Thank you for trying Sticky AMP!!

সতর্কবার্তা হিসেবে দেখছে সব পক্ষ

সরকারি মহলসহ নির্বাচনসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার কর্মকর্তাদের মধ্যেও একধরনের অস্বস্তি তৈরি হয়েছে।

সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ও মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। গতকাল ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে

‘বাংলাদেশে ভোটের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে’ যুক্তরাষ্ট্র নতুন যে ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে, এটাকে ‘কঠোর সতর্কবার্তা’ হিসেবে দেখছে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ। এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে সরকার বা দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে কোনো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া আসেনি। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—দুই দলই এটিকে একে অন্যের জন্য সতর্কবার্তা বলে প্রচার করছে। এ ছাড়া বিএনপি ও জাতীয় পার্টি যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে।

রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে সরকারি মহলসহ নির্বাচনসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার কর্মকর্তাদের মধ্যেও একধরনের অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। তাঁরা এর প্রভাব কী হতে পারে সেটা বোঝার চেষ্টা করছেন বলে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের সূত্র থেকে জানা গেছে।

Also Read: বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা দিলে ভিসা দেবে না যুক্তরাষ্ট্র

বাংলাদেশের নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে বলে কিছুদিন ধরে দেশে গুঞ্জন ছিল। ‘যারা স্যাংশন (নিষেধাজ্ঞা) দেবে, তাদের কাছ থেকে কিছু কেনা হবে না’—সরকারের পক্ষ থেকে এমন ঘোষণা আসার পর এমন গুঞ্জনের বিস্তার ঘটে। এমন প্রেক্ষাপটে গত বুধবার রাতে যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্টের ২১২ (এ) (৩) (সি) (‘৩ সি’) ধারা অনুযায়ী, বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করে দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তর। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত ব্যক্তি ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে ভিসায় বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে।

আজ সকালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি এবং গতকাল আমাদের বিবৃতিতে যা দেখেছেন, তা বাংলাদেশের জনগণ, সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী—সবার জন্য অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আহ্বান জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
পিটার হাস, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত

এই ঘোষণার পরদিন গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকায় ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। দিনের প্রথম ভাগে তিনি আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। বিকেলে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হন।

বৈঠক শেষে পিটার হাস সাংবাদিকদের বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি বাংলাদেশের নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রতি ওয়াশিংটনের সমর্থনের অংশ। তিনি বলেন, ‘আজ (বৃহস্পতিবার) সকালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি এবং গতকাল (বুধবার) আমাদের বিবৃতিতে যা দেখেছেন, তা বাংলাদেশের জনগণ, সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী— সবার জন্য অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আহ্বান জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।’

Also Read: আদেশদাতা ও বাস্তবায়নকারী—কেউই মার্কিন ভিসা পাবেন না: ডোনাল্ড লু

কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, দুটি বৈঠকেই আলোচনার বড় পরিসরজুড়ে ছিল বুধবার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের ঘোষিত বাংলাদেশের জন্য মার্কিন নতুন ভিসা নীতি।

ঘোষণার আগেই সরকার সিদ্ধান্তটি জানত নির্বাচন ঘিরে বাংলাদেশের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতির বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারকে ৩ মে জানিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। এটি বুধবার অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন তাঁর বিবৃতিতে স্পষ্ট করে বলেছেন। গতকাল সকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনও সাংবাদিকদের বলেছেন, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁকে চিঠি দিয়ে ওই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলেন।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম গতকাল সন্ধ্যায় তাঁর দপ্তরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘মে মাসের ৩ তারিখ একটি বৈঠকে তারা (যুক্তরাষ্ট্র) আমাদের মৌখিকভাবে এটি জানিয়েছিল। তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আমরা যেন এটি প্রকাশ না করি। তারা এমনভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করতে চেয়েছে, যাতে ভুল বার্তা না যায়। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বুধবার টুইট করে প্রথম এই সিদ্ধান্তের কথা জানান।’

কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, রাজনীতিবিষয়ক মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড ৩ মে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অংশীদারত্ব সংলাপের সময় পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনকে ভিসা নীতিতে পরিবর্তনের বিষয়টি মৌখিকভাবে জানান। ওই বৈঠকের পর বাংলাদেশ সরকারের শীর্ষ মহল নিশ্চিত হয় যে নতুন করে কোনো নিষেধাজ্ঞা নয়, বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে বাধাদানকারী ব্যক্তি ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের ভিসার ওপর বিধিনিষেধ আসতে যাচ্ছে।

Also Read: ভিসা নীতি বাংলাদেশের নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় মার্কিন সমর্থনের অংশ: পিটার হাস

বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের এ-সংক্রান্ত ঘোষণার আগেই ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের মাধ্যমে সরকারের একাধিক মন্ত্রীও বিষয়টি জানতে পারেন। এর আগে ২৩ মে অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন চিঠি দিয়ে এই সিদ্ধান্তের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে এ কে আব্দুল মোমেনকে জানান।

নতুন মার্কিন নীতি বরং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আমাদের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করেছে। নীতিটি ভালো, এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।
এ কে আব্দুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী

সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্র থেকে জানা গেছে, আগে থেকে বিষয়টি নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে কথাবার্তা হওয়ার ফলে বাংলাদেশ সরকার নানা দিক বিবেচনায় নিয়ে সতর্কতার সঙ্গে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। গতকাল সকালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রচারিত বিবৃতিতে ওয়াশিংটনের ভিসা নীতিসংক্রান্ত সিদ্ধান্তকে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অব্যাহত অঙ্গীকারের প্রতি জোরালো সমর্থনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রশংসা করা হয়।

অবশ্য সন্ধ্যায় ওই বিবৃতিতে কিছুটা পরিবর্তন এনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আশা প্রকাশ করা হয় যে এই ভিসা নীতি ‘যথেচ্ছভাবে প্রয়োগের পরিবর্তে বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে’ অনুসরণ করা হবে।

আ.লীগে অস্বস্তি

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি আওয়ামী লীগ ও সরকারকে একধরনের চাপে ফেলেছে বা ফেলতে পারে, আওয়ামী লীগের ভেতরে এমন আলোচনা আছে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে। যদিও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘নতুন মার্কিন নীতি বরং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আমাদের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করেছে। নীতিটি ভালো, এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।’ তিনি বলেন, নতুন মার্কিন ভিসা নীতি বিরোধী দলগুলোকে নির্বাচন নিয়ে কোনো সহিংসতার বিষয়ে সতর্ক করবে।

আওয়ামী লীগ নেতারা বলার চেষ্টা করছেন, মার্কিন এই নীতির কারণে এখন বিএনপির নির্দলীয় সরকারের দাবি ও নির্বাচন প্রতিহত করার অবস্থানের যৌক্তিকতা থাকবে না। এ ধরনের মন্তব্যের মধ্য দিয়ে সরকারের মন্ত্রী ও নেতারা বিষয়টিকে ‘হালকাভাবে’ দেখানোর চেষ্টা করলেও ভেতরে-ভেতরে এ নিয়ে অস্বস্তি আছে বলে সরকার ও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে। অবশ্য কোনো মন্ত্রী বা আওয়ামী লীগের কোনো নেতা সেটা প্রকাশ্যে বলছেন না।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ ও সরকার যুক্তরাষ্ট্রের এই ঘোষণায় বিচলিত নয়। তারা বিষয়টা পর্যবেক্ষণ করছে। তাঁর মতে, এই ‘সতর্কবার্তা’ সব দলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।

সুষ্ঠু নির্বাচনে সহায়ক মনে করছে বিএনপি

মার্কিন নতুন ভিসা নীতিকে সরকারের জন্য ‘কঠোর সতর্কবার্তা’ হিসেবে দেখছে বিএনপি। এতে কিছুটা স্বস্তির ভাব দেখা গেছে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলনে থাকা দলটির নেতা-কর্মীদের মধ্যে। তাঁরা মনে করছেন, নতুন মার্কিন ভিসা নীতি সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।

বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা মনে করছেন, বিরোধী দলের সভা-সমাবেশে আগের মতো সরকারি দল বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বাধা দিতে পারবে না। সব পক্ষকে কিছুটা হলেও সংযত করবে।

গতকাল গুলশানে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের বাসায় বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, এটা (মার্কিন ভিসা নীতি) ক্ষমতাসীনদের জন্য বড় বার্তা। বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথে এটা একটা বড় পদক্ষেপ। তাঁরা এটাকে স্বাগত জানাচ্ছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গণতন্ত্র ধ্বংসের জন্য, নির্বাচনে চুরির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের এই ঘোষণা এসেছে। এটা বাংলাদেশকে বিদেশের কাছে ছোট করেছে।

পিটার হাসের সঙ্গে বৈঠকের জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হকও সাংবাদিকদের বলেছেন, তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের এ পদক্ষেপ স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ নিয়ে মার্কিন ভিসা নীতির উদ্দেশ্য বোঝা গেছে, তারা একটা সুষ্ঠু নির্বাচন চায় এবং নির্বাচনটা যেন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়। এই ব্যাপারে আমাদের দলও একমত। আমরা বলেছি, মার্কিন সরকার যে ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে, তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।’

একধরনের নতুন চাপ

এর আগে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালে র‌্যাব এবং বাহিনীটির সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। তবে দেশটির এবারের ঘোষণায় কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ না করা হলেও এর আওতা আরও বড় মনে করা হচ্ছে। কারণ, এর আওতায় বর্তমান ও সাবেক সরকারি কর্মকর্তা, সরকার সমর্থক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর সদস্যরাও পড়বেন বলে উল্লেখ রয়েছে।

এ বিষয়ে রাজনৈতিক মহলের নাগরিকদের মধ্যেও নানা আলোচনা আছে। কারও কারও মতে, একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব সরকারের ওপর ন্যস্ত। ফলে মার্কিন নতুন ভিসা নীতি সরকারের জন্য একধরনের চাপ। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র নতুন যে ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে, এর আওতায় লোকজনকে কীভাবে আনা হবে, সেটা এখনো স্পষ্ট নয়। প্রাথমিকভাবে নতুন এই ভিসা নীতির পরিধি ব্যাপক বলে নির্বাচনের নানা প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মধ্যে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে।