
দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯৭৫ সাল হচ্ছে সবচেয়ে ঝঞ্ঝাপূর্ণ বছরের একটি। এর মধ্যে বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম বাঁকবদলের মাস ছিল পঁচাত্তরের নভেম্বর। এই অস্থির সময়, বিশেষ করে ৩ থেকে ৭ নভেম্বরের ঘটনাবলি নিয়ে যত লেখালেখি হয়েছে, অন্য কোনো সময় নিয়ে তত হয়নি। ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের বিপরীতে ৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয়েছিল পাল্টা আরেকটি অভ্যুত্থান। এ সময়ের নানা স্মৃতি, দলিল ও মতামত নিয়ে থাকছে প্রথম আলোর এই বিশেষ আয়োজন।
অন্তর্বর্তী সরকারের বর্তমান উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন সেনাবাহিনীতে কর্মরত থাকার সময় সংগঠিত অভ্যুত্থান ও পাল্টা-অভ্যুত্থানের অনেক ঘটনার সাক্ষী ও প্রত্যক্ষদর্শী। আজ ৭ নভেম্বর। ৫০ বছর আগের সেই দিনটির বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে তাঁর লেখায়। আজ প্রকাশিত হলো তাঁর বই থেকে নেওয়া সেই অংশটুকু।
৭ নভেম্বর ১৯৭৫। সময় তখন প্রায় মধ্য রাত। চারদিকে গোলাগুলির আওয়াজ আর 'জিন্দাবাদ' ধ্বনির মধ্যে ঘুম ভেঙে গেল। হকচকিয়ে বিছানা থেকে উঠে পড়লাম। বাসার সবাই আতঙ্কিত। আমি পেছনের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। সেখান থেকে সেনানিবাসের প্রধান সড়ক দেখা যায়। সৈনিক ভর্তি অনেক গাড়ি। তারাই এই আওয়াজ করছে। করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে। কয়েকটি ট্যাংককে টপ স্পিডে দক্ষিণ দিকে যেতে দেখলাম। তেজগাঁও বিমানবন্দরের দিক থেকে বিমানবিধ্বংসী কামানের ছোড়া ট্রেসার রাউন্ড তখন দক্ষিণমুখী আকাশকে রক্তিম করে তুলছিল। বুঝতে পারছিলাম না হঠাৎ করে এমন কী হলো! সন্ধ্যায় বিতরণ করা লিফলেট আর শোনা গুজবের কথা মনে পড়ল। একবার মনে করলাম, হয়তো ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানে জড়িত ইউনিট আর খালেদ মোশাররফের সমর্থক ইউনিটের মধ্যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়েছে।
আমার নিচের তলাতেই থাকতেন অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট (বিমানবিধ্বংসী) ইউনিটের অধিনায়ক লে. কর্নেল মাশাহেদ চৌধুরী, যাঁর ইউনিটের একটি ব্যাটারি তেজগাঁও বিমানবন্দরে রাখা হয়েছিল বিমানবন্দরের পথ বন্ধ করে দেওয়ার জন্য। তাঁরা আমাদের ডেকে নিচে তাঁদের বসার ঘরে নিয়ে গেলেন। তারপর তিনি আমাকে অনেক কথাই বললেন। বললেন কীভাবে তাঁর ইউনিটের একটি ব্যাটারিকে তাঁর নির্দেশ ছাড়াই বিমানবন্দরে নিয়ে গিয়ে মোতায়েন করা হয়েছে। আগের দিনের লিফলেট সম্বন্ধেও অনেক কিছু বললেন। তখনো আমরা অনুমান করতে পারিনি যে বাইরে আসলে কী ঘটে চলেছে।
তাঁর সঙ্গে কথা বলতে বলতে প্রায় সকাল হয়ে এল। সারা রাত ধরে চলল গোলাগুলির আওয়াজ। এর মধ্যেই আজানের ধ্বনি শোনা গেল। পুবের আকাশ কিছুটা পরিষ্কার হতেই তাড়াতাড়ি ইউনিফর্ম পরে আমার প্রতিবেশী মেজর হারুনের সঙ্গে (পরে কর্নেল, অবসরপ্রাপ্ত) হাঁটতে হাঁটতে ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। হারুন যেহেতু স্টেশন হেডকোয়ার্টারে স্টাফ অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন, কাজেই তিনিও আমার সঙ্গে হেঁটেই স্টেশন হেডকোয়ার্টারে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় আমরা দুজনই একসঙ্গে বের হলাম।
প্রধান সড়কে উঠতেই দুজন পরিচিত অফিসারের দেখা পেলাম। একজন মেজর মাশুক আহমেদ চৌধুরী (পরে ব্রিগেডিয়ার, বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত), অপরজন লে. কর্নেল শরিফ, যিনি সেনাসদরের অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল ব্রাঞ্চের একজন পরিচালক, ছিলেন সফিউল্লাহ এবং জিয়ার ব্যাচমেট। দুজনই একই মোটরসাইকেলে, মাশুক ইউনিফর্ম পরা হলেও লে. কর্নেল শরিফের পরনে রাতেরই পোশাক। তাঁরা আমাদের দেখে বললেন, জেনারেল জিয়াউর রহমানকে এইমাত্র বন্দী অবস্থা থেকে বের করে ২ ফিল্ড রেজিমেন্টে নিয়ে আসা হয়েছে। তাঁরা আমাদের সেখানেই চলে যেতে বললেন। জানালেন ওখানে অন্য অফিসাররাও আছেন। এর বেশি আর কিছু বলার সময় তাঁরাও পেলেন না আর আমরাও কিছু শুনতে পারছিলাম না।
পথের উল্টো দিক থেকে গুলি ছুড়তে ছুড়তে আর স্লোগান দিতে দিতে সৈনিক এবং কিছু বেসামরিক তরুণে ভর্তি একটি সামরিক ট্রাক আমাদের পাশ কাটিয়ে দ্রুতগতিতে চলে গেল। এ স্লোগান আমি প্রথম শুনলাম আর শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমার শরীরের রক্ত হিম হয়ে গেল। তারা স্লোগান দিচ্ছিল, 'সিপাহি সিপাহি ভাই ভাই/অফিসারের রক্ত চাই', 'সিপাহি বিপ্লব জিন্দাবাদ/ জেনারেল জিয়া জিন্দাবাদ'। এই স্লোগান শোনার পর আমি আর হারুন আরও একটু দ্রুতগতিতে হাঁটতে লাগলাম। পথে আরও দুটি ট্রাক দ্রুতগতিতে চলে গেল। তার ওপরে বসা সামরিক সদস্যদের সঙ্গে জনাকয় অস্ত্রধারী বেসামরিক তরুণ। পরে জানলাম এসব বেসামরিক তরুণ কর্নেল তাহেরের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গণবাহিনীর সদস্য। তখনো বুঝতে পারিনি এটা কাদের বা কোন ধরনের বিপ্লব।
