গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপিয়ারেন্সের সদস্য আনা লোরেনা ডেলগাদিলো পেরেজ আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন। ঢাকা, ১৮ জুন
গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপিয়ারেন্সের সদস্য আনা লোরেনা ডেলগাদিলো পেরেজ আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন। ঢাকা, ১৮ জুন

গুমবিষয়ক আলোচনা

অনেক অপরাধী ক্ষমতার আসনে

গুমের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের অনেকে এখনো ক্ষমতার আসনে রয়েছেন। অন্যদিকে ভুক্তভোগীদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে এবং তাঁরা ভীত। এমন মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপিয়ারেন্সের (ডব্লিউজিইআইডি) ভাইস চেয়ার গ্রাজিনা বারানোস্কা।

ঢাকায় সফররত জাতিসংঘের গুমবিষয়ক কমিটির এই সদস্য বলেন, ‘আমরা এখানে বারবার শুনেছি, অনেক অপরাধী এখনো ক্ষমতার আসনে বহাল রয়েছেন। এটাই মূল সমস্যা, অবিলম্বে এ সমস্যার সমাধান করতে হবে।’

বুধবার ‘বাংলাদেশে গুম মোকাবিলায় করণীয়’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে গ্রাজিনা বারানোস্কা এ কথাগুলো বলেন। রাজধানীর বাংলামোটরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে এ আলোচনার আয়োজন করে বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর কার্যালয় (ইউএনআরসি)।

অনুষ্ঠানে গুমসংক্রান্ত পরিস্থিতি, রাষ্ট্রীয় ভূমিকা এবং সম্ভাব্য প্রতিকার নিয়ে আলোচনা হয়। এতে অংশ নেন জাতিসংঘের দুই প্রতিনিধির বাইরে গুমের ভুক্তভোগী, দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার ব্যক্তিরা।

ভুক্তভোগী, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ব্যক্তিরা আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন। ঢাকা, ১৮ জুন

গত রোববার জাতিসংঘের দুই সদস্যের প্রতিনিধিদল ঢাকায় আসে। বারানোস্কার সঙ্গে এই দলে আছেন ওয়ার্কিং গ্রুপের সদস্য আনা লোরেনা ডেলগাদিলো পেরেজ। বাংলাদেশে গুমের ঘটনা তদন্তে দীর্ঘদিন ধরে ঢাকায় আসতে চাইছিল ডব্লিউজিইআইডি। শেষ পর্যন্ত এক যুগ পর তারা আসার সুযোগ পেল।

আলোচনায় গ্রাজিনা বারানোস্কা বলেন, ‘আমি মোটেও অবাক হই না, যখন দেখি পরিবারগুলো থানায় মামলা করতে ভয় পায়। কারণ, যে ব্যক্তি গুমের জন্য দায়ী ছিলেন, তিনি যদি এখনো সেই একই ভবনে কর্মরত থাকেন, তাহলে তাঁদের ভয় পাওয়া খুবই স্বাভাবিক। অপরাধীরা যদি এখনো ক্ষমতার জায়গায় থাকেন, সেখানে কোনোভাবেই ভুক্তভোগীকেন্দ্রিক বিচারপ্রক্রিয়া সম্ভব নয়।’

গুমের বিচার প্রসঙ্গে বারানোস্কা বলেন, সব ভুক্তভোগীই যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) সম্পর্কে জানেন, এমন নয়। তাই পরিবারগুলোর কাছে পৌঁছে যাওয়া এখন গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। আইসিটি কী কাজ করে, তা ব্যাখ্যা করা এবং অনুসন্ধান কমিশনের ভূমিকা তাদের জানানো উচিত।

জাতিসংঘের এই প্রতিনিধি বলেন, আইসিটিকে অবশ্যই একটি নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে হবে। বর্তমান আইনি প্রেক্ষাপটে ভাবার সময় এসেছে কীভাবে তাঁদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া যায়, কীভাবে একটি নিরাপদ পরিসর তৈরি করা যায়। যাতে তাঁরা কেবল নিরাপদ বোধই না করেন, বাস্তবেও নিরাপদ থাকেন।

গ্রাজিনা বারানোস্কা বলেন, ‘আমরা এমন ঘটনার কথাও শুনেছি, যেখানে শুধু তাঁরা আইসিটিতে মামলা দায়ের করেছে বলেই পরিবার ও সিভিল সোসাইটিকে দমনমূলক পদক্ষেপের মুখে পড়তে হয়েছে। শুধু ভয়ের বিষয় নয়, বাস্তবেই হয়রানি চলছে।’

