
বরগুনার মানুষ কয়েক বছর ধরেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন। এ বছর যে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে পারে, সেই সতর্কতাও ছিল। বছরের শুরুতে কীটতত্ত্ববিদেরা বলেছিলেন, বরগুনায় এডিস মশা বিস্তারের ঝুঁকি আছে। তবু প্রশাসন প্রতিরোধমূলক কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। প্রশাসনের উদাসীনতায় ডেঙ্গুতে ভুগছে বরগুনা।
এখন বরগুনা জেলা সদর হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর ঢল নেমেছে। ২৫০ শয্যার এ হাসপাতালে প্রতিদিন ৫০ জনের বেশি ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হচ্ছেন। রোগীর পরিস্থিতি জানার জন্য নিয়মিত রক্তের অণুচক্রিকা বা প্লাটিলেট পরিমাপ করে দেখতে হয়। কিন্তু এ হাসপাতালে প্রয়োজনীয় সব পরীক্ষা হচ্ছে না। অনেক রোগীকে পরীক্ষার জন্য যেতে হচ্ছে শহরের বিভিন্ন ক্লিনিকে। এটা রোগীর জন্য অনেক কষ্টের, স্বাস্থ্যঝুঁকিও বেড়ে যায়। পাশাপাশি রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। সব রোগী খাবারও পাচ্ছেন না। খাবার আনতে হচ্ছে হাসপাতালের বাইরে থেকে।
হাসপাতালের এ চিত্র গত পরশু সোমবারের। মশা বিস্তারের উপযুক্ত পরিবেশও শহর ঘুরে দেখা গেছে। এদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকায় নির্মাণকাজ দেখা গেছে। গলির মধ্যে বাড়ির সামনে পানির পাত্র চোখে পড়ে, অনেক বাড়ির সামনে পানি জমে আছে। থানাপাড়ায় একটি বাড়ির কয়েকজন সদস্য বলেন, তাঁরা নিজেরাই সচেতনভাবে পানি সংরক্ষণ ও ব্যবহার করেন না। এ পাড়ায় সর্বশেষ মশার ওষুধ দেওয়া হয়েছে মাসখানেক আগে। সাহাপাড়ায় এক চায়ের দোকানি বলেন, কয়েকজন মারা গেছেন। এখন যদি মানুষের হুঁশ হয়।
এখন বরগুনা জেলা সদর হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর ঢল নেমেছে। ২৫০ শয্যার এ হাসপাতালে প্রতিদিন ৫০ জনের বেশি ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হচ্ছেন।
গত বছর ও চলতি বছরের শুরুতে কীটতত্ত্ববিদেরা বলেছিলেন, বরগুনায় ডেঙ্গু বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি আছে। কিন্তু পৌরসভা কর্তৃপক্ষ মশা নিধন ও জনসচেতনতায় গুরুত্ব দেয়নি। স্বাস্থ্য বিভাগ চিকিৎসার সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখেনি। প্রশাসন এখন বলছে, রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রতিনিধিরা এখন বরগুনায় এসেছেন। তাঁদের কাছ থেকে জানা যাবে, কেন বরগুনায় ডেঙ্গু বেশি।
গতকাল মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের হিসাব অনুযায়ী, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে নতুন করে ২৪৪ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে বরগুনা জেলায় শনাক্ত হয়েছে ৮২ জন। এ বছর গতকাল পর্যন্ত সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬ হাজার ৪৬৬ জন। মারা গেছেন ৩০ জন। এ পর্যন্ত বরগুনায় মারা গেছেন ৫ জন আর আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৮৩১ জন। সারা দেশের আক্রান্তের ২৮ শতাংশ শুধু এ জেলায়। গতকাল সদর হাসপাতালে শুধু ডেঙ্গু রোগী ভর্তি ছিলেন ২৩৩ জন।