দু-একজন তরুণ অফিসারকেও এসব বিপ্লবী সৈনিকের সঙ্গে দেখলাম। তাদের কাঁধে কোনো ব্যাজেজ অব র্যাঙ্ক নেই। একজনকে ডেকে জিজ্ঞেস করাতে জানাল, 'স্যার, আজ থেকে সিপাহি আর অফিসারদের মধ্যে ব্যাঙ্কের কোনো পার্থক্য থাকবে না। সশস্ত্র বাহিনীতে কোনো শ্রেণিবিন্যাস থাকবে না। এটাই এ বিপ্লবের মূল কথা।'
আমার হতবাক হওয়ার পালা, তাহলে কি কর্নেল তাহেরের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা বিপ্লব ঘটিয়েছে? আর এটাই বোধ হয় তাহেরের শ্রেণিসংগ্রামের সূত্রপাত এবং তার জন্য প্রথম ধাপে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টা! আরও কয়েকটি জিপ আমাদের পাশ দিয়ে দ্রুতগতিতে বের হয়ে গেল। এরপর কিছুই আর বোঝার বাকি থাকল না। সৈনিকদের সঙ্গে জেএসডির গণবাহিনীর সদস্যরা, যাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে শ্রেণিসংগ্রামের জন্য, তারাও এখন সেনানিবাসে। যতগুলো গাড়ি আমাদের পাশ দিয়ে চলে গেল, তার প্রতিটিতেই দেখলাম উল্লাসরত সৈনিকদের। তারা আকাশের দিকে গুলি ছুড়তে ছুড়তে আর একই ধ্বনি দিতে দিতে যাচ্ছে। দেখে মনে হলো, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবশিষ্ট কমান্ড স্ট্রাকচারটাও পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। এ এক চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা, কোনো সভ্য দেশে কখনো এমন কিছু ঘটেছে বলে মনে পড়ে না। এখানে যেন কারও কিছু বলার বা করার নেই। যতটুকু দেখলাম, আগের রাতে বিতরণ করা লিফলেট ও তার বক্তব্য এবং এ কয় দিন সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলার যে অবনতি দেখেছি, আজকের এ দৃশ্যের সামনে তা কিছুই নয়।
দ্রুত হেঁটে দ্বিতীয় ফিল্ড রেজিমেন্টের প্রধান ফটকে এসে পৌঁছালাম। সেখানে প্রথমেই দেখা হলো ইউনিটের সুবেদার মেজর আনিসের (পরে অনারারি ক্যাপ্টেন) সঙ্গে। দেখা হতেই আনিস আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, 'স্যার, আল্লাহর রহমতে আপনাকে পাওয়া গেছে। ব্রিগেডে কেউ নেই, কাউকেই পাওয়া যাচ্ছে না। জিয়া সাহেব আপনাদের খোঁজ করছেন।' সংক্ষেপে তিনি আরও জানালেন, রাত ১২টার দিকে 'সিপাহি বিপ্লব' শুরু হওয়ার পর প্রথম বেঙ্গলের গার্ডদের সরিয়ে সকালের দিকে মেজর মুহিউদ্দিন (পরে লে. কর্নেল) এবং এই রেজিমেন্টেরই অন্যান্য সিপাহি জিয়াকে তাদের ইউনিটে নিয়ে আসে। এই মুহূর্তে জিয়া অধিনায়কের অফিসে আছেন। তাঁর সঙ্গে আছেন আরও কয়েকজন অফিসার এবং ৫৫ ব্রিগেডের যশোরের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত আলীও।
দ্বিতীয় ফিল্ড রেজিমেন্ট সেদিন শুধু সামরিক বাহিনীরই নয়, বাংলাদেশের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হলো। স্মরণযোগ্য যে এই দ্বিতীয় ফিল্ড রেজিমেন্টই রশীদের নেতৃত্বে ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী দুটি ইউনিটের একটি। আমরা দ্বিতীয় ফিল্ডে যখন পৌঁছাই, তখন সেখানে মাত্র ১০ থেকে ১৫ জন অফিসারকে দেখলাম। ইউনিট কোয়ার্টার গার্ড, যেখানে সামরিক কয়েদি রাখা হয়, সেই সেলগুলোতে দেখলাম লকআপে রয়েছেন বেশ কিছু চেনাজানা অফিসার।
এঁদের মধ্যে একজন ছিলেন লে. কর্নেল বাহার। এমন একজন জ্যেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে এ রকমভাবে কোয়ার্টার গার্ড সেলে রাখার দৃশ্য দেখব বলে ভাবতেই পারিনি। সুবেদার মেজর আনিসকে এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিত জিজ্ঞেস করাতে তিনি যে তথ্য দিলেন, তার সারমর্ম হলো, বিপ্লবী সৈনিকেরা কিছু অফিসারের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে তাদের লিস্ট তৈরি করে। তারপর তাঁদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে হামলা চালায়। এ খবর পেয়ে এসব আতঙ্কগ্রস্ত অফিসার পরিবার-পরিজন ছেড়ে পালাতে থাকেন। এঁদের মধ্যে যাঁদের পাওয়া গেছে, উন্মত্ত সৈনিকদের হামলা থেকে তাঁদের জীবন রক্ষায় তাঁদের নিরাপত্তামূলক হেফাজতে এনে রাখা হয়।
ধীরেসুস্থে অধিনায়কের অফিসে ঢুকেই মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে অধিনায়কের চেয়ারে বসা অবস্থায় দেখলাম। তাঁর পাশে সাফারি পরা ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত আলী। আমি ভেতরে গিয়ে জিয়াকে অভিবাদন করার পর তিনি আমাকে বললেন, 'তুমি ব্রিগেডে চলে যাও। গিয়ে সৈনিকদের কন্ট্রোল করো। তোমার কমান্ডারের (শাফায়াত জামিল) সঙ্গে আমি কিছুক্ষণ আগে কথা বলেছি, সে ভালোই আছে। আমিনকে নতুন কমান্ডার করা হয়েছে।' আমি তাঁর কথা শোনার পর অফিস থেকে বের হতেই এ জে এম আমিনুল হকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তিনি আমাকে কিছুটা সময় সেখানেই অবস্থান করে সব দেখেশুনে পরিস্থিতি অনুধাবন করার পর ব্রিগেডে যেতে বললেন। তিনি আরও বললেন, যেহেতু ব্রিগেডের আর কোনো স্টাফকে পাওয়া যায়নি আর তিনিও নতুন, তা ছাড়া এ পরিস্থিতিতে তিনি তাঁর ইউনিট চতুর্থ বেঙ্গল ছেড়ে যেতে পারবেন না, তাই আমি একাই যেন সব দায়িত্ব পালন করি।
আমাকে হাফিজের জায়গায় বিএমের দায়িত্ব নিতে বললে আমি তাঁকে আশ্বস্ত করে জানালাম, ও দিকটা আমি দেখে রাখব। আমাকে তিনি আরও জানালেন, ব্রিগেড মেজর হাফিজ বা স্টাফ ক্যাপ্টেন তাজ, কাউকেই সেনানিবাসে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
