উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও সংগঠিত সন্ত্রাসী হামলার শিকার হলো দেশের শীর্ষ সংবাদমাধ্যম প্রথম আলো। একই সঙ্গে হামলার শিকার হয়েছে শীর্ষ ইংরেজি সংবাদমাধ্যম দ্য ডেইলি স্টারও। গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে সন্ত্রাসীরা কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো ও কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউতে ডেইলি স্টার-এর কার্যালয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। পরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয় কার্যালয় দুটি।
হামলার শুরু হলে প্রথম আলোর সাংবাদিক ও কর্মীরা প্রাণ বাঁচাতে দ্রুত কার্যালয় ত্যাগ করেন। হামলার কারণে কার্যক্রম বিঘ্নিত হওয়ায় গতকাল শুক্রবারের প্রথম আলো প্রকাশিত হয়নি। প্রতিষ্ঠার ২৭ বছরে প্রথমবারের মতো সংবাদপত্রের ছুটি বাদে এক দিনের জন্য প্রথম আলোর প্রকাশনা বন্ধ থাকল। প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণের কার্যক্রম বন্ধ ছিল প্রায় ১৭ ঘণ্টা। ঢাকার বাইরে কুষ্টিয়া, খুলনা ও সিলেটে প্রথম আলো কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুর হয়েছে। চট্টগ্রাম, বগুড়া ও বরিশাল কার্যালয়েও হামলার চেষ্টা হয়েছে।
হামলার কারণে কার্যক্রম বিঘ্নিত হওয়ায় গতকাল শুক্রবারের প্রথম আলো প্রকাশিত হয়নি। প্রতিষ্ঠার ২৭ বছরে প্রথমবারের মতো সংবাদপত্রের ছুটি বাদে এক দিনের জন্য প্রথম আলোর প্রকাশনা বন্ধ থাকল।
পত্রিকা প্রকাশ করতে পারেনি ডেইলি স্টারও। তাদের অনলাইন সংস্করণের কার্যক্রমও দীর্ঘ সময় বন্ধ ছিল। ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষ বলছে, সংবাদপত্রের ছুটি ছাড়া ৩৩ বছরের ইতিহাসে তাদের প্রকাশনা বন্ধের ঘটনাও এই প্রথম। হামলার সময় ডেইলি স্টার–এর ২৮ জন সাংবাদিক ও কর্মী ছাদে আটকা পড়েছিলেন। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার ছাড়া ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন স্থাপনায় হামলার ঘটনা ঘটে।
আক্রান্ত হওয়ার পর গতকাল প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ও ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, প্রথম আলো সম্পাদক ও ডেইলি স্টার সম্পাদকের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আপনাদের প্রতিষ্ঠান ও সংবাদকর্মীদের ওপর এই অনাকাঙ্ক্ষিত ও ন্যক্কারজনক হামলা আমাকে গভীরভাবে ব্যথিত করেছে। আপনাদের এই দুঃসময়ে সরকার আপনাদের পাশে আছে।’
প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার-এ ভবয়াবহ হামলার ঘটনা বিবিসি, রয়টার্স, এএফপি, এপি, আল-জাজিরাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), গণসংহতি আন্দোলন, এবি পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে।
যুক্তরাজ্য, ইতালি, ফ্রান্স, কানাডা, ডেনমার্ক, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, সুইডেন ও সুইজারল্যান্ডের সমন্বয়ে গঠিত মিডিয়া ফ্রিডম কোয়ালিশন ইন বাংলাদেশ (এমএফসি), সম্পাদক পরিষদ, নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন (নোয়াব), ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি), আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), জাতীয় প্রেসক্লাব, সাংবাদিক ইউনিয়নসহ দেশের সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষার বৈশ্বিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসও (সিপিজে) উদ্বেগ জানিয়েছে।
