ঢাকায় পুলিশের লাঠিপেটা, টিয়ার গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপে বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী আহত। বিআরটিসির বাসে আগুন।

খুলনা, পটুয়াখালী ও নেত্রকোনার পর এবার ঢাকায় বিএনপির ‘পদযাত্রা’ কর্মসূচিতে সংঘর্ষ হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায় শংকর থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরত্ব পেরিয়ে পদযাত্রাটি যখন গন্তব্যের কাছাকাছি সিটি কলেজ এলাকায় পৌঁছায়, তখন পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ বাধে। এ সময় পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়া হয়। পুলিশ টিয়ার গ্যাসের শেল ছুড়ে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। বিআরটিসির একটি বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে।
বিএনপি অভিযোগ করেছে, পুলিশের লাঠিপেটা, টিয়ার গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপে দলের বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন। সেখান থেকে পুলিশ অন্তত ২৫ জনকে আটক করেছে। পুলিশ বলেছে, মিছিল থেকে পুলিশের ওপর হামলা করা হয়। এরপর পুলিশ ব্যবস্থা নিয়েছে।
এদিকে ঢাকার বাইরে পুলিশের বাধার কারণে রাজশাহী জেলা ও মহানগর বিএনপির পদযাত্রা হতে পারেনি। গতকাল সকাল থেকেই পুলিশ পদযাত্রার স্থানটি অবরুদ্ধ করে রাখে। এরপর নেতা-কর্মীরা দলীয় কার্যালয়ে জড়ো হতে পারেন, তাই দলটির জেলা ও মহানগর কার্যালয়েও তালা দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঘিরে রাখে। কুমিল্লা ও ময়মনসিংহেও পুলিশ বিএনপির পদযাত্রায় বাধা দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে ঢাকায় ধানমন্ডির কর্মসূচিতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটলেও গাবতলী এলাকায় পদযাত্রা শান্তিপূর্ণ হয়েছে।
সরকারের পদত্যাগসহ ১০ দফা দাবিতে গতকাল ঢাকার উত্তর, দক্ষিণসহ ১২টি মহানগরে পদযাত্রার কর্মসূচি ছিল। ঢাকায় একটি ধানমন্ডিতে, অন্যটি ছিল গাবতলী এলাকায়। ধানমন্ডির শংকর এলাকায় বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সড়কে সমাবেশ শেষে বেলা তিনটায় পদযাত্রা শুরু হয়। সেটি জিগাতলা, সিটি কলেজ হয়ে ল্যাবএইড হাসপাতাল পর্যন্ত গিয়ে শেষ হওয়ার কথা ছিল।
প্রত্যক্ষদর্শী একজন জানান, পৌনে চারটার দিকে পদযাত্রা সিটি কলেজ এলাকায় পৌঁছালে পুলিশ থামানোর চেষ্টা করলে সংঘর্ষ বাধে। পুলিশ লাঠিপেটা করলে পাল্টা ইটপাটকেল ছোড়েন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। একপর্যায়ে পুলিশ তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। এ সময় পদযাত্রায় অংশ নেওয়া বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা ছিলেন না।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ঘটনার আগে থেকেই মিরপুর রোডের সায়েন্স ল্যাব এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। সংঘর্ষের একপর্যায়ে বিআরটিসির একটি দোতলা বাস এলে সেটির কাচ ভাঙচুর এবং ওই বাসের দুটি সিটে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটে। পুলিশ ও উপস্থিত লোকজন আগুন নেভাতে সক্ষম হন।
সরকারি পরিবহন সংস্থা বিআরটিসি গত রাতে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলেছে, বিএনপির মিছিল থেকে সংস্থাটির দুটি বাসের কাচ ভাঙচুর করা হয় এবং আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় দুটি বাসে। এতে ওই বাসের দুটি আসন পুড়ে যায়।
তবে বাস ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনার সঙ্গে বিএনপির কেউ জড়িত নন বলে দলটির নেতারা বলেছেন।
ধানমন্ডির পদযাত্রা-পূর্ব সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আবদুস সালাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজের সামনে সমাবেশ শুরুর আগেই পুলিশ ধানমন্ডি থানা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাহাদাৎ হোসেন সৈকতসহ দুজন নেতাকে ধরে নিয়ে যায়। তবু আমরা সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করে শান্তিপূর্ণভাবে পদযাত্রা করি। কী কারণে পুলিশ টিয়ার গ্যাসের শেল মারল, গুলি করল, বুঝলাম না।’
অবশ্য পুলিশের নিউমার্কেট অঞ্চলের সহকারী কমিশনার শরীফ মোহাম্মদ ফারুকুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘হঠাৎ করে মিছিল থেকে পুলিশের ওপর হামলা করা হয়। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপসহ যা যা করার, আমরা সেটা করেছি।’
প্রত্যক্ষদর্শী একজন জানিয়েছেন, পুলিশের সঙ্গে বিএনপির সংঘর্ষের ঘটনার পর বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে সায়েন্স ল্যাব মোড় থেকে ঢাকা কলেজ অভিমুখী সড়কে লাঠিসোঁটা নিয়ে একদল তরুণ মিছিল করেন। তাঁদের কারও কারও মাথায় হেলমেট ছিল। এ সময় সেখানে পুলিশ সদস্যদের উপস্থিতি দেখা গেছে।
পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, পদযাত্রার শেষের অংশ থেকে কয়েকজন পুলিশের ওপর ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন, ব্যানারের লাঠি দিয়ে পুলিশকে মারধর শুরু করেন। পুলিশও পাল্টা জবাব দেওয়ার চেষ্টা চালায়। তাঁরা বিআরটিসির একটি বাসে আগুন দেওয়ার চেষ্টা করেন। ঘটনাস্থল থেকে ১০–১৫ জনকে আটক করা হয়েছে।