জিয়াউর রহমান দ্বিতীয় ফিল্ড রেজিমেন্টে এসেই বঙ্গভবনে খালেদ মোশাররফের খোঁজ করেন; কিন্তু তাঁকে না পেয়ে শাফায়াত জামিলকে পেয়ে যান। সিপাহি বিপ্লব শুরু হওয়ার খবর পেয়েই খালেদ মোশাররফ, হুদা আর হায়দার একসঙ্গে বঙ্গভবন ছেড়ে চলে যান। ফলে জিয়া শেষ পর্যন্ত শাফায়াত জামিলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। শাফায়াত জামিলকে পেয়ে জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, 'Forget and forgive. You come back.' তার উত্তরে শাফায়াত জামিল এ রকম একটা কিছু বলেছিলেন, 'I am a rebel and will remain so.' ওই সময় শাফায়াত জামিল যখন জিয়ার সঙ্গে বঙ্গভবনের ভেতর থেকে কথা বলছিলেন, তখন হয়তো তিনি বুঝতেও পারেননি যে এই অভ্যুত্থানের পেছনে জিয়া নয়, রয়েছেন তাহের, তাঁর 'গণবাহিনী' আর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা, অন্তত ওই পর্যায়ে।
মধ্যরাতে শাফায়াত জামিলকে যখন সেনানিবাসে ঘটে যাওয়া বিপ্লবের খবর দেওয়া হয়, তখনো তিনি প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে পারেননি। যখন জানতে পারলেন, তখন বেশ দেরি হয়ে গেছে। খালেদ মোশাররফের বঙ্গভবন ত্যাগ করার পর শাফায়াত জামিল জানতে পারেন যে তিনি একাই বঙ্গভবনে রয়ে গেছেন। প্রায় ভোররাতের দিকে জিয়াউর রহমানের ফোন পাওয়ার পর তিনি জানতে পারেন যে কিছু বিপ্লবী সৈনিক তাঁদের খোঁজে বঙ্গভবনের মেইন গেটে গিয়ে পৌঁছেছে। তখনই তিনি বেশ বিচলিত হয়ে ড্রাইভারের হাতে গাড়ির চাবি তুলে দিয়ে নিজে বঙ্গভবনের পেছনের দেয়াল টপকে পালানোর সময় তাঁর একটি পা ভেঙে যায়। তিনি এবং বঙ্গভবনে চতুর্থ বেঙ্গলের কোম্পানি কমান্ডার মেজর দীদার আতাউরের সঙ্গে একটি গাড়িতে চড়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম রোড ধরে মেঘনা ফেরিঘাট পর্যন্ত পৌঁছান।
শাফায়াত জামিল তাঁর ভাঙা পা নিয়ে তখন আর এগোতে পারছিলেন না। এই সময় দৈবক্রমে সেখানে নারায়ণগঞ্জের মহকুমা হাকিমের (নারায়ণগঞ্জ তখন মহকুমা ছিল) সঙ্গে তাঁদের দেখা হয়। তিনি একটি লঞ্চযোগে নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশে রওনা হওয়ার সময় দীদার আতাউর ও শাফায়াত জামিল নিজেদের পরিচয় দেন এবং তাঁকে জামিলের তাৎক্ষণিক চিকিৎসার প্রয়োজনের কথা জানালে এসডিও সাহেব তাঁদের লঞ্চে তুলে নেন। শাফায়াত জামিলের প্রাথমিক চিকিৎসার পর এসডিও সাহেব দুজনকে বন্দর থানায় সোপর্দ করেন। সেখান থেকেই ৭ নভেম্বর সকালে শাফায়াত জামিল জেনারেল জিয়াউর রহমানের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। কয়েক দিন পর উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে সিএমএইচে ভর্তি করা হয়। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ভাঙা পায়ের কারণে কিছুটা খুঁড়িয়ে চলতেন।
দ্বিতীয় ফিল্ড রেজিমেন্টের বারান্দায় দাঁড়িয়েই দেখতে পেলাম কর্নেল তাহের কিছু সৈনিক আর গণবাহিনীর সদস্য পরিবেষ্টিত অবস্থায় জিয়াউর রহমানের রুমে এসে ঢুকলেন। তাঁর সঙ্গীদের মধ্যে দ্বিতীয় ফিল্ডের কয়েকজন সদস্যও ছিল। প্রথমে তাহের ও জিয়া কোলাকুলি করলেন। কোলাকুলি পর্ব শেষ হতেই তাহের জিয়াউর রহমানকে রেডিও স্টেশনে গিয়ে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে বললেন। কিন্তু তাহেরের আসার আগেই জিয়াউর রহমান দ্বিতীয় ফিল্ডে বসেই অন্যান্য অফিসারের পরামর্শে তাঁর ভাষণ টেপ করে রেডিওতে পাঠিয়ে দেন। পরে তাহের সৈনিকদের পক্ষ থেকে জিয়াকে কিছু দাবিদাওয়ার লিস্ট দিলে তিনি পরে এ ব্যাপারটি বিবেচনা করে দেখবেন বলে রেখে দেন। জিয়ার এমন আচরণে তাহের খুব একটা খুশি হতে পারলেন না। তিনি একান্তে জিয়ার সঙ্গে কিছু কথা বলে উত্তেজিত হয়ে অফিসকক্ষ ত্যাগ করেন।
জিয়ার সঙ্গে সেদিন তাহেরের কী কথা হয়েছিল, বিস্তারিতভাবে তা জানা না গেলেও অসমর্থিত সূত্রে কিছু তথ্য পাওয়া গিয়েছিল। তবে সিপাহি বিপ্লবের শুরু থেকেই রেডিও বাংলাদেশ ('বাংলাদেশ বেতার'-এর পরিবর্তিত নাম) দীর্ঘ সময় পর্যন্ত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ও জাসদ গণবাহিনীর এখতিয়ারে ছিল এবং জিয়াকে সেখানে সশরীর গিয়ে ভাষণ দেওয়া থেকে বিরত করা হয়েছিল। এমনটা করা হয়েছিল এ কারণে যে তাহের প্রথম থেকেই জিয়াকে সম্পূর্ণভাবে তাঁর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। তাহের জিয়াকে রেডিওতে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন সৈনিকদের দাবিদাওয়া এবং রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কাঠামো বা রূপরেখা কেমন হবে, সে সম্পর্কে ঘোষণা দেওয়ার জন্য।
বিভিন্ন অসমর্থিত সূত্র থেকে আরও জানা গেছে যে তাহেরের পরিকল্পনা ছিল জিয়াকে রেডিও স্টেশন থেকে শহীদ মিনারে নিয়ে যাওয়া এবং সেখানে গণবাহিনী ও বিপ্লবী সৈনিকদের উদ্দেশে তাঁকে ভাষণ দিতে বলা। বিপ্লবী সৈনিকদের পরিকল্পনা ছিল জিয়াকে ফেরার সময় পথিমধ্যে গুলি করে হত্যা করা। মীর শওকত আলী যখন অল্প সময়ের জন্য সিজিএস ছিলেন, তখন তাঁর কাছ থেকে এ ধরনের বক্তব্য পাওয়া গিয়েছিল। এ ধরনের একটা গুজবও শোনা গিয়েছিল যে এই ষড়যন্ত্রের কথা গণচীনের গোয়েন্দা সংস্থা ঢাকার কোনো এক দূতাবাসের মাধ্যমে জিয়াউর রহমানকে জানিয়েছিল। তবে এ-সংক্রান্ত কোনো দালিলিক প্রমাণ না পাওয়া গেলেও লক্ষণীয় যে জিয়াউর রহমান সিএমএলএ হওয়ার পরপরই প্রথম যে দেশটি সফর করেন, সেটি ছিল গণচীন। আর তখন গণচীনের রাষ্ট্রীয় নেতারা প্রটোকল ভঙ্গ করে জিয়াউর রহমানকে পিকিং (বর্তমান বেইজিং) বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। সেই থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে গণচীনের সম্পর্ক বেশ গভীর।
