আর ‘মা’ ডাক শুনতে পান না তাঁরা

মা সামিরা জাহানের সঙ্গে আবদুল্লাহ আল মাহিন
ছবি: পরিবারের সৌজন্যে

একটি ছবিতে দেখা যায়, এক কিশোরসহ দুজন গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় পড়ে আছে, অদূরে শটগান হাতে দাঁড়ানো এক ব্যক্তি। আরেকটি ছবিতে দেখা যায়, রক্তাক্ত এক কিশোরকে নিয়ে ছুটছেন এক ব্যক্তি। দুটি ছবির কিশোর একজনই। নাম আবদুল্লাহ আল মাহিন, বয়স ১৬। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ১০ ঘণ্টা বেঁচে ছিল মাহিন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের রক্তঝরা উত্তাল সময়ের এ দুটি ছবি প্রকাশিত হয়েছিল প্রথম আলোতে।

ছয় বছরের শিশু রিয়া গোপের লাল ফ্রক পরা, মাথায় লাল ব্যান্ড পরা যে ছবি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল, সেটি ছিল ওর ষষ্ঠ জন্মদিনের। ২০২৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর। বরাবরের মতো সেবার তার জন্মদিনের অনুষ্ঠান হয়েছিল বাসায়। মা তাকে সাজিয়ে দিয়েছিলেন।

মিরপুরের ফুটবলপ্রিয় সাফকাত সামির (১০) বাসার ভেতর গুলিবিদ্ধ হয়। কারফিউ আর গোলাগুলির মধ্যে তাকে স্থানীয় একটা হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

সন্তানকে হারিয়ে এই মা–বাবাদের দৈনন্দিন জীবন আর আগের মতো নেই। সবকিছু এখন এলোমেলো। প্রিয় সন্তানের জন্য তাঁদের কোনো উপহার কেনা হয় না, প্রিয় খাবার রান্না করা হয় না, সন্তানকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়া হয় না।

যে তিনজনের কথা এখানে উল্লেখ করা হলো, তারা ছিল মা–বাবার একমাত্র সন্তান। জুলাই অভ্যুত্থানে গুলিতে শহীদ হয়েছে তারা। সন্তানকে হারিয়ে এই মা–বাবাদের দৈনন্দিন জীবন আর আগের মতো নেই। সবকিছু এখন এলোমেলো। প্রিয় সন্তানের জন্য তাঁদের কোনো উপহার কেনা হয় না, প্রিয় খাবার রান্না করা হয় না, সন্তানকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়া হয় না।

আজ মা দিবস এল তাঁদের জন্য হাহাকার আর শূন্যতা নিয়ে। একই কষ্ট বাবাদেরও। তাঁরাও আর বাবা ডাক শোনেন না। তবে মা দিবস উপলক্ষে এই প্রতিবেদনে আজ শুধু মায়েদের কথাই আনা হলো।

ডিসেম্বরের ২৪ তারিখ জন্ম। এমন এক ২৪ তারিখেই ও চলে গেল। এই যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছি না। রিয়ার এই ছবিটা লাল জামা পরা-মাথায় ব্যান্ড দেওয়া, ওটা ওর শেষ জন্মদিনের ছবি। বাসায় আয়োজন করেছিলাম। জন্মদিনে ওর খুব উচ্ছ্বাস থাকত, খুব আনন্দ করত। সারা দিন খেলত।
রিয়া গোপের মা

এই যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছি না

দীপক কুমার গোপ ও বিউটি ঘোষের একমাত্র সন্তান ছিল রিয়া গোপ। ১৯ জুলাই নারায়ণগঞ্জ সদরের নয়ামাটি এলাকায় চারতলা বাসার ছাদে খেলতে গিয়েছিল রিয়া। বাসার নিচে সংঘাত শুরু হলে বাবা ছাদ থেকে আনতে যান মেয়েকে। এ সময় বাবার কোলে গুলিবিদ্ধ হয় রিয়া। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় ২৪ জুলাই মারা যায় সে।

মা বিউটি ঘোষ এই প্রতিবেদকের সঙ্গে মুঠোফোনে যতক্ষণ কথা বলছিলেন, ততক্ষণই কাঁদছিলেন। বললেন, ‘ডিসেম্বরের ২৪ তারিখ জন্ম। এমন এক ২৪ তারিখেই ও চলে গেল। এই যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছি না। রিয়ার এই ছবিটা লাল জামা পরা-মাথায় ব্যান্ড দেওয়া, ওটা ওর শেষ জন্মদিনের ছবি। বাসায় আয়োজন করেছিলাম। জন্মদিনে ওর খুব উচ্ছ্বাস থাকত, খুব আনন্দ করত। সারা দিন খেলত।’

‘মেয়েটা ছিল কথার ফুলঝুরি। ওর গল্পে আমি মেতে থাকতাম, সবাইকে মাতিয়ে রাখত। আমাকে ডাকত মামমাম। আমার এখন অনেক যন্ত্রণা হয়। কতটা যন্ত্রণা, কাউকে বুঝিয়ে বলতে পারব না। আমি আর ওর বাবা প্রতিদিন রিয়ার কথা বলি আর কাঁদি। এই যন্ত্রণা নিতে পারছি না। আপনারা দোয়া করবেন প্লিজ, সৃষ্টিকর্তা যেন আমার গর্ভে রিয়াকে আবার ফিরিয়ে দেন। আমি অপেক্ষা করে আছি।’ বলছিলেন মা বিউটি ঘোষ।

