স্বাস্থ্য খাতের বৈষম্য নিয়ে লিখতে গিয়ে মনে হলো, নানা খাতের মধ্যে সে নিতান্তই ব্রাত্য এবং বৈষম্য এর স্তরে স্তরে। গত অর্ধশতকে বৈষম্য কেবলই বেড়েছে।
জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করবে রাষ্ট্র—এ কথা আমাদের সংবিধানে লেখা আছে। অবশ্য এটা রাষ্ট্রের বাধ্যবাধকতা নয়, আকাঙ্ক্ষা মাত্র। কিন্তু ‘স্বাস্থ্য মৌলিক অধিকার’—এ কথা বলে এ খাতের জন্য ৫ শতাংশের কম বাজেট বরাদ্দ করা কোনো কাজের কথা নয়।
গড় আয়ুর ধারাবাহিক বৃদ্ধির সূচকের দিকে তাকিয়ে ‘আমরা স্বাস্থ্যে প্রভূত উন্নতি করেছি’ বলার অর্থ নিজেদের সঙ্গে প্রতারণা করা। শুধু বেঁচে থাকাই কি মানুষের জীবন? কীভাবে বেঁচে আছি, রোগব্যাধির পেছনে কত খরচ করে বেঁচে আছি, সেসব না বুঝে বেঁচে থাকার দৈর্ঘ্য নিয়ে গর্ব করা জীবনের অতি সরলীকরণ।
জরিপে সংখ্যাপ্রীতি বেশি
আমাদের রাজনীতিবিদদের সংখ্যাপ্রীতি প্রবল। স্বাস্থ্যমন্ত্রীরা বিভিন্ন স্বাস্থ্য সূচকে ধারাবাহিক উন্নতি দেখতে এবং দেখাতে খুব পছন্দ করেন। বাস্তব পরিস্থিতি যা–ই হোক, পরিসংখ্যানে মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু ইত্যাদির সংখ্যা যত কম দেখা যাবে, তাঁরা তত খুশি হবেন। উল্টোভাবে, স্বাস্থ্যসেবাগ্রহীতার সংখ্যা যত বড় হবে, তাঁদের আনন্দ তত বাড়বে। আর যাঁরা মন্ত্রীদের তুষ্টি বাড়াতে চান, তাঁরা বড় বড় সংখ্যা উপস্থাপনের চেষ্টায় থাকেন। একটি জাতীয় জরিপে তুষ্টিমূলক সংখ্যা পাওয়া যায়নি বলে সেটির প্রকাশ দুই বছর আটকে রাখা হয়েছিল।
সংখ্যাপ্রীতির কারণে একধরনের মরীচিকা তৈরি হয়। কারণ, সংখ্যাগুলো সাধারণত ‘গড়’ হিসাব। গড় হিসাবে বৈষম্য ও বঞ্চনার চিত্র থাকে না। সংখ্যার প্রবণতা হলো, সে স্ফীতির গল্প বলে, কিন্তু মানের অবনতির গল্প বলে না। দরিদ্র মানুষ যে নিম্নমানের সেবা বেশি দামে কিনছে, এই গল্প সংখ্যা কখনো বলে না।
গর্ভকালীন সেবা মানসম্পন্ন নয়
প্রদীপের নিচের অন্ধকার দেখতে আমাদের ভালো লাগে না, তাই আমরা কাকের মতো চোখ বন্ধ করে রাখতে ভালোবাসি। যেমন ৮৮ শতাংশ প্রসূতি গর্ভকালীন সেবা নেন, কিন্তু গরিবদের মাত্র ৮ শতাংশ পূর্ণাঙ্গ ও মানসম্পন্ন গর্ভকালীন সেবা পান। আমরা ৮৮ নিয়ে নৃত্য করি, কিন্তু ৮-এর কথা বলি না। এভাবে বড় বড় সংখ্যার কথা বলতে বলতে সত্যটা ভুলে যাই। সংখ্যা নিয়ে কারসাজি তথা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পেশাগত নৈতিকতার অভাবও বৈষম্য অব্যাহত থাকার পেছনে বড় ভূমিকা পালন করে।
স্বাস্থ্য খাতের পরিসংখ্যান ভেঙে ভেঙে দেখলেও সবখানে বৈষম্যের চিত্র মেলে। বলা হয়, কাউকে পেছনে ফেলে উন্নয়ন নয়। কিন্তু কারা পেছনে পড়ে আছে? যারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিত নয়। কারা স্বাস্থ্যসেবা কম পেয়েছে? যে দরিদ্রতর। মৃত্যু কাদের মধ্যে বেশি? যারা শহর থেকে যত দূরে থাকে। কারা অপুষ্টিতে বেশি ভোগে? যারা মেয়ে হয়ে জন্মেছে। কারা নিয়মিত ডাক্তার দেখাতে পারে না? যারা পাহাড়ে থাকে, চর–হাওর এলাকায় থাকে।
