‘বাংলাদেশের গণমাধ্যমে সংস্কার: সুপারিশ, বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে প্রথম আলো। কারওয়ান বাজার, ঢাকা, ২৯ অক্টোবর
‘বাংলাদেশের গণমাধ্যমে সংস্কার: সুপারিশ, বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে প্রথম আলো। কারওয়ান বাজার, ঢাকা, ২৯ অক্টোবর

প্রথম আলোর গোলটেবিল

গণমাধ্যমের সংস্কার নিয়ে হতাশা

গণমাধ্যম সংস্কার নিয়ে আকাশচুম্বী প্রত্যাশা থাকলেও তা পূরণের কোনো আলামত দেখা যাচ্ছে না। গত মার্চে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সাত মাস হয়ে গেলেও সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। বরং সাংবাদিকদের অধিকার সুরক্ষায় সংস্কার কমিশন প্রস্তাবিত অধ্যাদেশের খসড়া যেভাবে তৈরি করেছিল, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সেভাবে রাখেনি। এটি এমনভাবে পরিবর্তন করছে, যাতে এই আইন না করাই ভালো। মন্ত্রণালয়ের এই খসড়া বাস্তবায়িত হলে সাংবাদিকদের কার্যকর পেশাগত সুরক্ষা নিশ্চিত হবে না।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘বাংলাদেশের গণমাধ্যমে সংস্কার: সুপারিশ, বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন নিয়ে এমন হতাশার কথা উঠে আসে। তবে হতাশা থাকলেও সুপারিশ বাস্তবায়নে চাপ অব্যাহত রাখার পক্ষেই মত দেন অংশগ্রহণকারীরা। গতকাল বুধবার প্রথম আলো আয়োজিত এ বৈঠকে সম্পাদক, সাংবাদিক, মালিক, রাজনৈতিক দলের নেতা, গণমাধ্যমের শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অংশ নেন। বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ।

‘প্রত্যাশা ছিল কলম খুলে লিখব, এখন মবের ভীতি’

গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক কামাল আহমেদ বলেন, ‘প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পরে আমাদের বলা হলো, আশু করণীয় ঠিক করে দেন, যেগুলো খুব দ্রুত বাস্তবায়ন করা যায়। ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই করে দিলাম সেটা। এরপর তো ডেফিনেটলি (নিশ্চিতভাবে) আমাদের প্রত্যাশা ছিল যে অন্তত আশু করণীয়গুলোর ক্ষেত্রে সরকার উদ্যোগী হবে এবং কিছু করবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো, এখন পর্যন্ত কোনো কিছু দৃশ্যমান হয়নি।’

কামাল আহমেদ

প্রস্তাবিত সাংবাদিকতার অধিকার সুরক্ষা অধ্যাদেশের বিষয়ে কামাল আহমেদ বলেন, কমিশন থেকে সাংবাদিকতার অধিকার সুরক্ষা অধ্যাদেশ করার কথা বলা হয়েছিল, যাতে সরকার দ্রুত আইন প্রণয়ন করতে পারে, সে জন্য কমিশন একটি খসড়াও তৈরি করে দিয়েছিল। কিন্তু তথ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা নিজেদের মতো করে মূল্যায়ন করে যে পরিবর্তন প্রস্তাব করেছেন, তাতে আর ওই আইন না করাই ভালো।

আমরা সাংবাদিকেরা মন খুলে, কলম খুলে লিখব এমন আশা ছিল, প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু এখন কী হচ্ছে, একটা মবের ভীতি
কামাল আহমেদ, প্রধান, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন

ঢাকার জেলা আদালতে তিন সাংবাদিক লাঞ্ছিত হওয়ার প্রসঙ্গে কামাল আহমেদ বলেন, ‘এই আইন হলে সাংবাদিকদের রক্ষা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হতো। তাঁদের হয়তো এই হয়রানি, এই দুর্ভাগ্য হতো না। এখন আসলে যেটা হওয়ার কথা, সেটা হচ্ছে না, তার উল্টোটা হচ্ছে। আমরা সাংবাদিকেরা মন খুলে, কলম খুলে লিখব—এমন আশা ছিল, প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু এখন কী হচ্ছে, একটা মবের ভীতি। এই মবের ভীতি কেন থাকবে? এর কারণটা হচ্ছে, সরকারের দিক থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি যেমন, ঠিক তেমনি এটা ঠেকানোরও চেষ্টা নেই।’