গত বছর ও চলতি বছরের শুরুতে কীটতত্ত্ববিদেরা বলেছিলেন, বরগুনায় ডেঙ্গু বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি আছে। কিন্তু পৌরসভা কর্তৃপক্ষ মশা নিধন ও জনসচেতনতায় গুরুত্ব দেয়নি।
স্বাস্থ্য বিভাগ ডেঙ্গু ওয়ার্ডগুলো করেছে বরগুনা সদর হাসপাতালের ছয়তলায়। গত সোমবার বেলা ১১টায় ওই হাসপাতালে গিয়ে লিফটের সামনে মানুষের সারি চোখে পড়ে। তাঁদের অধিকাংশ রোগীর আত্মীয়, কেউ কেউ রোগী। সিঁড়ি দিয়ে ছয়তলায় ওঠার আগেই দেখা যায়, মানুষের ভিড়ে পথ বন্ধ।
ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখা যায়, ‘পা ফেলার জায়গা নেই’ বলতে যা বোঝায় ঠিক তেমন পরিস্থিতি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ডেঙ্গু রোগীদের জন্য ৫০ শয্যার আয়োজন করেছে। প্রত্যেকটি রোগীর সঙ্গে একাধিক আত্মীয় বা দর্শনার্থী দেখা যায়। পুরুষ ওয়ার্ডে মেঝেতে থাকা একজন রোগীর সঙ্গে ছিলেন পাঁচজন—তাঁর বাবা, মা, স্ত্রী, বোন ও ছোট একটি শিশু।
হাসপাতালের পুরুষ ও মহিলা ওয়ার্ডে শয্যায় জায়গা না হওয়ায় রোগীদের চিকিৎসা চলছে ওয়ার্ডের মেঝেতে, নার্সদের ডেস্কের পেছনে, ওয়ার্ডের বারান্দায়। প্রত্যেক রোগীর শয্যার পাশে বা ওপরে আছে থালা, গ্লাস, বালতি, পানির বোতল, জামাকাপড়–গামছা, খাবার আনা–নেওয়ার পাত্র, ওষুধের প্যাকেট, হাতপাখা। প্রত্যেক রোগীর সঙ্গে ছোটখাটো সংসার। এর সঙ্গে আছেন চিকিৎসক, নার্স, আনসার, ওয়ার্ড বয়, স্বেচ্ছাসেবক ও বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিক।
গতকাল মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের হিসাব অনুযায়ী, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে নতুন করে ২৪৪ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে বরগুনা জেলায় শনাক্ত হয়েছে ৮২ জন।
বরগুনা শহরের ফুলঝুরি এলাকার কাপড়ের ব্যবসায়ী আলী হোসেন ও তাঁর দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়া ছেলে মোহাম্মদ প্রিন্স ডেঙ্গুর রোগী। বাবা ও ছেলে দুজনই হাসপাতালে ভর্তি। দুজনেরই জায়গা হয়েছে বারান্দায়।
আলী হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ৯ জুন ছেলের জ্বর দেখা দেয়। ১০ জুন বেসরকারি একটি রোগনির্ণয় কেন্দ্রে পরীক্ষায় ছেলের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। ওই দিনই ছেলেকে সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরদিন ছেলের প্লাটিলেট পরীক্ষার সময় নিজেরও ডেঙ্গু পরীক্ষা করান। তাঁরও ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। সেই থেকে বাবা–ছেলে একই শয্যায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
আলী হোসেন বলেন, তাঁদের দুজনের রক্তের সব পরীক্ষা বেসরকারি ক্লিনিক থেকে করা হচ্ছে। ভর্তির পর থেকে ওই দিন পর্যন্ত তারা হাসপাতাল থেকে কোনো খাবার পাননি।
পাশের রোগী মো. ইয়াসিনের বাসা ধানসিঁড়ি সড়কে। গাড়ি মেরামতের কাজ করেন। বরগুনা সদর উপজেলা পরিষদের সামনে তাঁর দোকান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, চার দিন আগে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। হাসপাতালে তাঁর কোনো পরীক্ষা করানো হয়নি। সব পরীক্ষা হয়েছে বেসরকারি ক্লিনিক থেকে। তিনি সব দিনই বাসা থেকে আনা খাবারই খেয়েছেন।
