কুয়াশামাখা সকালের আলোয় হেমন্তের রং। পাবনা সদরের গাছপাড়ায়
কুয়াশামাখা সকালের আলোয় হেমন্তের রং। পাবনা সদরের গাছপাড়ায়

কুয়াশার ঘোমটা টেনে এল হেমন্ত

কুয়াশার ফিনফিনে ঘোমটা টেনে এল হেমন্ত। কবি সুফিয়া কামালের কথায়, ‘সবুজ পাতার খামের ভেতর/ হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে/ কোন্‌ পাথারের ওপার থেকে/ আনল ডেকে হেমন্তকে?’ হেমন্তের হিম ঝরে হিমঝুরি ফুলে, ছাতিম আর লতাপারুলে, শিউলিঝরা তারাভরা রাতে হেমন্ত প্রকৃতি লুটিয়ে পড়ে হলুদ ধানের খেতে।

অফুরন্ত লাবণ্য আর স্নিগ্ধতার আঁচল বিছিয়ে শরৎ বিদায় নিয়েছে। এবার এসেছে সেই ঋতু, যার পদধ্বনি বড় শান্ত কিন্তু যার স্পর্শে প্রকৃতি পায় পরিপূর্ণতার সোনারং, সে আমাদের প্রিয় হেমন্ত। আজ কার্তিকের প্রথম দিন, হেমন্তের আগমনী বার্তা নিয়ে কুয়াশার নরম ঘোমটা উঠেছে প্রকৃতির মুখে।

বর্ষার সেই উদ্দামতা নেই, শরতের উচ্ছল শুভ্রতাও এখন ম্লান। হেমন্ত এসেছে এক নিভৃতচারিণী হরিণীর মতো, যার হাতে রয়েছে ধান্য-লক্ষ্মীর আশীর্বাদ আর কণ্ঠে প্রকৃতির গভীর প্রশান্তির সুর। বাংলার চিরায়ত ছয় ঋতুর মধ্যে হেমন্ত যেন শরৎ আর আসন্ন শীতের মাঝে এক সেতুবন্ধ।

পাকতে শুরু করেছে আমন ধান। ধান খেতের মাঝে সবজি চাষের জন্য জমি প্রস্তুত করছেন কৃষি শ্রমিকেরা। কাজ শেষে তাঁরা বাড়ি ফিরছেন। বৃহস্পতিবার বিকেলে পঞ্চগড় সদর উপজেলার গরিনাবাড়ি ইউনিয়নের রজলী খালপাড়া এলাকায়

উত্তরের জনপদে হেমন্তেই যেন শুরু হয়ে গেছে শীতের আমেজ। সন্ধ্যার পর শুরু হয়ে রাতভর ঝরছে হালকা কুয়াশা। সেই কুয়াশা থাকছে সকাল আটটা-নটা অবধি, তাপমাত্রা নেমে এসেছে। পঞ্চগড় সদর উপজেলার শিংপাড়া এলাকায় সকালে হাঁটতে বের হওয়া জাহাঙ্গীর আলম (৪৩) ঘন কুয়াশা দেখে বললেন, মনে হচ্ছে শীত নেমে এসেছে। রাজধানী ঢাকার বাতাসেও এখন হেমন্তের মিষ্টি আবেশ ছড়িয়ে পড়েছে।

হেমন্তের ভোরের বাতাস জানান দিচ্ছে তার শীতল স্পর্শ। সকালবেলায় ঘাসের ডগায়, শিউলি ফুলের পাপড়িতে জমে থাকা শিশিরকণা মুক্তার মতো ঝিকমিক করে ওঠে প্রথম সূর্যের সোনালি আভায়। সে এক অপার্থিব দৃশ্য! যেন প্রকৃতির বুকে কেউ বিছিয়ে দিয়েছে হিরের দ্যুতিময় কণা। শিউলিগাছের তলায় বসে ফুলের মেলা, রাতভর ঝরে পড়া শিউলির মিষ্টি সুবাসে ভরে থাকে চারপাশ।

হেমন্তে গ্রামের পুকুরঘাটে নেমে শিশুরা খেলা করে, কেউ জল ছিটিয়ে হাসে, কেউ শাপলা ছিঁড়ে আনে। কলসি হাতে মেয়েরা আসে ঘাটে। তাদের গালে লেগে থাকে শিশিরের মতোই অনাবিল হাসি। দূরে কাকের কা কা, কাশফুলের দোলা, বাতাসে ভেসে আসে বুড়িয়ে যাওয়া পাতার ঘ্রাণ। এমন ঋতুতে মনে হয়, সময় ধীরে চলে—কেউ তাড়া দেয় না, কেউ ডাকে না।