দ্বিতীয় ফিল্ডে তখন চলছিল একধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি। এরই মধ্যে সংবাদ এল খালেদ মোশাররফ, যিনি মুক্তিযুদ্ধে কে ফোর্সের কমান্ডার হিসেবে ১০ ইস্ট বেঙ্গলকে পুনর্গঠিত করেন, কর্নেল কে এন হুদা, যিনি ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে কয়েক দিন আগে এই ইউনিটকে ঢাকায় নিয়ে আসেন এবং লে. কর্নেল হায়দার-এ তিনজনকেই শেরেবাংলা নগরে এমপি হোস্টেলের সামনে ১০ ইস্ট বেঙ্গলের অস্থায়ী লাইনেই উচ্ছৃঙ্খল সিপাহিরা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। জিয়াউর রহমান এ খবর শুনে তাঁদের মৃতদেহ সেনানিবাসে পাঠাতে বললেন। মৃতদেহগুলো তিনি দেখবেন বলেই দ্বিতীয় ফিল্ড রেজিমেন্টে আনার ব্যবস্থা করা হলো।
এ খবর শুনে আমার হাত-পা হিম হয়ে আসছিল। এ ধরনের পরিস্থিতি এবং চলমান এই বিপ্লবের ভয়াবহতা সম্বন্ধে এতক্ষণ আমি এতটা অনুমান করতেই পারিনি। সমস্ত হৃদয়-মন কেমন এক বিষাদে ঢেকে গেল। দেখলাম দ্বিতীয় ফিল্ড রেজিমেন্টের অধিনায়ক আনোয়ার হোসেনকে তাঁরই ইউনিটের সৈনিকেরা খুঁজে বের করে এনেছে। তবে তাঁর কপাল ভালো যে তিনি কোনোরকম লাঞ্ছিত হননি বরং সৈনিকেরা তাঁকে ওই পরিস্থিতির মধ্যেও সম্মানের সঙ্গেই সেদিন নিয়ে এসেছিল।
লে. কর্নেল আনোয়ার হোসেন আগের রাতে, অর্থাৎ ৬ নভেম্বর সন্ধ্যায়, ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াত জামিলের সঙ্গে বঙ্গভবনেই ছিলেন। কনফারেন্স শেষ হওয়ার পর শাফায়াত জামিল যখন বঙ্গভবনের উদ্দেশে রওনা হন, তখন তিনি আনোয়ার হোসেনকে তাঁর সঙ্গে নিয়ে যান। যখন বঙ্গভবনে খবর এল যে সিপাহি বিপ্লব শুরু হয়ে গেছে, তখন শাফায়াত জামিল তাঁকে বঙ্গভবন ছেড়ে যেতে বললে আনোয়ার খানিকটা ইতস্তত করেন এবং পরে একাই বের হয়ে পথিমধ্যে কোথাও রাত যাপন করে বাসায় ফেরেন।
আমি অত্যন্ত বিষণ্ণ মনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দ্বিতীয় ফিল্ডের সিপাহিদের আনাগোনা দেখছিলাম। মনে হলো এই রেজিমেন্টের সঙ্গে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার যোগাযোগ হয়েছিল ১৯৭৫-এর ৩ নভেম্বরেই। দ্বিতীয় ফিল্ডের অধিনায়ক লে. কর্নেল আনোয়ার হোসেন তখনো অনুপস্থিত। কোথায় আছেন কেউ বলতে পারছে না। সুবেদার মেজর আনিস একবার জিজ্ঞেস করলেন আমি কিছু জানি কি না? বললাম যে গত রাতে ব্রিগেড কমান্ডারের সঙ্গে তিনি বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন, তার পরের কথা আর বলতে পারব না। উল্লেখ্য, লে. কর্নেল আনোয়ার ৩ নভেম্বর তাঁদের পাশের ইউনিট চতুর্থ বেঙ্গলে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে পরে খালেদ মোশাররফের পীড়াপীড়িতে কর্নেল রউফের সঙ্গে জিয়াকে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করাতে গিয়েছিলেন। তাঁর রেজিমেন্ট এ ঘটনা জানা সত্ত্বেও তাঁরা ওই মুহূর্তে আনোয়ারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিলেন।
আমি পরিস্থিতি তখনো হৃদয়ঙ্গম করতে পারিনি বলে এ বিষয়ে বেশি কথাবার্তায় যাইনি। আমি আর্টিলারি অফিসার হলেও ছিলাম ৪৬ ব্রিগেডে। ব্রিগেডের কয়েকটি ইউনিট প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তিনটি অভ্যুত্থানেই জড়িত ছিল। তারপরও আমার একাত্মতা ও নিরপেক্ষতার কারণে এবং সাধারণ সৈনিকদের সঙ্গে আমার কম দূরত্ব থাকায় আমার প্রতি তাদের কোনো ক্ষোভ দেখিনি। প্রায় অফিসারই যখন বিপ্লবী সিপাহিদের কথায় বা দাবির মুখে র্যাঙ্ক খুলে ফেলছিলেন, তখন আমার র্যাঙ্ক পরে থাকা নিয়ে কেউ প্রশ্নও তোলেনি। তবে সে মুহূর্তে রেজিমেন্টের সুবেদার মেজর আনিসই আমার মনে হলো, সম্পূর্ণ পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন।
আমি দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, চলমান পরিস্থিতিতে এত ভোরে ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে আমার একা যাওয়া ঠিক হবে কি না। এমন সময় মেজর মুহিউদ্দিন (পরে যাঁর ফাঁসি হয়েছে) আমার সামনে এসে কুশলাদি বিনিময় করার পর জিজেস করলেন জিয়ার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে কি না। মাথা নেড়ে বললাম, 'হ্যাঁ'। ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই নায়েব সুবেদার দবীরের সঙ্গে দেখা হলো। পরে বিপ্লবী সৈনিকদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের কথা জেনেছি। পরবর্তীকালে দবীর সৈয়দপুরে আমার ইউনিটে যোগ দেন। যা-ই হোক, মেজর মুহিউদ্দিনের মুখে আগের রাতের কাহিনি শুনলাম।