এ পর্যন্ত বরগুনায় মারা গেছেন ৫ জন আর আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৮৩১ জন। সারা দেশের আক্রান্তের ২৮ শতাংশ শুধু এ জেলায়। গতকাল সদর হাসপাতালে শুধু ডেঙ্গু রোগী ভর্তি ছিলেন ২৩৩ জন।
আলী হোসেন বা মো. ইয়াসিন ছাড়া আরও কয়েকজন রোগী জানিয়েছেন, পরীক্ষার জন্য তাঁরা শহরের বিভিন্ন ক্লিনিকে যান। একজন রোগী বলেন, ক্লিনিক থেকে এসে তাঁর রক্ত নিয়ে গেছে।
পুরুষ ও মহিলা ওয়ার্ডে বেশ কিছু শয্যায় মশারি চোখে পড়ে। তবে অধিকাংশ মশারি ভাঁজ করে বা দড়ি খুলে রাখা। পুরুষ ওয়ার্ডের একজন রোগী বলেন, তিনি মশারি ব্যবহার করেন না। কারণ, তাঁর খাটের চেয়ে মশারি বড়। তবে মেঝেতে, বারান্দায়, ওয়ার্ডের সামনে, নার্সদের ডেস্কের পেছনে থাকা কোনো রোগীকে মশারি ব্যবহার করতে দেখা যায়নি। মশারি টানানোর মতো ব্যবস্থা নেই।
জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলেন, ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা হয়, এমন হাসপাতাল থেকে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকে। তাঁদের পরামর্শ হচ্ছে, মশার মাধ্যমে যেন রোগীর শরীরের জীবাণু ছড়িয়ে না পড়ে, সে জন্য মশারি ব্যবহার করতে হবে। হাসপাতালে ভিড় কমাতে হবে। বাস্তবতা হচ্ছে, বরগুনা সদর হাসপাতালে এর কিছুই মানা হচ্ছে না।
বরগুনা জেলা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মো. রেজাওয়ানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অনেক পরীক্ষা বাইরে করানো হচ্ছে এ কথা ঠিক। কিন্তু সম্পদের সীমাবদ্ধতার কথাও মনে রাখতে হবে। ২৫০ শয্যার হাসপাতালে ৬০০ রোগী ভর্তি থাকলে সবাইকে খাবার দেওয়াও সম্ভব হয় না।
জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, আমতলী, বেতাগী, পাথরঘাটা, তালতলী, বামনা ও বরগুনা সদর—সব কটি উপজেলায় এবার ডেঙ্গু দেখা দিয়েছে। সদর উপজেলার বাইরে সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে পাথরঘাটা উপজেলায়। এ উপজেলায় এ পর্যন্ত ৭৭ জন আক্রান্ত হয়েছেন।
১০ জন বা তার বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন এ রকম ৩৬টি এলাকা চিহ্নিত করেছে জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়। এ কাজে সহায়তা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওই তালিকায় দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি রোগী হাসপাতালে আসছেন শহরের লাকুরতলা ও সদর রোড এলাকা থেকে। এ দুটি এলাকা থেকে ১৩৭ জন করে রোগী হাসপাতালে এসেছেন। অন্য যেসব এলাকায় রোগী বেশি আছে, তার মধ্যে মনসাতলী, কলেজ রোড, গৌরীচান্না, চরকলোনি, কাঠপট্টি, টাউন হল, থানাপাড়া, ডিকেপি রোড ও খেজুরতলা অন্যতম। এসব এলাকা থেকে ৩০ জন বা তার বেশিসংখ্যক রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন।
জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, আমতলী, বেতাগী, পাথরঘাটা, তালতলী, বামনা ও বরগুনা সদর—সব কটি উপজেলায় এবার ডেঙ্গু দেখা দিয়েছে। সদর উপজেলার বাইরে সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে পাথরঘাটা উপজেলায়। এ উপজেলায় এ পর্যন্ত ৭৭ জন আক্রান্ত হয়েছেন।
