
আগুনে নেভাতে গিয়ে ২৫ আনসার সদস্যসহ আহত ৩৫।
আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছে সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনীসহ বিভিন্ন সংস্থা।
ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন।
রাত ৯টার পর উড়োজাহাজ ওঠানামা শুরু।
৬ ঘণ্টায় ২৩টি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট অন্য বিমানবন্দরে অবতরণ করে।
ভোগান্তিতে পড়েন শত শত যাত্রী।
ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ কমপ্লেক্স ভবনে গতকাল শনিবার বেলা আড়াইটার দিকে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ১৩টি ফায়ার স্টেশনের ৩৭টি ইউনিটের প্রায় সাড়ে ছয় ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। আগুনে নেভাতে গিয়ে আনসার বাহিনীর ২৫ সদস্যসহ মোট ৩৫ জন আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর বিমানবন্দরে সব ধরনের উড়োজাহাজ ওঠানামা বন্ধ হয়ে যায়। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর রাত ৯টার দিকে বিমানবন্দর চালু হয়। রাত ৯টা ৬ মিনিটে ফ্লাই দুবাই এয়ারলাইনসের একটি উড়োজাহাজ শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণ করে।
শাহজালাল বিমানবন্দরের পোস্ট অফিস ও হ্যাঙ্গারের মাঝামাঝি স্থানে কার্গো ভিলেজ। আগুন লেগেছে বিমানবন্দরের ৮ নম্বর গেটের পাশে কার্গো কমপ্লেক্স ভবনে। এই গেটকে হ্যাঙ্গার গেট বলা হয়। কার্গো ভিলেজের (পণ্য রাখার স্থান) যে অংশে আগুন লেগেছে, সেখানে আমদানি করা পণ্য রাখা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বেলা আড়াইটার দিকে হঠাৎ বিমানবন্দরের ফায়ার অ্যালার্ম বেজে ওঠে। সবাই তখন নিচে নেমে আসেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে প্রচুর ধোঁয়া বের হতে থাকে।
আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনীর দুটি ফায়ার ইউনিটও কাজ করেছে বলে জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর। যোগ দিয়েছে নৌবাহিনীও। দুই প্লাটুন বিজিবিও সেখানে কাজ করেছে। উৎসুক জনতার ভিড় ঠেকাতে বিমানবাহিনীর পক্ষ থেকে মাইকে ঘোষণা দিয়ে সবাইকে সরে যেতে বলা হয়।
বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় এক হাজার আনসার সদস্য ঘটনাস্থলে উদ্ধার ও আগুন নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেন। এ সময় ২৫ জন সদস্য আহত হলে তাঁদের দ্রুত সিএমএইচ ও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়।
বিমানবন্দরের একটি সূত্র বলছে, তৈরি পোশাক কারখানার জন্য আমদানি করা বিপুল পরিমাণ কাপড় ও বিভিন্ন ধরনের দাহ্য পদার্থ ছিল কার্গো কমপ্লেক্স ভবনে। যে কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বেশি সময় লেগেছে। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর বোঝা যাবে, ক্ষয়ক্ষতি কত হয়েছে কিংবা কবে নাগাদ আবার কার্গো ভিলেজ চালু করা যাবে।
শাহজালাল বিমানবন্দর দিয়ে সাধারণত তুলনামূলকভাবে কম ওজনের যন্ত্রপাতি, পচনশীল পণ্য, ইলেকট্রনিক পণ্য আমদানি হয়ে থাকে। আকাশপথে পণ্য পরিবহনকারী আরএমকে গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামরুজ্জামান ইবনে আমিন সোহাইল প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় আমদানিকারকদের বড় ক্ষতি হয়ে গেল।
আগুনের ঘটনার পরপরই বাংলাদেশ বিমানের কুয়েতগামী একটি ফ্লাইট বাতিল করা হয়। বিকেল পর্যন্ত ৯টি ফ্লাইট ঢাকার পরিবর্তে চট্টগ্রাম শাহ আমানত ও সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এ ছাড়া একাধিক ফ্লাইট আকাশ থেকেই দেশ-বিদেশের অন্য বিমানবন্দরে অবতরণের জন্য পাঠানো হয়। প্রায় ছয় ঘণ্টায় মোট ২৩টি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এর ফলে ভোগান্তিতে পড়েন শত শত যাত্রী।
বিমানবন্দর সূত্র বলছে, বিকেল পৌনে চারটার দিকে ২৬৭ জন যাত্রী নিয়ে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইট কুয়েতের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। যাত্রী, কেবিন ক্রু ও পাইলটরাও বিমানে উঠে বসে ছিলেন। আগুনের কারণে ফ্লাইট ছাড়ার আগমুহূর্তে যাত্রীসহ সবাইকে নামিয়ে আনা হয়। এ ছাড়া হিমালয় এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট ১৮০ জন যাত্রীসহ বিকেল সাড়ে চারটার দিকে ঢাকার বিমানবন্দরে অবতরণের কথা ছিল। পরে এটিকে নেপালে ফেরত পাঠানো হয়। দুবাই থেকে আসা এমিরেটস এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট করাচি বিমানবন্দরে পাঠানো হয়। চেন্নাই থেকে ছেড়ে আসা ইনডিগোর একটি ফ্লাইট কলকাতা বিমানবন্দরে অবতরণের জন্য পাঠানো হয়।
ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান অন্তর্বর্তী সরকারের বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন এবং বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। তিনি সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে সাংবাদিকদের বলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণের পর দ্রুত বিমান চলাচল শুরু করার চেষ্টা করবে। এরপর ক্ষয়ক্ষতি ও আগুনের কারণ জানতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে।
পরে রাতে ঘটনার কারণ অনুসন্ধান ও দায়দায়িত্ব নির্ধারণে তদন্ত কমিটি গঠন করে বাংলাদেশ বিমান। কমিটিকে পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। গতকাল রাতে বিমানের অফিস আদেশে জানানো হয়, ছয় সদস্যের কমিটির সভাপতি করা হয়েছে বিমানের ফ্লাইট সেফটি শাখার প্রধানকে। কমিটিতে রয়েছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, মহাব্যবস্থাপক (করপোরেট সেফটি অ্যান্ড কোয়ালিটি), চিফ ইঞ্জিনিয়ার (কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স), উপমহাব্যবস্থাপক (সিকিউরিটি ও কার্গো-রপ্তানি) এবং উপব্যবস্থাপক (ইনস্যুরেন্স)। তদন্ত কমিটির কাজ হবে অগ্নিকাণ্ডের কারণ, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এবং এর পেছনে কারও গাফিলতি ছিল কি না, তা চিহ্নিত করা। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে করণীয়ও সুপারিশ করবে কমিটি।
এদিকে বাংলাদেশ নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম এক বিবৃতিতে বলেন, এটি কেবল দুর্ঘটনা, নাকি এর পেছনে কোনো ষড়যন্ত্র রয়েছে, তা খতিয়ে দেখতে সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত তদন্ত শুরু করা উচিত। কারণ, গত কয়েক দিনে স্থানীয় ও রপ্তানিমুখী একাধিক পোশাক কারখানায় আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওয়ান টাইম কার্গোর বাংলাদেশি এজেন্ট বলে পরিচয় দেওয়া এস এম শিহাব উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, বিমানবন্দরের মতো একটি নিরাপদ জায়গায় এমন ঘটনা ঘটবে, তা তিনি ভাবতেই পারছেন না। তাঁদের পাঁচ-ছয় কোটি টাকার মালামাল নষ্ট হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল গতকাল রাত সোয়া ১০টার দিকে কার্গো কমপ্লেক্সের সামনে সাংবাদিকদের বলেন, আগুন নেভাতে এসে সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল বাতাস। এখানে খোলা জায়গায় প্রচুর বাতাস ছিল। ফলে অক্সিজেনের একটা প্রাপ্তি সব সময় ছিল, যেটা আগুনকে জ্বালাতে সহায়তা করেছে। যে কারণে অনেক ওপরে পর্যন্ত ধোঁয়া দেখা গেছে। নিচে হয়তো আগুন অল্প ছিল। কিন্তু বাতাসের কারণে মনে হয়েছে অনেক বড় আগুন।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক বলেন, ‘কার্গো কমপ্লেক্সের ভেতরের জায়গাগুলো খোপ খোপ করা। এই খোপের মধ্যে আবার দেয়াল দেওয়া। ফলে প্রতিটি খোপ পরিষ্কার করে করে আমাদের আগুন নেভাতে হয়েছে। খোলা জায়গায় কিছু কার্গো থাকে। সেগুলোতে খুব সহজেই আগুন ধরে গেছে। যেহেতু বাতাস ছিল, বাতাসের ফ্লোতে দ্রুত আগুনটা ছড়ায়।’
কার্গো কমপ্লেক্সে কোনো রাসায়নিক ছিল কি না, জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক বলেন, এটা আগুন নির্বাপণ হলে বলা সম্ভব হবে। এখনই এটা বলা যাবে না।
গতকাল রাত ১০টার দিকে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন বিমানবন্দরের এভিয়েশন সিকিউরিটি বিভাগের কর্মকর্তা ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আবু বকর হৃদয়। তিনি বলেন, নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় এনে ফ্লাইট চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছিল। তিনি বলেন, কার্গো কমপ্লেক্স সাধারণত এয়ারক্রাফট পরিচালনার জায়গা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তারপরও নিরাপত্তার দিকটি চিন্তা করে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
গত মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মিরপুরের শিয়ালবাড়িতে রাসায়নিক গুদামে আগুন লাগে। গুদামে আগুন ধরে বিস্ফোরিত হয়ে পাশের চারতলা ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। পরে চারতলা ভবনের দোতলা ও তিনতলার বিভিন্ন স্থান থেকে ১৬টি লাশ উদ্ধার করা হয়। এরপর বৃহস্পতিবার বেলা দুইটার দিকে চট্টগ্রামের ইপিজেড এলাকার অ্যাডামস ক্যাপস অ্যান্ড টেক্সটাইল লিমিটেড ও জিহং মেডিকেল কোম্পানির গুদামে আগুন লাগে। এর দুই দিন পর ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ কমপ্লেক্স ভবনে আগুনের ঘটনা ঘটল।
এসব ঘটনায় জনমনে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সরকার এক বিবৃতিতে বলেছে, নিরাপত্তা সংস্থাগুলো প্রতিটি ঘটনা গভীরভাবে তদন্ত করছে এবং মানুষের জীবন ও সম্পদ সুরক্ষায় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করছে। নাশকতা বা অগ্নিসংযোগের কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া গেলে সরকার তাৎক্ষণিক ও দৃঢ় পদক্ষেপ নেবে। কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বা উসকানির মাধ্যমে জনজীবন ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করার সুযোগ দেওয়া হবে না।