যেহেতু সে সময় চতুর্থ বেঙ্গলে কেউ ছিলেন না। এ জে এম আমিনুল হক গোলাগুলির শব্দ শুনে ইউনিট লাইনে চলে আসেন। তাঁর বাড়ির পেছনেই ইউনিট লাইন। অপর দিকে মুহিউদ্দিনসহ দ্বিতীয় ফিল্ডের প্রায় সবাই ৩ নভেম্বরের পর থেকে ইউনিট লাইনেই কাটিয়েছেন। কথিত সিপাহি বিপ্লব শুরু হতেই সিগন্যাল এয়ারপোর্টে গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। হাফিজুল্লাহর নেতৃত্বে জিয়ার বাড়ি ঘিরে রাখা প্রথম বেঙ্গলের সৈনিকেরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন এই ভেবে যে সম্ভবত পাল্টাঅভ্যুত্থান শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে মুহিউদ্দিন, তাঁর ভাষ্যমতে, জিয়াকে মুক্ত করতে তাঁর এক ব্যাটারি সৈনিক নিয়ে জিয়ার বাড়িতে পৌঁছালে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকেরা কোনো ওজর-আপত্তি না করে তাঁদের সঙ্গে মিশে যান। এখানে আবারও স্মরণযোগ্য যে জিয়া তরুণ অফিসার হিসেবে এই ইউনিটেই যোগ দেন এবং ১৯৬৫ সালে লাহোর ফ্রন্টে যুদ্ধ করে ভারতীয় আক্রমণ ঠেকিয়েছিলেন। অর্থাৎ সব সিনিয়র এনসিও এবং জেসিও জিয়ার সঙ্গে ওই একই সামরিক ইউনিটে বেড়ে ওঠেন।
এ জে এম আমিনুল হক-তিনি তখনো কার্যত নতুন সিএএস খালেদের পিএস (তাঁর স্থলাভিষিক্ত হওয়ার কথা ছিল প্রাক্তন বিএম ও সদ্য পদোন্নতিপ্রাপ্ত লে. কর্নেল গফফার হালদার বিইউ-এর) যখন ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছান, জিয়া তখন মুহিউদ্দিন এবং সুবেদার মেজর আনিসের দ্বিতীয় ফিন্ড রেজিমেন্টের সৈনিকদের সঙ্গে। চারদিক 'নারায়ে তাকবির/ আল্লাহু আকবার', 'বাংলাদেশ/ জিন্দাবাদ', 'জেনারেল জিয়া/ জিন্দাবাদ' ধ্বনিতে মুখর। মুহিউদ্দিন ও আনিসের সৈনিকেরা জিয়াকে চারদিক থেকে ঘিরে ও জিপে উঠিয়ে যখন দ্বিতীয় ফিল্ড রেজিমেন্টে নিয়ে আসেন, ঠিক তখনই তাহেরের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার লালিত বিপ্লবের স্বপ্ন মিলিয়ে যায়।
বস্তুত ২-৩ নভেম্বর খালেদের অভ্যুত্থান শুরু হওয়ার পর তাহেরের সঙ্গে জিয়ার যোগাযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাহের জিয়াকে মুক্ত করার এবং তাঁকে ব্যবহার করে তাঁর বিপ্লব কর্মসূচি বাস্তবায়নের ছক কষে রাখেন। খালেদের অভ্যুত্থানের খবর পেয়েই তাহের ঢাকার বাইরে থেকে দ্রুত ঢাকায় ফিরে আসেন এবং খালেদের সেনাবিচ্ছিন্ন অভ্যুত্থানের দুর্বলতার সুযোগ নেন। তিনি সেনানিবাসগুলোতে, বিশেষ করে ঢাকা সেনানিবাসে, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যদের প্রস্তুত করেন। এদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিল ঢাকাস্থ সেনাবাহিনীর সার্ভিস কোর এবং বিমানবাহিনীর সদস্য। ছিল কয়েকজন সেনা করণিকও। একই সঙ্গে জাসদের গণবাহিনীকেও সক্রিয় করা হয়। খালেদ এবং তাঁর সঙ্গের অফিসারদের ভারত ও আওয়ামীপন্থী বলে প্রচার চালানোর মাধ্যমে সাধারণ সৈনিকদের খেপিয়ে তুললেন ও তাদের কাছে জিয়াকে মহৎ করে তুললেন।
কথা ছিল বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা এবং গণবাহিনী জিয়াকে উদ্ধার করে তাহেরের কাছে নিয়ে যাবে। কিন্তু দ্বিতীয় ফিল্ড রেজিমেন্টের সুবেদার মেজর আনিসকে তাহের বাগে আনতে পারেননি। আনিস মেজর মুহিউদ্দিনকে সঙ্গে নিয়ে জিয়াকে উদ্ধার করে আনলে তাহেরের ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা ভন্ডুল হয়ে যায়।
চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক এ জে এম আমিনুল হক বীর উত্তমই জিয়াকে মীর শওকতের ঢাকায় অবস্থানের কথা জানান। এর পরপরই ভারপ্রাপ্ত ডাইরেক্টর মিলিটারি অপারেশন কর্নেল নূরুদ্দীন (পরে জেনারেল ও সেনাপ্রধান) অধিনায়কের পার্শ্ববর্তী অ্যাডজুট্যান্টের রুমে বসে অপারেশন সেল গঠন করেন। উল্লেখ্য, তখন সিজিএস পদে কেউ ছিলেন না। ডাইরেক্টর অপারেশন কর্নেল মালেক ওই রাতে এবং পরেও অনেক দিন আত্মগোপনে ছিলেন, তেমনি ডাইরেক্টর মিলিটারি অপারেশন কর্নেল এ টি সালাহউদ্দিনও আত্মগোপনে থাকেন। তাঁরা ১৯৭৫-এর ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের সঙ্গে স্বতঃপ্রণোদিতভাবেই জড়িত ছিলেন। তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে তাঁরা ছিলেন খালেদ মোশাররফের 'ভারতীয় ও আওয়ামী চক্রে'র দালাল। আর এই গুজবের হোতা ছিল জাসদ, গণবাহিনী ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা।
যাহোক, ৭ নভেম্বর সেই সকালের কথায় ফিরে আসি। আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে আস্তে আস্তে অ্যাডজুট্যান্টের রুমে গিয়ে ঢুকলাম। সেখানে লে. কর্নেল নুরুদ্দীন খান অত্যন্ত ধীরস্থিরভাবে আমাকে বসতে ও চা খেতে বললেন। সেখানে আরও অনেকেই তখন ছিলেন। পাশের রুমেই জিয়া বসে বিভিন্নজনের সঙ্গে ফোনে আলাপ করছিলেন। এত উত্তেজনা আর আশঙ্কার মধ্যেও নরুদ্দীন খানকে অত্যন্ত শান্তভাবে বিভিন্ন জায়গায় কী হচ্ছে না হচ্ছে, বিভিন্ন অফিসার কোয়ার্টার ও সেনানিবাসে কী ঘটছে, তার খোঁজখবর নিতে দেখলাম। তিনি শান্ত গলায় বললেন, 'খালেদ মোশাররফ মারা গিয়েছে, শুনেছ তো?' আমি মাথা নাড়ালাম। তিনি আরও বললেন, 'আনোয়ারের কাছ থেকে শোনো।' কর্নেল আনোয়ার হোসেনের মুখে সংক্ষেপে খালেদ মোশাররফের মৃত্যুর ঘটনা শুনলাম। পরে আমি আমার কোর্সমেট দশম ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক লে. কর্নেল নওয়াজিশ আহমেদের (পরে কর্নেল, ১৯৮১ সালে চট্টগ্রামে জিয়াউর রহমান হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে যাঁর ফাঁসি হয়) কাছ থেকে বিস্তারিতভাবে ঘটনাটা শুনি।