তাহলে কি শহরে চলে এলেই স্বাস্থ্য ভালো হয়ে যাবে? দূর হয়ে যাবে বৈষম্য? পরিসংখ্যান বলে, শহুরে মানুষের স্বাস্থ্য গ্রামের মানুষের চেয়ে ভালো। কিন্তু এখানেও সেই গড়-শুভংকরের ফাঁকি। প্রায় এক-তৃতীয়াংশ শহুরে মানুষ নিম্নমানের আবাসনে ও বস্তিতে থাকেন। তাঁদের স্বাস্থ্য কিন্তু তাঁদের ছেড়ে আসা ভাইবোনদের চেয়ে খারাপ। তাঁরা নিশ্বাস নেন কার্বন ও সিসাসমৃদ্ধ বাতাসে, মলত্যাগ করে প্রয়োজনীয় পানি পান না, সাবান দিয়ে হাত ধুতে পারেন না, ভোগেন যক্ষ্মায়, নিউমোনিয়ায়, চর্মরোগে। তাঁদের কেউ কেউ হয়তো অভিজাত হাসপাতালে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ পান, কিন্তু অসুস্থ হলে সেই হাসপাতালের চিকিৎসা পাওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না। অথচ স্বাস্থ্যসেবা সর্বজনীন হওয়ার কথা।
সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার কাঠামো ও কাজের পদ্ধতি সাজানো হয়েছে প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীকে মাথায় রেখে। বর্তমানে জনগোষ্ঠীর প্রায় ৭০ শতাংশের বয়স ৩০ বছরের নিচে। বয়ঃসন্ধি ও তারুণ্যের শুরুতে ছেলেমেয়েদের শরীর ও মনের বিশেষ সমস্যাবলি মোকাবিলার প্রয়োজনীয় সক্ষমতা কি আমাদের আছে? সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই বিশাল অংশ যেন স্বাস্থ্যসেবা–কাঠামোর বাইরে রয়ে গেছে। এর পরিণতি বোঝার মতো দূরদৃষ্টি আমাদের নেই। কারণ, আমরা স্বাস্থ্য খাতকে চিকিৎসা খাত বানিয়ে ফেলেছি।
রাষ্ট্রের দায়িত্ব স্বাস্থ্য খাতে সুশাসন নিশ্চিত করা, মান নিয়ন্ত্রণ করা, যেখানে প্রয়োজন লাগাম টেনে ধরা। কিন্তু এসবের অভাবে আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছে। আর্থিক সক্ষমতা, ক্ষেত্রবিশেষে লাইন–ঘাট করতে পারা হয়ে পড়েছে ভালো স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার প্রধান উপায়। স্বাস্থ্যসেবা ক্রেতাদের দর-কষাকষির সুযোগ নেই; সরকার তাদের পক্ষে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করছে না; নেই কার্যকর স্বাস্থ্যবিমার ব্যবস্থা।
মৌলিক পরিবর্তন দরকার
স্বাস্থ্য খাতে বৈষম্য দূর করতে হলে নীতিনির্ধারক ও সরকারের কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গিতে একটা মৌলিক পরিবর্তন দরকার, ইংরেজিতে যাকে প্যারাডাইম শিফট বলা হয়। এই পরিবর্তনটা হতে হবে একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের আদর্শিক অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে। অর্ধশতকে আমাদের সব সরকার নিজেই স্বাস্থ্যসেবা দিতে চায় এবং এ পর্যন্ত এ কাজে তারা ব্যর্থ হয়েছে। সরকারকে ভাবতে হবে যে তার কাজ সেবা প্রদান নয়, তার কাজ প্রয়োজনীয় সম্পদের জোগান দিয়ে এবং স্বাস্থ্য খাতে সুশাসন বজায় রেখে জনগোষ্ঠীর সেবাপ্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ। সরকার নিজে করুক কিংবা লাভ বা অলাভজনক বেসরকারি খাত দিয়ে স্বাস্থ্যসেবা দিক, সাফল্যের মাপকাঠি হতে হবে কতটুকু বা কী বিনিয়োগ করলাম সেই হিসাবে নয়, জনগণের প্রাপ্তি কী হলো সেই হিসাবে।