জাতিসংঘের এই প্রতিনিধি আরও বলেন, বিচারের প্রয়োজন রয়েছে। তবে এই বিচারে যদি তাড়াহুড়া করা হয়, তাহলে তা ন্যায্য বিচারের অভাব সৃষ্টি করতে পারে। ভুক্তভোগী পরিবার ও নিখোঁজদের জন্য যে জিনিসটি জরুরি, তা হলো একটি এমন রায়, যা বাস্তব এবং স্থায়ী, যা ন্যায্য বিচারপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এসেছে এবং যা সময়ের পরীক্ষায় টিকে থাকবে। কারণ, যদি কোনো রায় পরে বাতিল হয় বা পুনর্বিবেচনা করতে হয়, তাহলে সেটি সব পরিবারের জন্যই হতাশাজনক ও ক্ষতিকর হবে। বিচার ও তদন্তপ্রক্রিয়ায় তাঁরা প্রযুক্তিগত সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত বলে উল্লেখ করেন।

আনা লোরেনা ডেলগাদিলো পেরেজ বলেন, ‘আমাদের সুপারিশ হলো এসব (গুমের) ঘটনার জন্য অবশ্যই বিচার হতে হবে। বিচার মানে শুধু আদালতের রায় নয়, ভুক্তভোগীদের আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া যে তাঁরা গুম, নির্যাতন ও অন্যান্য অপরাধের শিকার হয়েছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা হয়েছিল, সেগুলো বাস্তব প্রমাণ ছাড়া ছিল। এসব মামলা বাতিল করতে হবে।’

‘বাংলাদেশে গুম মোকাবিলায় করণীয়’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা। ঢাকা, ১৮ জুন

সেনাপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়ে লোরেনা পেরেজ বলেন, তিনি গুমের তদন্ত ও বিচারে সহযোগিতার কথা বলেছেন। কিন্তু ‘সহযোগিতা’ শব্দটি কেবল উচ্চারণ করলেই যথেষ্ট নয়। সহযোগিতা শব্দকে রূপান্তর করতে হবে নির্দিষ্ট কার্যক্রমে। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর কাছে প্রমাণ আছে। সেই প্রমাণগুলো ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আদালতে পেশ করতে হবে—এটাই প্রকৃত সহযোগিতা।

লোরেনা পেরেজ বলেন, একটি দেশের পুনর্গঠনের প্রথম ধাপ হলো—যা ভুল হয়েছে, তা স্বীকার করা। যে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে, যে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তা মেনে নেওয়া—তা অস্বীকার না করা। সেনাবাহিনীর অংশবিশেষ এর সঙ্গে জড়িত ছিল—এটা অস্বীকার করা যায় না। অনেক সামরিক কর্মকর্তা দেশে অপরাধ করে আজও বিচারের বাইরে রয়েছেন। যাঁরা এই অপরাধের জন্য দায়ী, তাঁরা যেন এখনো সরকারি পদে বহাল না থাকেন—সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজের ফ্যাকাল্টি মেম্বার মেজর জেনারেল হাকিমুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কোনো আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নয়। তবে সেনাবাহিনীর কিছু কর্মকর্তা ডেপুটেশনে অন্যান্য বাহিনীতে কাজ করেন। আর প্রধানমন্ত্রী বা প্রধান উপদেষ্টা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকায় ডিজিএফআইও তাদের অধীনে কাজ করে।

সেনাবাহিনীর জাজ অ্যাডভোকেট জেনারেল ব্রিগেডিয়ার আসিফ ইকবাল বলেন, ভুক্তভোগীদের বর্ণনায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই র‌্যাবের নাম এসেছে। র‌্যাব চলে পুলিশের অধীনে। আর ডিজিএফআইয়ের নাম এসেছে, সেটি চলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে। এগুলো সেনাবাহিনী পরিচালনা করে না। এখানে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা ডেপুটেশনে কাজ করেন। এই সংস্থাগুলোর দায় সেনাবাহিনীর নয়।

ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সমাজকল্যাণ ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক গোলাম মুর্তজা ২০১০ সালে কীভাবে গুমের শিকার হয়ে র‌্যাবের বন্দিশালায় নির্যাতনের মুখোমুখি হন, তার বর্ণনা দেন। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সময়ে আইনবহির্ভূতভাবে বন্দী থাকা দুই শিক্ষার্থীও তাঁদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া অমানবিক আচরণের বর্ণনা তুলে ধরেন অনুষ্ঠানে।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপদেষ্টা মাহদী আমিন বলেন, বিএনপির অনেক নেতা–কর্মীও গুমের শিকার হয়েছেন। এ ধরনের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের দায়মুক্তির সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে।

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা বলেন, ‘জোর করে এভাবে কাউকে তুলে নিয়ে গুম করা হবে, সেই বাংলাদেশ আর দেখতে চাই না।’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মানজুর–আল–মতিন বলেন, গুমের জন্য পৃথকভাবে এমন একটি কমিশন গঠন করা দরকার, যারা সত্যিকার অর্থে আইনের প্রয়োগ করে এই অপরাধ বন্ধ করতে পারবে।

ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ মানবাধিকারবিষয়ক উপদেষ্টা হুমা খানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন হেফাজতে ইসলামের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব জুনায়েদ আল হাবিব, মানবাধিকারকর্মী রেজাউর রহমান লেনিন, পুলিশ সুপার শারমিন আক্তার, নেত্র নিউজের সম্পাদক তাসনিম খলিল প্রমুখ।