কামাল আহমেদ আরও বলেন, ‘গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে যে পরিবর্তন এসেছে, সেই পরিবর্তন থেকে অনেকের মধ্যেই একটা বড় সম্ভাবনা, বড় প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। সেই প্রত্যাশা পূরণের কোনো আলামত আজ পর্যন্ত আমরা দেখছি না। তবে একেবারে কিছু হবে না ধরে নিলে কিছুই হবে না। চাপ অব্যাহত রাখলে ফলাফল আসবে।’

সাংবাদিকতার নীতিমালা করা উচিত

সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম বলেন, গণমাধ্যম তথ্য মন্ত্রণালয়ে সাংঘাতিকভাবে দায়বদ্ধ। এই দায়বদ্ধতা যত দিন থাকবে এবং ক্রমাগতভাবে না কমবে, স্বাধীন সাংবাদিকতার বিকাশ ততই দুরূহ হবে।

সাংবাদিক ইউনিয়নগুলোর রাজনীতিকরণ নিয়েও কথা বলেন মাহ্ফুজ আনাম। বলেন, যত দিন পর্যন্ত সাংবাদিক ইউনিয়নগুলো রাজনৈতিক ভিত্তির ওপর নির্ভর করে বিভক্ত থাকবে, তত দিন স্বাধীন সাংবাদিকতা হবে না। গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে তিনি বলেন, এখন এই সরকার কত দূর আগ্রহী হবে সন্দেহ আছে। তাই নিজেদের স্বার্থের বিষয়ে আরও সচেতন হওয়া এবং নিজেদের কতগুলো আদর্শিক জায়গাকে দৃঢ় করতে হবে।

মাহ্‌ফুজ আনাম

স্বেচ্ছায় ‘কোড অব এথিকস’ বা নীতিমালা করা উচিত বলে মনে করেন মাহ্ফুজ আনাম। তাতে মালিকের অধিকার কোথায় কতটুকু থাকবে, সম্পাদকের কী দায়িত্ব এবং সাংবাদিকদের কী দায়িত্ব তা থাকবে।

যত দিন সাংবাদিক ইউনিয়নগুলো রাজনৈতিক ভিত্তির ওপর নির্ভর করে বিভক্ত থাকবে, তত দিন স্বাধীন সাংবাদিকতা হবে না
মাহ্‌ফুজ আনাম, সভাপতি, সম্পাদক পরিষদ

ব্রডকাস্ট সাংবাদিকদের জন্য নীতিমালা হচ্ছে বলে জানান ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টারের সভাপতি রেজওয়ানুল হক। সাংবাদিক ইউনিয়নের বিভাজন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সাংবাদিকদের বিভক্তি বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থায় এসেছে যে কিছুদিন আগপর্যন্ত প্রেসক্লাবে ইউনিয়নের দুটি অফিসই ছিল। ৫ আগস্টের পর একদল বিতাড়িত হয়েছে, সেই ইউনিয়ন অফিসে তালা দেওয়া হয়েছে। আরেক দল ভালোভাবে চলছে। তাহলে পরিবর্তন কি হলো?

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়ার আহ্বান

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ হতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সংবাদপত্রের মালিকদের সংগঠন নিউজ পেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (নোয়াব) সভাপতি এ কে আজাদ। তিনি বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে গণমাধ্যম কমিশন গঠন এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।

এ কে আজাদ

সংবাদপত্রের স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখলে শুধু সাংবাদিকেরাই নন, ভবিষ্যতের সরকারও এর সুফল পাবে বলে মনে করেন এ কে আজাদ। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো যদি সত্যিকার অর্থে গণমাধ্যমকে সহযোগিতা করে, তবেই গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে।

রাজনৈতিক নেতারা যা বললেন

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, সরকারি বা যেকোনো অশুভ প্রভাবমুক্ত সংবাদপত্র বা মিডিয়ার জগৎ তৈরি করা হোক, তা তাঁরা চান। এটা একটা মুভমেন্ট, মানে সংবাদপত্র বা মিডিয়ার স্বাধীনতার আন্দোলন। সেই আন্দোলনকে কী রকম করে গড়ে তোলা যায়, কীভাবে জয়ী করা যায়, সেই কথা ভাবতে হবে।