সপ্তাহখানেক পরে নওয়াজিশের অফিসে গেলে সে আমাকে যা বলেছিল, তা এই যে ৭ নভেম্বর রাত ১২টার পর যখন ঢাকা সেনানিবাসের ভেতর থেকে সিপাহি বিপ্লবের সূচনা হয়, তখন খালেদ মোশাররফ এবং তাঁর সঙ্গীরা বঙ্গভবনেই ছিলেন। সিপাহি বিপ্লবের সূচনাতেই বেঙ্গল ল্যান্সার আর দ্বিতীয় ফিল্ড রেজিমেন্ট এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। অন্যান্য নন-ইনফেন্ট্রি ইউনিটেরও বেশির ভাগ এতে জড়িয়ে পড়ে। এ খবর খালেদ মোশাররফের কাছে পৌঁছে যায় এবং তাঁকে এ-ও জানানো হয় যে সিপাহি বিপ্লবের পুরোভাগে রয়েছেন জিয়াউর রহমান। আরও জড়িত রয়েছে জেএসডির 'গণবাহিনী' ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন কর্নেল তাহের এবং প্রাথমিক পর্যায়ে তাঁরা টার্গেট করা করেছে ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের নেতাদের।
কিছুক্ষণ পরেই কিছুসংখ্যক সৈনিক অধিনায়কের অফিসের দরজা, বলতে গেলে ভেঙে, তিনজনকেই বাইরে অর্থাৎ নিচের গ্যারেজে নিয়ে এসে গুলি করে হত্যা করে। এসব সৈনিকের সঙ্গে দুজন তরুণ অফিসারও-ক্যাপ্টেন আসাদ ও ক্যাপ্টেন জলিল-দুজনই দশম ইস্ট বেঙ্গলের কোম্পানি কমান্ডার-এই হত্যাযজ্ঞে অংশগ্রহণ করেন। এ দুজন কেন এই হত্যাযজ্ঞে অংশগ্রহণ করেন তা জানা যায়নি।
এসব সংবাদ শুনে খালেদ মোশাররফ কর্নেল হুদার মাধ্যমে দশম ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক নওয়াজিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। নওয়াজিশ তাঁদেরকে তাঁর ইউনিটে আসার জন্য বলেন। পরে ঘটনাটি এভাবে রটে যায় যে একটি বেসামরিক গাড়িতে চড়ে খালেদ মোশাররফরা আরিচা পার হয়ে উত্তরবঙ্গের দিকে যাওয়ার পথে আসাদ গেটের কাছে তাঁদের গাড়ি বিকল হয়ে পড়ে। ফলে তাঁরা তখন নিকটস্থ একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে গিয়ে কাপড়চোপড় বদলে হেঁটে দশম ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়কের অফিসে পৌঁছান। তবে নওয়াজিশ ঘটনার এ বিবরণ সমর্থন করেননি।
আমার সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে পরে নওয়াজিশ খালেদ মোশাররফের তরফ থেকে একটি ফোন কল পাওয়ার কথা বলেছিলেন। তবে কলটি কোথা থেকে তাঁরা করেছিলেন, সে বিষয়ে তিনি কিছু বলতে পারেননি। খালেদ মোশাররফ, কে এন হুদা আর হায়দার-তিনজনই হেঁটে অধিনায়কের অফিসে যান ও সেখানে অবস্থান গ্রহণ করেন। ভোরের দিকে জিয়াউর রহমান খালেদ মোশাররফের অবস্থান জানার পর তাঁর (খালেদ) সঙ্গে কথা বলেন এবং দুজনের মধ্যে তখন কিছু উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। পরে জিয়াউর রহমান নওয়াজিশকে তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা বলেন। এ কথা মরহুম নওয়াজিশ নিজেই আমাকে বলেছিলেন।
নওয়াজিশ সকালের দিকে তাঁদের জন্য নাশতার বন্দোবস্ত করেন এবং তাঁর বর্ণনামতে, এ সময় খালেদ মোশাররফ অত্যন্ত স্বাভাবিক ও শান্ত ছিলেন। তবে কর্নেল হুদা আর হায়দার কিছুটা শঙ্কিত হয়ে উঠলে খালেদ মোশাররফ স্বাভাবিক স্বরে তাঁদের পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে বলেন। ইতিমধ্যে সেনানিবাস থেকে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কিছু সদস্য দশম ইস্ট বেঙ্গলের লাইনে এসে সেখানে অবস্থানরত সৈনিকদের বিপ্লবের পক্ষে উত্তেজিত করতে থাকেন। সেই সঙ্গে তাঁরা খালেদ মোশাররফ ও তাঁর সঙ্গীদের হস্তান্তর করার জন্যও অধিনায়কের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন। এরপরও জিয়া আরেকবার নওয়াজিশকে ফোন করে খালেদ ও তাঁর সঙ্গীদের নিরাপত্তার কথা মনে করিয়ে দেন। কিন্তু নওয়াজিশ উত্তেজিত সৈনিকদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এ সময় খালেদ মোশাররফ মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও একটি সিগারেট ধরিয়ে টানতে থাকেন।
কর্নেল হুদা আর হায়দার বারবার নওয়াজিশকে তাঁদের জীবনের নিরাপত্তার কথা স্মরণ করাতে থাকলে খালেদ মোশাররফ বলে ওঠেন, 'Do not request for your life. Take it easy. You should have known your fate by now.' (কথাগুলো মরহুম লে. কর্নেল নওয়াজিশের মুখ থেকে শোনা। হয়তো কিছুটা হেরফের হলেও হতে পারে।) এর কিছুক্ষণ পরেই কিছুসংখ্যক সৈনিক অধিনায়কের অফিসের দরজা, বলতে গেলে ভেঙে, তিনজনকেই বাইরে অর্থাৎ নিচের গ্যারেজে নিয়ে এসে গুলি করে হত্যা করে। এসব সৈনিকের সঙ্গে দুজন তরুণ অফিসারও-ক্যাপ্টেন আসাদ ও ক্যাপ্টেন জলিল-দুজনই দশম ইস্ট বেঙ্গলের কোম্পানি কমান্ডার-এই হত্যাযজ্ঞে অংশগ্রহণ করেন। এ দুজন কেন এই হত্যাযজ্ঞে অংশগ্রহণ করেন তা জানা যায়নি।
সকাল তখন প্রায় ১০টা। আমি লে. কর্নেল নুরুদ্দীন খানের দ্বিতীয় ফিল্ড অ্যাডজুট্যান্টের অফিসে বসা। সেখানে তখন অনেক অফিসারের ভিড়। সবার সঙ্গে শান্তভাবে কথা বলে আশ্বস্ত করে নুরুদ্দীন খান তাঁদের যাঁর যাঁর কর্মস্থলে পাঠিয়ে দিতে থাকেন। নূরুদ্দীন খানকে সেই চরম সংকটময় মুহূর্তে শান্ত থেকে নিরলসভাবে পরিস্থিতি সামলাতে আমি দেখেছি। এরই মধ্যে সৈনিকদের মূল ২২ দফা দাবিসংবলিত লিফলেটটি (যা পরে কাটছাঁট করে ১২ দফা দাবিনামায় পরিণত করা হয়) জিয়াউর রহমানের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
দাবিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল-ব্রিটিশ ভারতীয় সামরিক বাহিনীর আমল থেকে প্রচলিত ব্যাটম্যান প্রথা (সৈনিকেরা অফিসারদের ব্যক্তিগত কাজে নিয়োজিত হতো 'ব্যাটম্যান' নামে) বাতিল করা, সৈনিক আর অফিসারদের মধ্যকার বেতনবৈষম্য দূর করে সাধারণ সৈনিকদের বেতন বৃদ্ধি করা, মেডিকেল অ্যালাউন্স (যদিও মেডিকেল সেবাপ্রাপ্তি ফ্রি ছিল) ও যাতায়াত ভাতা প্রবর্তন করা, সৈনিক র্যাঙ্ক থেকে সরাসরি অফিসার পদে ভর্তি এবং সরাসরি কমিশন প্রদান বন্ধ করা, ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের হোতাদের শাস্তির ব্যবস্থা করা, ৭ নভেম্বরকে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা এবং অফিসারদের মতো সাধারণ সৈনিকদের জন্যও মেসব্যবস্থা চালু করা ইত্যাদি। উল্লেখ্য, বাহিনীতে সৈনিকদের ফ্রি খাবারের ব্যবস্থা থাকলেও অফিসার মেসে খাবারের বিল অফিসারদেরই পরিশোধ করতে হয়।
আমি নুরুদ্দীন খানের অফিসে বসে থাকতে থাকতেই জিয়াউর রহমান মীর শওকত আলী প্রমুখকে নিয়ে বাইরে কোথাও বেরিয়ে গেলেন। অবশ্য এর আগেই দেশবাসীর উদ্দেশে জিয়াউর রহমানের আগে ধারণ করা ভাষণটি রেডিওতে প্রচার করা হয়। তবে সে ভাষণে সৈনিকদের দাবিদাওয়া মেনে নেওয়ার কোনো কথা বলা হয়নি। বরং সৈনিকদের তিনি জোর দিয়ে শান্ত থাকতে ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে বলেছিলেন। আর দেশবাসীকেও বলেছিলেন শান্ত থেকে যার যার কাজকর্ম চালিয়ে যেতে। যথারীতি সরকারের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে। তিনি তাঁর ভাষণ শুরু করেছিলেন 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম' দিয়ে আর শেষ করেছিলেন 'বাংলাদেশ জিন্দাবাদ' বলে।
বেলা প্রায় ১১টার দিকে খালেদ মোশাররফ আর তাঁর সঙ্গীদের মৃতদেহ একটি বেসামরিক ট্রাকে করে দ্বিতীয় ফিল্ড রেজিমেন্টে নিয়ে আসা হয়। সেখানে তাঁদের লাশ দেখতে উৎসুক দর্শকদের ভিড় জমে যায়। পরে সেখান থেকে ওই গাড়িতেই মৃতদেহগুলো সিএমএইচে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
আমি ঘণ্টা কয়েক লে. কর্নেল নুরুদ্দীন খানের অফিস বসে কাটাই আর ভাবতে থাকি আমার এই পরিস্থিতিতে কী করা উচিত। প্রায় দুপুরের দিকে ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার থেকে একটি জিপে ব্রিগেডের সিনিয়র জেসিও (জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার) ও আরও কিছু সৈনিক খবর পেয়ে আমাকে হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যেতে উপস্থিত হলেন। আমি ঠিক মন স্থির করতে পারছিলাম না, এমন পরিস্থিতিতে আমার সশস্ত্র সৈনিকদের সঙ্গে যাওয়া ঠিক হবে কি না। মনে হলো, নুরুদ্দীন খান আমার সংশয়ের ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন। তাই বললেন, যেহেতু তারা আমাকে খুঁজে নিতে এসেছে, আমার যাওয়া উচিত। আমার সংশয়টা ছিল এ কারণে যে এদের মধ্যে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কোনো সদস্য আছে কি না, আমার জানা নেই।
বস্তুত প্রশাসনের জন্য ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের একটি কোম্পানি থাকে, যার সদস্যরা বিভিন্ন ইউনিট ও সার্ভিসেস থেকে প্রেষণে তাতে যুক্ত হন। কাজেই যিনি স্টাফ অফিসার ট্রপসের সঙ্গে তাঁর তেমন মেলামেশা হয় না এবং পদাধিকারবলে ব্রিগেড মেজরই হন এক অর্থে কোম্পানির অফিসার কমান্ডিং (অধিনায়ক)। গাফফার বিদেশে তিন মাসের ট্রেনিংয়ে থাকাকালে আমি এই কোম্পানির দায়িত্বে ছিলাম। ওই সময়ই আমার সঙ্গে এর সদস্যদের ঘনিষ্ঠতা হয়। তাই ওই মুহূর্তে আমি যেমন তাদের ফিরিয়ে দিতে পারি না, তেমনি মনে হলো তাদের নেতৃত্ব দেওয়াও আমার কর্তব্য। ওদের চেহারা দেখে মনে হলো, ওরা দিশাহারা এবং উদ্ভ্রান্ত। যাহোক, সাহস সঞ্চয় করে তাদের সঙ্গে ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে যাওয়াই মনস্থ করলাম। তবে রওনা হওয়ার আগে লে. কর্নেল নুরুদ্দীন খানের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে আমার অবস্থান সম্পর্কে জানালাম। তিনি অত্যন্ত শান্ত গলায় বললেন, 'খোদা হাফেজ।' যাওয়ার সময় তিনি বললেন, 'যাই হোক, তোমার সাহস আর অফিসার কোয়ালিটিই তোমাকে নিরাপদ রাখবে।'
পরের দিন, অর্থাৎ ৮ নভেম্বরে জিয়াউর রহমান আবার সেনাপ্রধানের পদাধিকারবলে সেনাসদরে এলেন। খালেদ মোশাররফের জায়গায় ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত আলী সিজিএস হিসেবে নিযুক্ত হলেন। সেদিন সকালেই শুনতে পেলাম চারজন অফিসারকে সিপাহিরা হত্যা করেছে। এদের মধ্যে হামিদা নামে এক লেডি ডাক্তার এবং ডেন্টাল সার্জন করিমকে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত আক্রোশে হত্যা করা হয়। আরও দুজন অফিসার, যাঁরা বাংলাদেশ হকি ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন-ক্যাপ্টেন আনোয়ার ও লেফটেন্যান্ট মোস্তাফিজ-তাঁদেরও টিভি স্টেশনের কাছে তাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। সেদিনই প্রায় ১০টার দিকে বিমানবন্দরে আরেকজন অফিসার মেজর আজিমকে হত্যা করা হয়। তিনি নিজের কাজ সেরে চট্টগ্রাম যাচ্ছিলেন। সাধারণ মানুষ সেদিনই এসব হত্যার খবর জানতে পারে। ফলে তাদের মধ্যেও এই অভ্যুত্থান নিয়ে উদ্বেগ বাড়তে থাকে।
আগের দিনের মতো তারা আর এই অভ্যুত্থান নিয়ে উৎসাহিত থাকতে পারল না।