হেমন্ত মানেই তো ‘নবান্ন’। মাঠজুড়ে এখন শুধু সোনারঙের প্রাচুর্য। দিগন্তবিস্তৃত ধানখেতে পাকা ধানের সোনালি ঢেউ, বাতাসে তার মিঠে ঘ্রাণ। কৃষকের মুখে এখন পরিতৃপ্তির হাসি। কারণ, তাঁদের কঠোর শ্রমের ফসল ঘরে তোলার সময় হয়েছে। কাস্তে হাতে ধান কাটার যে সুর, তা কেবল গান নয়; তা আসলে জীবন ও প্রাচুর্যের জয়গান। উঠানজুড়ে নতুন ধানের মাড়াই, বাতাসে ভেসে আসা নতুন চালের গুঁড়ার ম-ম ঘ্রাণ—এসবই হেমন্তের উৎসবের ছবি। ঘরে ঘরে পিঠাপুলি আর পায়েসের আয়োজন, সে এক অন্য রকম আনন্দ।

হেমন্তের আকাশও হয় বড় উদার। শরতের সাদা মেঘের ভেলা যেন কিছুটা স্থির হয়ে আসে, আকাশ থাকে বেশির ভাগ সময় নির্মল নীল। দুপুরের রোদ থাকে শান্ত ও মিষ্টি, এক স্নিগ্ধ হলুদ আভা ছড়িয়ে থাকে চরাচরে। বিকেলের দিকটা হয় আরও মনোহর। হালকা কুয়াশার পটভূমিতে সূর্য যখন অস্ত যায়, সেই দৃশ্য এক গোধূলি–মায়া তৈরি করে। দিন ছোট হয়ে আসে, সন্ধ্যা নামে দ্রুতপায়ে। এই শান্ত, নীরব প্রকৃতিতে একধরনের বিষণ্নতাও হয়তো লুকিয়ে থাকে।

তবু এই বিষণ্নতা রিক্ততার নয়, বরং পূর্ণতা ও ত্যাগের। প্রকৃতি যেন নিজেকে উজাড় করে দেয় ফুল-ফল-ফসলের সম্ভারে। হেমন্তের শেষ দিকে গাছে গাছে সবুজের সজীবতা কমে আসতে থাকে, শুরু হয় পাতাঝরার পালা। প্রকৃতির এই নীরব প্রস্তুতি আসন্ন শীতের জন্য।

মাঠে ঘাটে ফুটে থাকা কাশফুলে এখনো রয়ে গেছে শরতের রেশ। তবে সময়ের পরিক্রমায় শরতের শেষে এসে গেছে হেমন্তকাল। পদ্মাঘাট, পাবনা, সাম্প্রতিক ছবি।

হেমন্ত আসে নীরবে, তার উপস্থিতি বড় লাজুক। কিন্তু তার দান অপরিসীম। সে আমাদের প্রকৃতির পূর্ণতা দেখায়, শীতের আগমনের জন্য প্রস্তুত করে তোলে আর শিখিয়ে যায় জীবন ও ফসলের জয়গান। কুয়াশার চাদরে মোড়া এই হেমন্ত যেন বাঙালির হৃদয়ে প্রেম, শান্তি আর প্রাচুর্যের এক নতুন বার্তা নিয়ে আসে।

হেমন্তকে সবচেয়ে বেশি গৌরবান্বিত করেছেন জীবনানন্দ দাশ। ‘পিপাসার গান’ কবিতায় কবি লেখেন:

এ দেহ,অলস মেয়ে/ পুরুষের সোহাগে অবশ!—/ চুমে লয় রৌদ্রের রস/ হেমন্ত বৈকালে উড়ো পাখপাখালীর পালে/ উঠানের;—পেতে থাকে কান,/ শোনে ঝরা শিশিরের গান /অঘ্রানের মাঝরাতে;

এই ঋতুতে দাঁড়িয়ে মনে হয়, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই যেন এক কবিতা, যা প্রকৃতি তার নিজের হাতে লিখে চলেছে। গ্রামের পথে, মাঠের ধারে কিংবা নদীর তীরে হেমন্তের এই রূপ যেন আমাদের নতুন করে বাঁচতে শেখায়। শিশিরের ফোঁটায় পা ভিজিয়ে, ম্লান কাশফুলের দোলায় হারিয়ে, ধানের শিষের ঘ্রাণে মেতে আমরা হেমন্তকে স্বাগত জানাই। এই ঋতু আমাদের বলে, জীবন বড় সুন্দর, জীবন রঙিন আর প্রতিটি মুহূর্তে লুকিয়ে আছে এক অপার সম্ভাবনা। হেমন্তের এই নরম আলোয়, শীতল হাওয়ায় আমরা যেন নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাই।