বনভূমি
বনভূমি

বনের জমি আর ইজারা দিতে পারবেন না ডিসিরা, গাছ কাটতেও লাগবে অনুমতি

বনের জমি জেলা প্রশাসকের নামে রেকর্ড থাকলেও তা আর ইজারা দিতে পারবেন না তাঁরা। এসব জমির ব্যবস্থাপনায় থাকবে বন বিভাগ। গাছ কাটার ক্ষেত্রেও অনুমোদন লাগবে বন বিভাগের।

বৃক্ষ ও বন সংরক্ষণে অধ্যাদেশ–২০২৫ এ এমন বিধান রাখা হয়েছে। ডিসেম্বরের শুরুতে উপদেষ্টা পরিষদ অধ্যাদেশটি অনুমোদন দেয়। আইন মন্ত্রণালয়ে যাচাই–বাছাইয়ের পর তা জারি হবে।

উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদনের পর এই অধ্যাদেশকে যুগান্তকারী অভিহিত করেছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, জেলা প্রশাসকেরা বন বিভাগকে না জানিয়েই বনের জমি ইজারা দিত। নতুন অধ্যাদেশ জারির পর তা বন্ধ হবে।

বাংলাদেশে মোট বনভূমির পরিমাণ ৬৩ লাখ ৬৩ হাজার একর। তার মধ্যে রক্ষিত বনভূমির পরিমাণ ৯১ হাজার একর, অর্জিত বনভূমি ২৮ হাজার একর। এই দুই শ্রেণির জমি জেলা প্রশাসকের নামে রেকর্ড করা হয়।

অধ্যাদেশের তৃতীয় অধ্যায়ের ৬ ধারার উপধারা-২ এ বলা হয়েছে, রক্ষিত বন ও অর্জিত বন জেলা প্রশাসকের নামে রেকর্ডভুক্ত হবে। তবে এসব বনের ব্যবস্থাপনায় থাকবে বন বিভাগ। এসব বনভূমি ইজারা দেওয়া যাবে না। গাছ থাকুক বা না থাকুক, এসব জায়গা চিহ্নিত হবে বনভূমি হিসেবে।

বাংলাদেশে মোট বনভূমির পরিমাণ ৬৩ লাখ ৬৩ হাজার একর। তার মধ্যে রক্ষিত বনভূমির পরিমাণ ৯১ হাজার একর, অর্জিত বনভূমি ২৮ হাজার একর। এই দুই শ্রেণির জমি জেলা প্রশাসকের নামে রেকর্ড করা হয়। এগুলো সরকারি ১ নম্বর খতিয়ানে অন্তর্ভুক্ত থাকে, যেটি মূলত খাসজমির খতিয়ান হিসেবে পরিচিত।

বাংলাদেশের জরিপ বিধিমালায় খতিয়ানে এসব জমি বন্দোবস্তযোগ্য নয় উল্লেখ করার কথা থাকলেও খতিয়ানে এটা যুক্ত করা হয়নি। ফলে, জেলা প্রশাসকেরা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে এসব বনভূমি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে ইজারা দিয়ে থাকেন। বন বিভাগ দুই দশক ধরে খতিয়ান সংশোধনের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়য়ে তদবির চালিয়ে আসছিল।

২০০৫ সালের দিকে কক্সবাজারে ৫১ একর রক্ষিত বনভূমি জেলা প্রশাসন থেকে ইজারা দিয়ে দেওয়া হয়। এ রকম অনেক প্রজ্ঞাপনভুক্ত বনভূমি জেলা প্রশাসকেরা ইজারা দিয়ে দিয়েছেন। এই অধ্যাদেশের ফলে সে চর্চা বন্ধ হবে।
ইশতিয়াক আহমদ, সাবেক কান্ট্রি ডিরেক্টর, আইইউসিএন

জানতে চাইলে বন অধিদপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী প্রথম আলো বলেন, ‘বনভূমি রেকর্ডের ক্ষেত্রে আমরা একটা চ্যালেঞ্জ ফেস করতাম। এ অধ্যাদেশে বন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে একটা সুরক্ষা হিসেবে কাজ করবে।’

ব্রিটিশ আমলে প্রণীত বন আইন-১৯২৭ এর ২৯ ধারা অনুযায়ী বন, বন্য প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে সরকার প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে যেসব বনভূমিকে রক্ষিত ঘোষণা করেছে, সেসব বনভূমি রক্ষিত বনভূমি হিসেবে চিহ্নিত হবে। এসব বনে স্থানীয় বননির্ভর জনগোষ্ঠী চলাচল, চারণভূমি হিসেবে ব্যবহার ও জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করতে পারবে। তবে সরকার যদি কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তাহলে চলাচল, চারণভূমি ও জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করা যাবে না।

অন্যদিকে অর্জিত বনভূমি হচ্ছে সরকার কর্তৃক অধিগ্রহণ করা জমি, যা বনায়নের জন্য বন বিভাগকে হস্তান্তর করা হয়েছে।

বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, জেলা প্রশাসকেরা বনের জমি ইজারা দিলেও সেটি বন বিভাগকে জানানো হয় না। ইজারাপ্রাপ্ত ব্যক্তি যখন জায়গা বুঝে নিতে যান, তখন এটি বন বিভাগের নজরে আসে। সঙ্গে সঙ্গে বন বিভাগ এ–সংক্রান্ত তথ্য চাইলেও বন বিভাগকে কোনো তথ্য দেওয়া হয় না। ফলে এ রকম কত জমি ইজারা দেওয়া হয়েছে, সেটার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য বন বিভাগের কাছে থাকে না।