সত্যিকার অর্থে সংবাদপত্রজগৎ কখনো স্বাধীন হতে চেয়েছে কি না, সেই প্রশ্ন তোলেন বিএনপির মিডিয়া সেলের প্রধান মওদুদ হোসেন আলমগীর। তিনি বলেন, ১৭ বছরের চর্চায় দেখা গেছে তারা কতটা পরাধীন হতে পারে। গণমাধ্যম কমিশন করার বিষয়টি বিএনপির নির্বাচনী ইশতেহারে শুধু ঘোষণায় নয়, বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া সম্পর্কেও সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা থাকবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের প্রধান মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, সবাই হতাশা ব্যক্ত করেছেন। সেই হতাশা কাটিয়ে যাতে পরিবর্তনের দিকে ধাবিত হয়, এ জন্যই এই হতাশা আসছে বলে মনে করেন তিনি। জামায়াতে ইসলামী আইন ও নিয়মের বাইরে কোনো কাজ করবে না বলে উল্লেখ করেন তিনি।

সংবাদপত্রের স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখলে শুধু সাংবাদিকেরাই নন, ভবিষ্যতের সরকারও এর সুফল পাবে
এ কে আজাদ, সভাপতি, নোয়াব

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশে গণমাধ্যম ‘দখল’ প্রসঙ্গ তুললেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম সদস্যসচিব ও মিডিয়া সেলের সম্পাদক মুশফিক উস সালেহীন। তিনি বলেন, ‘৫ আগস্ট থেকে (২০২৪) দেখেছি মিডিয়া দখল করা শুরু হয়েছে।’

আগামী সংসদ নির্বাচনে গণমাধ্যমের অপব্যবহারের কারণে খারাপ পরিস্থিতি হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে মুশফিক উস সালেহীন আরও বলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়ায় যেটা দেখছি, সেটা দেখে কিছুটা বিজেপি বা ট্রাম্প স্টাইলে মিস ইনফরমেশন বা ডিস ইনফরমেশন ক্যাম্পেইনের মতো করে চলছে বলে মনে হচ্ছে। এটা যদি হয়, তাহলে আগামী নির্বাচনে যে পরিস্থিতি তৈরি হবে, সেখানে এই গণমাধ্যমের অপব্যবহার অথবা ভুল চর্চার কারণে অনেক খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।’

যৌথ প্ল্যাটফর্ম দরকার

রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ও গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সদস্য গীতি আরা নাসরীন বলেন, ‘আমরা পরিষ্কারভাবে এই অঙ্গীকার দেখতে চাই তাদের কাছ থেকে যে তারা সংবাদমাধ্যম নিয়ে কোন জায়গায় থাকতে চায়। এটা নিয়ে তাদের কাছ থেকে খুব স্পষ্ট কথাবার্তা আসতে হবে।’

গীতি আরা নাসরীন

গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সুপারিশের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা তো সুপারিশ দিয়েছি। এরপরে বাস্তবতা নিয়ে অনেক আলাপ করেছি। আমরা যদি সক্রিয় না হই, তাহলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার।’

বাংলাদেশের গণমাধ্যমের বিদ্যমান সংকটের সমাধান এবং গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের জন্য ত্রিপক্ষীয় সমাধান দরকার বলে মনে করেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডিয়া, কমিউনিকেশন অ্যান্ড জার্নালিজম কর্মসূচির সমন্বয়ক এস এম রিজওয়ান উল আলম।

বিটিভি সরকারি প্রতিষ্ঠান হলেও এটি আসলে ‘দলীয় প্রতিষ্ঠান’ বলে উল্লেখ করেন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সদস্য ও বিটিভির সাবেক কর্মকর্তা কামরুন্নেসা হাসান। তিনি বলেন, ‘যখন যে সরকার এসেছে, আমরা বাধ্য হয়েছি চাকরি করার সুবাদে সেই দলের কথা বলতে, আমরা কখনো বিরোধী দলের কথা বলার সুযোগ পাইনি।’

আমরা তো সুপারিশ দিয়েছি। এরপরে বাস্তবতা নিয়ে অনেক আলাপ করেছি। আমরা যদি সক্রিয় না হই, তাহলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার
গীতি আরা নাসরীন, সদস্য, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন

সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও বণিক বার্তা পত্রিকার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ বলেন, রাষ্ট্র মেরামতের যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, দিন শেষে রাষ্ট্রের কোনো মেরামত হয়নি। গণমাধ্যমের ক্ষেত্রেও তাই। অনেক আলাপ করে এখন বলা হচ্ছে কিছুই তো হলো না।

গণমাধ্যম নিয়ে কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এমআরডিআইয়ের নির্বাহী পরিচালক হাসিবুর রহমান বলেন, সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে মালিক-সম্পাদকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে একটি যৌথ প্ল্যাটফর্ম গঠন করা দরকার। রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে স্বাধীন গণমাধ্যমের কমিশন গঠনের অঙ্গীকার রাখার আহ্বান জানান তিনি।