অপর দিকে সাধারণ সৈনিক, যারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ৭ নভেম্বরের কথিত সিপাহি-জনতার বিপ্লবে যোগ দিয়েছিল, তাদেরও মোহভঙ্গ হতে শুরু করেছিল। ক্রমেই সাধারণ সৈনিকেরা বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সঙ্গে নিজেদের দূরত্ব তৈরি করতে শুরু করল। ৭-৮ নভেম্বরে যারা 'সিপাহি সিপাহি ভাই ভাই' বলে স্লোগান দিয়েছিল, তারাই নেতৃত্বের অভাবে দিশাহারা হয়ে পড়তে শুরু করে। উল্লেখ্য, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থায় যে কিলার গ্রুপ তাহের তৈরি করেছিলেন, তার মধ্যে বেশির ভাগই ছিল সেনাবাহিনীর বিভিন্ন সার্ভিস কোর এবং বিমানবাহিনীর সৈনিক। ঢাকায় ৪৬ ব্রিগেডের চারটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন ছিল। এর মধ্যে শেরেবাংলা নগরেরটি ছাড়াও আরও একটি নতুন ব্যাটালিয়ন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ৭-৮ নভেম্বরের তৎপরতায় যোগ দেয়নি। এ অবস্থায় জিয়া অনুধাবন করতে শুরু করেন যে তাহের এ দফায় পরাজিত হয়েছেন। ক্রমেই ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের কমান্ডার, অফিসার এবং সৈনিকেরাসহ প্রায় সম্পূর্ণ সামরিক বাহিনী জিয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে থাকে। সব মিলিয়ে দেশ তখন এক নাজুক পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল।
৮ নভেম্বর থেকে জিয়াউর রহমান কালক্ষেপণ না করে প্রায় ঝড়ের গতিতে সমগ্র সেনানিবাস ঘুরে ঘুরে সৈনিকদের সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। বিভিন্ন সমাবেশে তিনি সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা বলতে থাকলেন। সেদিনই বিকেলের দিকে তিনি চতুর্থ বেঙ্গলের লাইনের কাছে ঢাকা সেনানিবাসের সৈনিকদের ডেকে তাদের সঙ্গে কথা বললেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, সেদিন ঢাকা সেনানিবাসে সাকল্যে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশজন মাত্র অফিসার উপস্থিত ছিলেন। তার মধ্যে ওই চল্লিশ-পঞ্চাশজন অফিসার ছাড়া সেনানিবাসে আর সবাই ছিল সশস্ত্র।
জিয়াউর রহমান দৃঢ়কণ্ঠে অস্ত্র জমা দিয়ে সৈনিকদের নিজ নিজ ব্যারাকে ফিরে যেতে বললেন। তিনি আরও ঘোষণা করলেন, সৈনিকদের ন্যায্য দাবিদাওয়া তিনি মেনে নেবেন এবং অতিসত্বর এ সম্পর্কে বিচার-বিবেচনা করে যথাসময়ে তাদের জানাবেন। তিনি এ ঘোষণা সরকারের পক্ষ থেকেই দেন, যদিও তখন বিচারপতি আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েমকেই রাষ্ট্রপতি হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে বলা হয়েছিল। আগের দিন অর্থাৎ ৭ নভেম্বর দুপুরের দিকে জিয়াউর রহমান মীর শওকতের সঙ্গে রেডিও স্টেশনে গেলে তাহের এবং তাঁর সমর্থক সৈনিকদের চাপে তিনি তাদের সংশোধিত দাবিগুলো নীতিগতভাবে মেনে নিয়েছিলেন। আবারও তিনি সৈনিকদের সে কথাই জানালেন।
সভায় জিয়া যখন সৈনিকদের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা আর অস্ত্র জমা দেওয়ার কথা বলছিলেন, তখন একজন সৈনিক অসাবধানতাবশত নিজেই নিজের রাইফেলের গুলিতে নিহত হন। জিয়ার ভাষণের পর সৈনিকেরা যার যার অস্ত্র জমা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিল।
সেদিন ৮ নভেম্বর, রাত প্রায় ৯টার দিকে আমি ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে বসে আছি। এমন সময় ব্রিগেডের সিগন্যাল অপারেটর এসে খবর দিলেন, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা সে রাতেও বেশ কিছু অফিসার নিধনের লিস্ট তৈরি করেছে। তিনি যা জানালেন, তার মূল কথা হলো, সৈনিকদের সব দাবি মানা না হলে এ সংগ্রাম চলতেই থাকবে। তিনি আরও জানালেন যে অফিসার নিধনের সঙ্গে মাত্র গুটি কয় সৈনিকই জড়িত, বিশেষ করে 'সৈনিক সংস্থা'কে সমর্থনকারী কিছু সিগন্যাল, ল্যান্সার আর সামরিক করণিক। এদের মধ্যেই বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার তৎপরতা বিস্তৃত ছিল।
তাহেরের পরিকল্পনা যদি কার্যকর হতো, তাহলে সেদিন রাতে কিংবা পরের কয়েক দিনের মধ্যেই সেনাবাহিনীর 'কমান্ড স্ট্রাকচার' ভেঙে পড়ত এবং জিয়াউর রহমানকে হত্যা করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করা হতো। তাহের সাধারণ সৈনিকদের দলে টানেন তাদের বিভিন্ন দাবিদাওয়া আদায় করার কথা বলে। তাহের তাঁর সমর্থকদের কাছে সামরিক বাহিনীর অফিসারদের সামন্ততান্ত্রিক আচার-আচরণের উদাহরণ তুলে ধরতেন। এ রকম অপপ্রচারের মাধ্যমে তাঁদের পরিকল্পনা অনুযায়ী সেনাবাহিনীর কাঠামো ভেঙে শেষ করার পর বেসামরিক আমলাতন্ত্রের ওপরও তাঁরা একই ধরনের হামলা চালাতেন বলে মনে হয়। তাতে দেশ এক চরম বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে পড়ত। বিপন্ন হতো দেশের সার্বভৌমত্ব আর স্বাধীনতা।
জিয়াউর রহমান তাহেরের অভিলাষ বোঝার পরপরই তাঁর কাছ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেন এবং সৈনিকদের নিয়মশৃঙ্খলার মধ্যে আনার জন্য দ্রুততার সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে থাকেন। জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তা আর ব্যক্তিত্ব, সাহস আর ত্বরিত পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে দু-এক দিনের মধ্যেই পুরো পরিস্থিতি তাঁর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
-সংক্ষেপিত
সূত্র: রক্তাক্ত দিনগুলো ১৯৭৫-৮১: অভ্যুত্থান-পাল্টাঅভ্যুত্থান, প্রত্যক্ষদর্শীর অভিজ্ঞতা-এম সাখাওয়াত হোসেন, প্রথমা প্রকাশন।