প্রথম আলো এক্সপ্লেইনার

দুই অ্যাপ বন্ধ করে কি শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগ ঠেকানো যাবে

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গত রোববার অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত কোর কমিটির বৈঠকে দুটি অ্যাপ বন্ধের বিষয়ে আলোচনা হয়। অ্যাপ দুটি হলো টেলিগ্রাম ও বোটিম।

বৈঠক সূত্র বলছে, সেখানে আলোচনা হয় যে এই দুই অ্যাপ ব্যবহার করে ভারতে অবস্থানরত দলের সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগ করে আওয়ামী লীগ (কার্যক্রম নিষিদ্ধ) নেতা–কর্মীরা।

ঝটিকা মিছিল থেকে গ্রেপ্তার নেতা–কর্মীদের মুঠোফোন যাচাই করে এ তথ্য পাওয়া গেছে বলে বৈঠকে তুলে ধরা হয়। এ কারণে রাতে অ্যাপ দুটির গতি কমিয়ে দেওয়া এবং জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর তা বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়।

প্রশ্ন হলো, ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগের কোনো অ্যাপ কি বন্ধ করা সম্ভব? সেটা কি কোনো কার্যকর পন্থা?

বিষয়টি নিয়ে তিনজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা বলেছেন, এটা হাস্যকর চিন্তা।

তথ্যপ্রযুক্তিবিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির প্রথম আলোকে বলেন, একটি দুটি বন্ধ করে লাভ কি, আরও শত শত অ্যাপ তো আছে।

কত অ্যাপ, ব্যবহারকারী কত

মুঠোফোনে যোগাযোগের জন্য কত অ্যাপ আছে, তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় অ্যাপ যেমন রয়েছে, তেমনি দেশ ও অঞ্চলে জনপ্রিয় বিভিন্ন অ্যাপ মুঠোফোনের অ্যাপস্টোরে রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অল্প কিছু মানুষ নিজেরা অ্যাপ তৈরি করে ব্যবহার করে।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক বিজনেস অব অ্যাপ নামের একটি ওয়েবসাইট অ্যাপ ব্যবসা সম্পর্কে নানা তথ্য প্রকাশ করে। তাদের হিসাবে, বিশ্বে যোগাযোগ অ্যাপের সংখ্যা লাখ লাখ। ২০২৪ সালে অ্যাপ ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪০০ কোটির কাছাকাছি।

জনপ্রিয়তায় এগিয়ে হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক মেসেঞ্জার, স্ন্যাপচ্যাট, টেলিগ্রাম, উইচ্যাট, লাইন, আইমেসেজ, ডিসকর্ড, সিগন্যাল, ভাইবার ও কাকাওটিভি, বলছে ওয়েবসাইটটি।

সিমিলিয়ারওয়েবের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় হোয়াটসঅ্যাপ। এর পরে রয়েছে টেলিগ্রাম, মেসেঞ্জার, ইমো, স্ন্যাপচ্যাট ইত্যাদি। বাংলাদেশে বোটিম তেমন জনপ্রিয় ছিল না। সিমিলিয়ারওয়েবে দেখা যাচ্ছে, বোটিম বাংলাদেশে জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে ৪৯ নম্বরে রয়েছে।

ঢাকায় গত বুধবার ঝটিকা মিছিল থেকে ২৪৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভা সূত্রে জানা যায়, তাঁদের মধ্যে দেড় শতাধিক ব্যক্তি দুটি অ্যাপ ব্যবহার করে শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন এবং বৈঠকে যোগ দিতেন।

সরকার আগামী ফেব্রুয়ারিতে পবিত্র রমজান মাস শুরুর আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের পরিকল্পনা করছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে আশঙ্কা করা হয় যে, ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সক্রিয় করা হচ্ছে। তফসিল ঘোষণার পর তাঁরা দেশকে অস্থিতিশীল করতে পারেন।

অ্যাপ বন্ধ করা কি সম্ভব

কোনো অ্যাপ কি বন্ধ করা সম্ভব, জানতে চাইলে সুমন আহমেদ সাবির বলেন, বন্ধ করা যায়। তবে তা কিছু মানুষের জন্য। অন্যরা নানা পদ্ধতি ব্যবহার করে অ্যাপগুলো ঠিকই ব্যবহার করতে পারবেন।

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সময় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যম ও অ্যাপ বন্ধ করে দিয়েছিল। ফলে অনেকে তা ব্যবহার করতে পারেনি। কিন্তু যারা জানে, তারা ঠিকই ভিপিএনের মাধ্যমে ফেসবুক ও অন্যান্য অ্যাপ ব্যবহার করেছে।

অ্যাপের গতি কি রাতে কমিয়ে দেওয়া সম্ভব, জানতে চাওয়া হয়েছিল সুমন আহমেদ সাবিরের কাছে। তিনি বলেন, অল্প ট্রাফিকের (সাধারণ অর্থে ব্যবহার) ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব হতে পারে। তবে বিপুল ট্রাফিকের ক্ষেত্রে সরকারি সংস্থাগুলোর কাছে এত সক্ষমতা নেই।

অ্যাপ কীভাবে বন্ধ করে তা জানতে চাওয়া হয়েছিল নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটির ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক রাজেশ পালিতের কাছে। তিনি বলেন, সরকার গুগলের কাছে অনুরোধ জানিয়ে অ্যাপ বন্ধের চেষ্টা করতে পারে। তবে গুগল তা শুনবে, সে নিশ্চয়তা নেই। এ ছাড়া আরেকটি উপায় মেসেজিং অ্যাপের সার্ভারের ইউআরএল বন্ধ করে দেওয়া। সেই সক্ষমতা সরকারের হাতে আছে।

অবশ্য এ ক্ষেত্রেও বিকল্প উপায় হলো ভিপিএন ব্যবহার। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী সরকার এসব কৌশলে ব্যর্থ হয়ে শেষে ইন্টারনেটই বন্ধ করে দিয়েছিল।

২০২৪ সালের ১৭ জুলাই রাত থেকে মোবাইল ইন্টারনেট ও ১৮ জুলাই রাত নয়টার দিকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। টানা পাঁচ দিন সব ধরনের ইন্টারনেট বন্ধ ছিল। মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ ছিল ১০ দিন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগমাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপের মতো সেবা বন্ধ ছিল ১৩ দিন।

‘সেবা বন্ধ করা সমাধান নয়’

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) হিসাবে, গত জুলাই শেষে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সাড়ে ১৩ কোটি। একজন মানুষ সর্বশেষ ৯০ দিনে একবার ইন্টারনেট ব্যবহার করলেই তাঁকে ব্যবহারকারী ধরা হয়। আর এক ব্যক্তি একাধিক ব্যবহারকারী হিসেবে গণ্য হতে পারেন।

শুধু যোগাযোগ বা বিনোদন নয়, ব্যবসা–বাণিজ্য, শিক্ষা, অফিস–আদালতের কার্যক্রম—সবকিছুই এখন ইন্টারনেটনির্ভর। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর বর্তমান সরকার কখনো ইন্টারনেট বন্ধ না করার ঘোষণা দিয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, অ্যাপ বন্ধ করে কোনো সমস্যার সমাধান পাওয়া যায় না। সফলতার উদাহরণ নেই। রাজনৈতিক ও আইনি সমস্যার রাজনৈতিক ও আইনি সমাধান খুঁজতে হবে। সেবা বন্ধ করা কোনো সমাধান নয়।

তিনি বলেন, অ্যাপ বন্ধ করতে গিয়ে কী হয়েছে, সেটার উদাহরণ তো নেপালেই দেখা গেছে।