ডেঙ্গুর উপস্থিতি বরগুনায় নতুন নয়। গত কয়েক বছরের সরকারি হিসাব বলছে, জেলাটিতে ডেঙ্গু ছিল। ২০২২ সাল জেলায় ৪৮৫ জন আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। এর পরের বছর ২০২৩ সালে ভর্তি হয়েছিলেন ৪ হাজার ৫৯২ জন, এর মধ্যে মারা যান ৭ জন। গত বছর ভর্তি হয়েছিলেন ২ হাজার ৪৩৪ জন, মারা যান ৪ জন।
বরগুনায় এবার কেন ডেঙ্গু বেশি—এ প্রশ্নের উত্তরে জেলার সিভিল সার্জন মোহাম্মদ আবুল ফাত্তাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি জানার জন্য আমরা আইইডিসিআরের গবেষকদের আমন্ত্রণ জানিয়েছি। তাঁরা তিনটি বিষয় দেখবেন—ডেঙ্গুর চারটি ধরনের মধ্যে কোনটিতে মানুষ বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন, এডিস মশার জিনগত কোনো পরিবর্তন ঘটেছে কি না এবং কেন বরগুনা হট স্পট।’
কেন হট স্পট, সেটা অবশ্য আগেই বলেছিলেন মশাবিশেষজ্ঞ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক কবিরুল বাশার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি গত বছর এবং এ বছরের শুরুতে বলেছিলাম, বরগুনাতে এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধি পাবে। কারণ, আমরা বরগুনায় এডিস মশার বিপুল উপস্থিতি শনাক্ত করেছিলাম। আমরা মানুষের বাড়িতে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার প্রায় ৫০ শতাংশ পাত্রে মশার লার্ভা পেয়েছিলাম।’
ডেঙ্গুর উপস্থিতি বরগুনায় নতুন নয়। গত কয়েক বছরের সরকারি হিসাব বলছে, জেলাটিতে ডেঙ্গু ছিল।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোয় বৃষ্টির পানি ধরে রেখে প্রায় সারা বছর ব্যবহার করার চর্চাটি পুরোনো। তাহলে শুধু বরগুনায় ডেঙ্গুর প্রকোপ কেন, অন্য উপকূলীয় জেলায় কেন নয়?
কবিরুল বাশার বলেন, বরগুনায় তিনটি কারণ একত্র হওয়ায় ডেঙ্গু বেড়েছে। যে পরিবেশে এডিস মশার বংশবিস্তার দ্রুত ঘটে, তা দিয়েছে বৃষ্টির পানি। এখানে মানুষের শরীরে আগেই ডেঙ্গুর ভাইরাস ছিল। আবার এখানে মশাও প্রচুর। পরিবেশ, মানুষ ও ভাইরাস—এই তিন বিষয় একত্র হওয়ায় ডেঙ্গু বেড়েছে। তিনি মনে করেন, এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে বরিশাল, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার পরিস্থিতি বরগুনার মতো হতে পারে।
অবশ্য স্থানীয় মানুষ বিষয়টি অন্যভাবেও দেখেন। স্থানীয় নাগরিক সংগঠন স্বাস্থ্য অধিকার ফোরামের সভাপতি হাসানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় জেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগ দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়নি, এলাকার মানুষ অসচেতন, প্রশাসন লোকদেখানো কাজ করছে। এ ছাড়া সরকারি কিছু পতিত জমি-জলাশয় শহরে আছে, যেগুলো মশার অভয়াশ্রম।
আমি গত বছর এবং এ বছরের শুরুতে বলেছিলাম, বরগুনাতে এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধি পাবে।অধ্যাপক কবিরুল বাশার, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
গত পরশু বরগুনা শহরের বেশ কয়েকটি স্থানে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের কাজ করতে দেখা যায়। বেলা ১১টার দিকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে মশকনিধনকর্মীদের ফগার মেশিন নিয়ে কাজে নামার প্রস্তুতি চোখে পড়ে।
বরগুনা জেলা পরিষদের প্রশাসক অনিমেষ বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, ডেঙ্গুর বিষয়টিকে প্রশাসন যথাযথ গুরুত্ব দিয়েছে। নিয়মিত ওষুধ ছিটানো হয় এবং হচ্ছে।
তবে শহরের অন্তত দুটি এলাকার মানুষ বলেছেন, মশার ওষুধ কালেভদ্রে ছিটানো হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা বলেছেন, মাস দেড়েক হলো প্রশাসন বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়েছে। একজন এনজিও কর্মকর্তা বলেন, বছরের শুরুতে জেলা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সভায় ডেঙ্গুর ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছিল। প্রশাসন ব্যবস্থা নেয়নি।
বরগুনার কোনো বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে ডেঙ্গু চিকিৎসা হয় না। তবে ডেঙ্গু শনাক্তের পরীক্ষা হয়। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ছেলেকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর এক দিন পর শহরের ফুলঝুরি বাজারের আলী হোসেন জ্বর জ্বর বোধ করতে থাকেন। নিজ উদ্যোগে একটি বেসরকারি রোগনির্ণয় কেন্দ্রে পরীক্ষা করালে তাঁর ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। এখন তিনি হাসপাতালে।
থানাপাড়ার হৃদয় চন্দ্র দাসের দাদা গোসাই দাস ডেঙ্গুতে মারা যান ১১ জুন। তিন দিন পর হৃদয় চন্দ্র দাসের জ্বর ও কাশি দেখা দেয়। তিনি অন্য একটি বেসরকারি কেন্দ্রে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান। তাঁর ডেঙ্গু শনাক্ত হয়।
এ রকম ছয়জন জানিয়েছেন, তাঁরা নিজ উদ্যোগে বেসরকারি ক্লিনিকে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে একজন বলেছেন, রক্তের অণুচক্রিকা কমে যাওয়ার পরিমাণ দুই ক্লিনিক থেকে দুই রকম পেয়েছেন।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুয়ায়ী, এই ছোট শহরে বেসরকারি ক্লিনিক আছে ৪১টি। এর মধ্যে ১৪টি নিবন্ধন নবায়ন করা হয়নি বা নিবন্ধন স্থগিত আছে। ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব ক্লিনিকে চিকিৎসা ও পরীক্ষার জন্য ভিড় বাড়ছে। এদের কেউ কেউ সদর হাসপাতালে লোক পাঠিয়ে রোগীর নমুনা সংগ্রহ করে আনে।
জেলার সিভিল সার্জন মোহাম্মদ আবুল ফাত্তাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাইরে অনেক পরীক্ষা হচ্ছে। কিন্তু কেউ যেন অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা না করে, পরীক্ষা না করেই রিপোর্ট যেন না দেয়, সে ব্যাপারে আমরা সতর্ক আছি। গত সপ্তাহে আমরা ক্লিনিকমালিকদের সঙ্গে মিটিং করে বলেছি, কেউ যেন পরিস্থিতির সুযোগ না নেন।’
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ প্রাইভেট হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের বরগুনা শাখার সাধারণ সম্পাদক মাওলানা মুহাম্মদ আবু হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিছু অভিযোগ আমাদেরও নজরে এসেছে। আমরা ছোট একটি কমিটি করেছি। এই কমিটি প্রতিদিন কয়েকটি করে ক্লিনিক পরিদর্শনে যাবে। অনিয়ম যেন না হয়, সে ব্যাপারে কথা বলবে, নির্দেশনা দেবে। আমরা সিভিল সার্জন সাহেবকে বলেছি, সরকারি হাসপাতাল যেন দালালমুক্ত হয়। সরকারি হাসপাতাল দালালমুক্ত হলে বাইরে দুর্নীতি হবে না।’