জাতীয় অপরিহার্য স্বার্থে কোন বিকল্প না থাকলে মন্ত্রিসভার অনুমোদন সাপেক্ষে বনভূমি ব্যবহার করা যাবে। তবে সে ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাব নিরূপণ, ক্ষতিপূরণমূলক বনায়ন, বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি ও বিপদাপন্ন উদ্ভিদ ও বন্য প্রাণীর ঝুঁকি বিবেচনা করতে হবে।

অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, এটি (অধ্যাদেশ) কার্যকর হওয়ার পর দ্রুততার সঙ্গে বন অধিদপ্তর ও ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর বনের সীমানা চিহ্নিত করার কাজ শুরু করবে। একই সঙ্গে এসব জমির খতিয়ান হালনাগাদ করার ব্যবস্থা নিতে হবে।

অধ্যাদেশের তৃতীয় অধ্যায়ের ৬ ধারায় বলা হয়েছে, বনভূমিসংলগ্ন কোথাও খাসজমি থাকলে সে খাসজমি ইজারা দেওয়ার আগে বন বিভাগকে জানিয়ে বন বিভাগ ও জেলা প্রশাসন যৌথ জরিপের মাধ্যমে খাসজমি ও বনভূমির সীমানা চিহ্নিত করবে।

বনভূমি বনায়ন ছাড়া অন্য কোনো কাজে ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে অধ্যাদেশে। তবে, জাতীয় অপরিহার্য স্বার্থে কোনো বিকল্প না থাকলে মন্ত্রিসভার অনুমোদন সাপেক্ষে বনভূমি ব্যবহার করা যাবে। তবে সে ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাব নিরূপণ, ক্ষতিপূরণমূলক বনায়ন, বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি ও বিপদাপন্ন উদ্ভিদ ও বন্য প্রাণীর ঝুঁকি বিবেচনা করতে হবে।

নতুন আইনকে বন সংরক্ষণে এটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন সাবেক প্রধান বন সংরক্ষক এবং প্রকৃতি সংরক্ষণের আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএন এর সাবেক কান্ট্রি ডিরেক্টর ইশতিয়াক আহমদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ২০১১ সালে এ আইনের প্রথম খসড়া করা হয়েছিল। প্রায় ১৪ বছর পর এটি অধ্যাদেশ হিসেবে জারি করতে যাচ্ছে সরকার।

এই অধ্যাদেশের ফলে বনভূমি ইজারা দেওয়ার প্রবণতা বন্ধ হয়ে যাবে বলে মনে করেন ইশতিয়াক আহমদ। তিনি বলেন, ২০০৫ সালের দিকে কক্সবাজারে ৫১ একর রক্ষিত বনভূমি জেলা প্রশাসন থেকে ইজারা দিয়ে দেওয়া হয়। এ রকম অনেক প্রজ্ঞাপনভুক্ত বনভূমি জেলা প্রশাসকেরা ইজারা দিয়ে দিয়েছেন। এই অধ্যাদেশের ফলে সে চর্চা বন্ধ হবে।

গাছ কাটতে লাগবে অনুমতি

এ অধ্যাদেশ জারির তিন মাসের মধ্যে কোন প্রজাতির বৃক্ষ কাটা যাবে না, আর কোন প্রজাতির বৃক্ষ কাটা যাবে, তার একটা তালিকা প্রকাশ করবে সরকার। অশ্রেণিভুক্ত বনাঞ্চল, সামাজিক বন, সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গণপরিসরের গাছ কাটার ক্ষেত্রে অনুমোদন লাগবে বন বিভাগের।

আগে গণপরিসর, যেমন ধানমন্ডি লেক থেকে কেউ কোন গাছ কাটলে বা গ্রামের কোনো ঐতিহ্যবাহী বটগাছ কাটলে আমাদের কিছু করার ছিল না। এ অধ্যাদেশের ফলে এখন থেকে গণপরিসর ও এতিহ্যবাহী প্রাচীন গাছ রক্ষায় বন বিভাগ পদক্ষেপ নিতে পারবে।
মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী, প্রধান বন সংরক্ষক

যে প্রজাতির গাছ কাটা যাবে, তা কাটার ক্ষেত্রে নির্ধারিত ফর্মে বৃক্ষ সংরক্ষণ কর্মকর্তার কাছে আবেদন করতে হবে। এখন থেকে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বৃক্ষ সংরক্ষণ কর্মকর্তা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করবেন। বৃক্ষ সংরক্ষণ কর্মকর্তা যাচাই–বাছাই শেষে ৩০ দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত দেবেন। যে পরিমাণ গাছ কাটা হবে, তার বিপরীতে একই পরিমাণ গাছ রোপণের শর্তটি বৃক্ষ সংরক্ষণ কর্মকর্তাকে নিশ্চিত করতে হবে।

তবে রোগাক্রান্ত গাছ, ঝড়ে পড়া গাছ, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত গাছ, সড়কে চলাচলে বাধা তৈরি করছে এমন গাছ, জননিরাপত্তা ও জীবনের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করে এমন গাছ কাটার ক্ষেত্রে কোনো অনুমতির প্রয়োজন হবে না।

প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন, ‘আগে গণপরিসর, যেমন ধানমন্ডি লেক থেকে কেউ কোন গাছ কাটলে বা গ্রামের কোনো ঐতিহ্যবাহী বটগাছ কাটলে আমাদের কিছু করার ছিল না। এ অধ্যাদেশের ফলে এখন থেকে গণপরিসর ও এতিহ্যবাহী প্রাচীন গাছ রক্ষায় বন বিভাগ পদক্ষেপ নিতে পারবে।’