর পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আল্ট্রাসনোগ্রাম ও এক্স-রে করার সুযোগ আছে। রক্ত পরীক্ষা, সিটিস্ক্যান বা অন্যান্য পরীক্ষার জন্য রেফার করে দিতে হয়। দুটি অস্ত্রোপচার কক্ষে মাসে গড়ে ৫০টির মতো অস্ত্রোপচার হয়। দুর্ঘটনায় আঘাত পাওয়া অধিকাংশ কুকুর বা বিড়ালের অস্ত্রোপচার করা হয়। বিড়ালের অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বাচ্চা প্রসব করানোও হয়।

চিকিৎসকের চেম্বারে ঢোকার আগে রোগী বিড়ালটির ওজন মাপা হচ্ছে

শতবর্ষ পেরোনো হাসপাতালটিতে বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা পাওয়া যায় বলে রোগীর সংখ্যা বেশি থাকে। তবে হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এখানে জনবল–সংকট আছে। কম্পাউন্ডার, নৈশপ্রহরী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, অফিস সহকারীসহ বিভিন্ন পদে ৩০ জনের বেশি জনবল থাকার কথা থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র ১০ থেকে ১২ জন। চিকিৎসকের নন-ক্যাডার ছয়টি পদের মধ্যে চারটি পদে চিকিৎসক আছেন। ক্যাডারের চারটি পদই ফাঁকা প্রায় বছরখানেক ধরে। বর্তমানে ১১ জন ভেটেরিনারি চিকিৎসক কর্মরত। প্রেষণে নিয়ে আসা জনবল দিয়ে কাজ চলছে। আর বাজেটও সীমিত।

এই হাসপাতালের আরেকটি সীমাবদ্ধতা হলো, এখানে রোগী ভর্তি রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই। সপ্তাহে পাঁচ দিন সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত সেবা দেওয়া হয়। শুক্রবার দুপুর ১২টা ও শনিবার বেলা ২টা পর্যন্ত হাসপাতাল খোলা থাকে।

সংক্রমণের ঝুঁকি

হাসপাতালের পরিচালক চিকিৎসক মো. আবদুল আজিজ আল মামুন বলেন, শখ করে কুকুর, বিড়াল পোষার প্রবণতা বাড়ছে। কিন্তু অনেকেই পোষা প্রাণীকে ভ্যাকসিন বা টিকা দেন না। টিকা না পাওয়া পশুর মাধ্যমে ভেটেরিনারি চিকিৎসক রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। এটি চিকিৎসকদের সংক্রমণের বড় ঝুঁকি তৈরি করছে।

শতবর্ষ পেরোনো হাসপাতালটিতে বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা পাওয়া যায় বলে রোগীর সংখ্যা বেশি থাকে

অতিরিক্ত ভেটেরিনারি কর্মকর্তা চিকিৎসক নাজমুল হুদার চেম্বারে এর প্রমাণ পাওয়া গেল। তাঁর চেম্বারে বিড়াল নিয়ে যাঁরা ঢুকছিলেন, তিনি তাঁদের সবার কাছে জানতে চাচ্ছিলেন, ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে কি না। অধিকাংশই জানালেন, দেওয়া হয়নি। কেউ বলেন, জানতেন না কত বয়সে দিতে হয়। আবার কেউ হাসতে হাসতে স্বীকার করলেন, ব্যস্ততার কারণে আর দেওয়া হয়নি।

এই হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ৭০০ থেকে ৮০০টি প্রাণীর চিকিৎসা দেওয়া হয়

এখন শহর থেকে শুরু করে গ্রামীণ জীবনেও পোষা প্রাণী পরিবারের সদস্যের মতোই হয়ে উঠছে। দিন দিন এই প্রবণতা বাড়ছে। তাই এসব প্রাণীর চিকিৎসার জন্য ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছে পশু হাসপাতাল। ভিড়, অপেক্ষা আর সংকট সত্ত্বেও এখানে যাঁরা আসেন, তাঁদের কাছে এই হাসপাতাল মানে আশার আলো—শুধু বিড়ালের জন্য নয়, সব প্রাণীর জন্যই।