আমরা হাততালিটা সময়ের একটু আগেই নিয়ে ফেলতে চাই। কতগুলো হাসপাতাল হলো এটা বলা রাজনৈতিক সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু এটুকুতেই হাততালি দিয়ে ফেললে হবে না, কতজন সেই হাসপাতাল থেকে সেবা নিলেন সেখানেও হাততালি দেওয়া যাবে না, উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর সবাই সংখ্যায়, সময়মতো ও পূর্ণ গুণগত মানে প্রয়োজনমাফিক সেই হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা পেয়েছেন কি না, পেয়ে খুশি হয়েছেন কি না, সেই পর্যন্ত জবাবদিহি নিয়ে হাততালি আশা করা যেতে পারে। অর্থাৎ স্বাস্থ্য খাতে সরকারকে ইনপুট ব্যবস্থাপনায় ব্যস্ত না থেকে আউটকাম ব্যবস্থাপনায় নজর এবং দক্ষ হতে হবে। স্বাস্থ্য খাতের বৈষম্য নিরসনী সাফল্য নামের বৃক্ষের পরিচয়টা ফলে হোক এবং অবশ্যই তা মাকাল ফলে নয়।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা একটা অধরা আপ্তবাক্যে পরিণত হয়েছে। কারও অসুখ হলে তাঁর চিকিৎসায় যদি সর্বমোট ১০০ টাকা খরচ হয়, তার ৭৪ টাকাই তাঁকে নগদ গুনতে হয়। যে ২৬ টাকা রাষ্ট্র খরচ করে, তার একটা অংশও কিন্তু তাঁরই দেওয়া প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ কর। বহু পরিবার চিকিৎসার খরচ জোগাড় করে ধার করে, স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বিক্রি করে, শিক্ষার মতো অন্য প্রয়োজনীয় খরচ বাদ দিয়ে। প্রায় ১৩ শতাংশ পরিবার প্রতিবছর স্বাস্থ্যসেবার খরচ জোগান দিতে গিয়ে দারিদ্র্যে পতিত হয়। এই মানুষদের কিন্তু রাষ্ট্রের সুরক্ষা পাওয়ার কথা ছিল, তারা তা পায়নি। বিশ্বসভায় সই করে বাংলাদেশ কথা দিয়ে এসেছিল, পাবে। এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশ কথা রাখেনি।
বাতাসে কান পাতলে অবশ্য কিছুটা আশার ফিসফিসানি শোনা যায়: স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট ও পরামর্শগুলো ছাপা কাগজেই সীমাবদ্ধ নেই। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল ও তাদের শীর্ষ পর্যায় থেকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে সেগুলো জানা, বোঝা ও সমাধানের উপায় নিয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত নেওয়া হচ্ছে। নিঃসন্দেহে ভালো খবর, আশার খবর। আমরা আশা করি, রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে তাদের চিন্তাভাবনা পরিষ্কার করে বলবে এবং ভুলে যাবে না। স্বাস্থ্য খাতের বৈষম্য দূর করতে আমলাতন্ত্র, মুনাফার আগ্রাসী লোভ, পেশাতন্ত্রের যে পরিমাণ বোঝা ঠেলে সরাতে হবে, আশা করি আগামীর ক্ষমতাসীন দলগুলো তাতে পিছপা হবে না।
*মতামত লেখকদের নিজস্ব, প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থান নয়।