ধানমন্ডির পদযাত্রার আগে এক সংক্ষিপ্ত সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। তিনি বলেন, তাঁরা এখনো সরকার পতনের আন্দোলন শুরু করেননি। আওয়ামী লীগ যদি দাবি মেনে পদত্যাগ করে, তাহলে সরকার পতনের আন্দোলন করতে হবে না; কিন্তু আওয়ামী লীগ তা করবে না। তাই অচিরেই তাঁরা সরকার পতনের আন্দোলনের ঘোষণা দেবেন।
গতকাল বেলা ১১টায় রাজশাহীর ভুবনমোহন পার্ক থেকে পদযাত্রা শুরু হয়ে সোনাদীঘির মোড়, সাহেববাজার হয়ে রেলগেটে গিয়ে শেষ করার ঘোষণা ছিল। কিন্তু এর আগেই পুলিশ পদযাত্রার রুট নগরের স্বচ্ছ টাওয়ারের মোড় থেকে সোনাদীঘির মোড় পর্যন্ত এলাকায় রিকশা চলাচল বন্ধ করে দেয়। এরপর রাজশাহী জেলা ও মহানগর বিএনপির কার্যালয়ের দরজায় দুটি তালা মেরে ঘিরে রাখে পুলিশ। তখন ওই কার্যালয়ের পিয়ন কেবল দাস ছাড়া সেখানে কেউ ছিল না। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বেলা ১১টার দিকে পুলিশ কার্যালয়ের ফটকে তালা দিয়ে গেছে।
অবশ্য রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সোহরাওয়ার্দী হোসেন বলেন, বিএনপির কর্মসূচি ঘিরে নগরে যাতে কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়, সে জন্য তাঁরা একটি নিরাপত্তাবলয় তৈরি করেন, এ ছাড়া আর কিছুই নয়। বিএনপির কার্যালয়ে তাঁরা তালা দেননি, বিএনপি নিজেরাই হয়তো তালা লাগিয়েছে।
এদিকে সন্ধ্যায় নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, রাজশাহী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সাইদকে না পেয়ে তাঁর ছোট ভাই মুক্তা, জামাতা জেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক জিয়া এবং আবু সাইদের ব্যক্তিগত সহকারী জালালের স্ত্রী, শাশুড়ি ও ছোট ভাইকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
রাজশাহী বিএনপির ওই নেতা আবু সাইদ দুই দিন আগে এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সেই অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
রাজশাহীতে বিভিন্ন জায়গা থেকে বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মীকে আটকের অভিযোগ করেছে দলটি। রাজশাহী মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক নজরুল ইসলাম, মহানগর যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক শরিফুল ইসলাম, স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য রাজন আলী, ২৮ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের শুক্কুর আলীসহ ৩০ জন নেতা-কর্মীকে পুলিশ আটক করেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সদস্য নুরুউদ্দিন আবিরকে পিটিয়ে গুরুতর জখম করার ঘটনা ঘটেছে। নুরুউদ্দিন এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এই ঘটনায় ছাত্রদল অভিযোগ করেছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। ছাত্রলীগ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
কুমিল্লার পদযাত্রায়ও বাধা দেওয়ার অভিযোগ করেন মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক উত্বাতুল বারী। বিকেল সোয়া পাঁচটায় নগরের কান্দিরপাড় ভিক্টোরিয়া কলেজ সড়কে দলীয় কার্যালয় থেকে পদযাত্রা শুরুর পর কান্দিরপাড় লিবার্টি মোড়ে যাওয়ামাত্র পুলিশ বাধা দেয়। নগরের ২৭টি ওয়ার্ড থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে নেতা-কর্মীরা জড়ো হয়েছিলেন। পরে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করে কর্মসূচি শেষ করা হয়।
এ বিষয়ে কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি আহমেদ সঞ্জু মোর্শেদ প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির নেতারাই পদযাত্রা থামিয়ে দিয়েছেন। পুলিশ কোনো বাধা দেয়নি।
ময়মনসিংহেও বিএনপির পদযাত্রা পুলিশের বাধার মুখে পড়ে। পদযাত্রাটি টাউন হল থেকে নগরের স্টেশন রোড পর্যন্ত যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিদ্যাময়ী স্কুলের সামনে গেলে পুলিশ বাধা দেয়। এরপর ভিন্ন পথে আমলাপাড়া সড়ক দিয়ে হরিকিশোর রায় সড়কে বিএনপির দলীয় কার্যালয়ে গিয়ে পদযাত্রা শেষ হয়।
পদযাত্রা শুরুর আগে টাউন হল চত্বরে সমাবেশ হয়। সেখানে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ বলেন, সরকার গায়ের জোরে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়। এ জন্য তারা নানা ধরনের ষড়যন্ত্র করছে।
গত রাতে এক বিবৃতিতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঢাকার ধানমন্ডিতে পুলিশ বিএনপির নেতা-কর্মীদের ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেন। এ ছাড়া তিনি অভিযোগ করেন, গতকাল ঢাকার বাইরে খুলনা, পটুয়াখালী, নেত্রকোনা, ফেনীসহ বিভিন্ন জেলায় বিএনপির কর্মসূচিতে হামলা চালানো হয়েছে। এসব ঘটনার নিন্দা জানিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, কর্তৃত্ববাদী সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও দলীয় সন্ত্রাসীদের দিয়ে এ ধরনের হামলা চালাচ্ছে।