ছেলেটাই ছিল আমার সব

মা ফারিয়া ইবনাতের সঙ্গে সাফকাত সামির

ফারিয়া ইবনাত ও সাকিবুর রহমান দম্পতির একমাত্র সন্তান ছিল সাফকাত সামির। মাদ্রাসায় পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ত। ঘটনার সময় ১৯ জুলাই বাবা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে কাজে ছিলেন।

গতকাল শনিবার রাজধানীর মিরপুর-১৪ নম্বরে সামিরদের ১৫/২৮ সরকারি স্টাফকোয়ার্টার ভবনের দোতলার ফ্ল্যাটে গিয়ে কথা হয় বাবা সাকিবুর রহমানের সঙ্গে। মা আশুলিয়ায় সামিরের নানার বাড়িতে ছিলেন। সামির সেখানেই সমাহিত।

সামিরের বাবা ঘরের জানালাটা দেখিয়ে বলেন, গত ১৯ জুলাই সন্ধ্যায় গোলাগুলি শুরু হলে সামিরের ছোট চাচা মশিউর জানালাটি বন্ধ করতে যান। সামির চাচার পেছন থেকে জানালার বাইরে দেখার চেষ্টা করছিল। তখনই জানালা দিয়ে বুলেট ঢুকে সামিরের চোখ ও মাথা ভেদ করে বেরিয়ে যায়। গুলিটা দেয়ালে যেখানে গিয়ে আঘাত করেছিল, সে জায়গাটা দেখালেন তিনি। হাতে গুলি লেগে আহত হন চাচা।

মুঠোফোনে সামিরের মা প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার মাত্র তিন দিন আগে সামির আশুলিয়া থেকে মিরপুর এসেছিল। ঘটনার দিন বিকেলে মা-ছেলে মিলে ফুচকা খেয়েছিলেন। ‘আমার ছেলেটাই আমার সব ছিল। যত আবদার আমার সঙ্গে। ছেলেকে হারিয়ে আমি মৃতপ্রায় জীবন যাপন করছি। মনে হচ্ছে, গুলিটা ওর গায়ে না লেগে আমার গায়ে লাগত! অথবা আমাদের দুজনের গায়ে একসঙ্গে লাগত! আমিও ছেলের সঙ্গে মরে যেতাম! তাহলে দিনের পর দিন এত কষ্ট নিয়ে আমাকে বাঁচতে হতো না।’ বলেন মা ফারিয়া।

‘আমাকে আর কেউ মা বলে ডাকে না’

গত ৪ আগস্ট রাজধানীর উত্তরার আজমপুরে রাজউক কমার্শিয়াল কমপ্লেক্সের সামনে ছররা গুলিতে (শটগান) নিহত হয় মাহিন। সামিরা জাহান ও জামিল হোসেন দম্পতির একমাত্র সন্তান ছিল মাহিন। দিয়াবাড়িতে থাকতেন তাঁরা। ছেলেকে হারিয়ে ২৩ বছর ঢাকায় থাকার পাট চুকিয়ে তাঁরা চলে গেছেন ময়মনসিংহ শহরের পুরোহিতপাড়ায় মাহিনের দাদাবাড়িতে।

মা সামিরা জাহান ছেলের কথা বলতে গিয়ে কান্না থামাতে পারছিলেন না। বললেন, ‘মাহিনের মৃত্যুর পর এক মাস ছিলাম দিয়াবাড়িতে। চারপাশে তাকাতে পারতাম না। প্রচণ্ড কষ্ট হতো। তাই এলাকা ছেড়ে চলে এসেছি।’

আমার ছেলেটাই আমার সব ছিল। যত আবদার আমার সঙ্গে। ছেলেকে হারিয়ে আমি মৃতপ্রায় জীবন যাপন করছি। মনে হচ্ছে, গুলিটা ওর গায়ে না লেগে আমার গায়ে লাগত!
সামিরের মা

কিন্তু এলাকা ছেড়ে এলেও কষ্ট যে কমেনি, তা তাঁর কথা থেকেই বোঝা গেল। ‘ছেলে ইলিশ, চিংড়ি পছন্দ করত। মাংস পছন্দ করত। ওর বাবা এত কষ্ট পায়, এসব খাবার আর কেনেই না। ওর পছন্দের কোনো খাবার আমরা আর রান্না করি না। আমাকে কেউ আর মা বলে ডাকে না।’ বললেন মা সামিরা।

মাহিন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির (এনআইইটি) প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিল। সংস্কৃতিমনা মাহিন যুক্ত ছিল খেলাঘর, গীতাঞ্জলি একাডেমি নামের সংগঠনের সঙ্গে। অভ্যুত্থানের শুরু থেকেই সে অংশ নেয়। মা আন্দোলনে যেতে বাধা দিত বলে ছেলে রেগে যেত। বলত, ‘আম্মু, আমার বড় ভাইরা মরে যাচ্ছে। তুমি যেতে দিতে চাও না কেন?’

ছেলের কথা বলতে গিয়ে থামতে পারছিলেন না মা সামিরা। ধূসর রঙের চোখ, বাদামি চুলের কারণে মাহিনকে অন্যদের চেয়ে আলাদা লাগত। ৬ ফুট লম্বা হওয়ার পর তিনি মজা করে বলতেন, ‘তোকে বড় মানুষ দেখায়। বিয়ে দিয়ে দেব।’ মা সামিরা বললেন, ‘জানেন, আমাকে কেউ মাহিনের মা বলে ডাকলে আমার কেমন আনন্দ হয়! মনে হয়, আমার ছেলে আছে। একটু পর হয়তো কোথা থেকে এসে আম্মু বলে ডেকে উঠবে।’