প্রথম আলো কর্তৃপক্ষ বলেছে, এ কথা বিশ্বাস করার সংগত কারণ আছে যে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অগ্রভাগে থাকা ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদির দুঃখজনক হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে পুঁজি করে একটি স্বার্থান্বেষী মহল পরিকল্পিতভাবে এসব আক্রমণের ঘটনা ঘটিয়েছে। স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের জন্য এ ছিল একটি কালো দিন। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে শুধু আগামী নির্বাচনকে পথভ্রষ্ট করার চেষ্টাই চালানো হয়নি, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিক পরিসরে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করারও লক্ষ্য ছিল।
শরিফ ওসমান হাদিকে ১২ ডিসেম্বর রাজধানীর পুরানা পল্টনে গুলি করা হয়। তিনি সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার রাতে মৃত্যুবরণ করেন। হাদিকে গুলি করার ঘটনার প্রধান আসামি নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ফয়সাল করিম। পুলিশ সূত্র বলছে, তিনি ভারতে পালিয়ে গেছেন।
বৃহস্পতিবার রাত সোয়া ১১টার দিকে প্রথমে ৩০ থেকে ৩৫ জন হামলাকারী শাহবাগ থেকে মিছিল নিয়ে কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ের সামনে আসে। তারা হামলার চেষ্টা করলে পুলিশ বাধা দেয়। ব্যর্থ হয়ে তারা প্রথম আলো কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকে। তখন তাদের কেউ কেউ প্রথম আলো জ্বালিয়ে দেওয়া, প্রথম আলোর কাউকে পেলে আক্রমণ করাসহ নানা হুমকি দিতে থাকে। এ সময় তাদের কাউকে কাউকে ফোন করে কারওয়ান বাজারে আরও লোক আসার কথা বলতে শোনা যায়। হামলাকারীরা আশপাশে থাকা অনেকের মুঠোফোন তল্লাশি করে। কারওয়ান বাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ী ও হকারের ওপর চড়াও হয় তারা। দুজনকে মারধর করা হয়। পরে পুলিশ ও ব্যবসায়ীরা তাঁদের উদ্ধার করেন।
এভাবে চলে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা। একপর্যায়ে হামলাকারীরা কারওয়ান বাজার মেট্রোস্টেশনের নিচে সড়ক অবরোধ করে রাখে। এমন অবস্থায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও ইউটিউবে বিদেশে অবস্থানরত কয়েকজন ব্যক্তি প্রথম আলোতে আক্রমণের উসকানি দিতে থাকেন। উসকানির মধ্যেই আরেক দল হামলাকারী শাহবাগ থেকে প্রথম আলোর কার্যালয়ের সামনে আসে।
প্রথম আলো কর্তৃপক্ষ বলেছে, এ কথা বিশ্বাস করার সংগত কারণ আছে যে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অগ্রভাগে থাকা ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদির দুঃখজনক হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে পুঁজি করে একটি স্বার্থান্বেষী মহল পরিকল্পিতভাবে এসব আক্রমণের ঘটনা ঘটিয়েছে। স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের জন্য এ ছিল একটি কালো দিন। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে শুধু আগামী নির্বাচনকে পথভ্রষ্ট করার চেষ্টাই চালানো হয়নি, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিক পরিসরে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করারও লক্ষ্য ছিল।
রাত পৌনে ১২টার দিকে আগে থেকে অবস্থান নেওয়া এবং নতুন আসা হামলাকারীরা একসঙ্গে প্রথম আলো কার্যালয়ে হামলা শুরু করে। শুরুতে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে ভবনের কাচ ভাঙতে থাকে তারা। এরপর ভবনের প্রধান ফটকের ঝাপ বা শাটার ভাঙতে শুরু করে। একপর্যায়ে চারতলা ভবনটির শাটার ভেঙে ভেতরে ঢুকে ভাঙচুর করতে থাকে তারা। ভবনের সামনের কাচ ভেঙে সোফা, টেবিল ও চেয়ারসহ বিভিন্ন আসবাব, সরঞ্জাম ও সমস্ত নথিপত্র নিচে ফেলা হয় এবং সেগুলো একটি জায়গায় জড়ো করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
হামলাকারীরা প্রথম আলো কার্যালয় ও মূল্যবান সরঞ্জাম ভাঙচুর করেই থেমে থাকেনি; তারা ভবনের অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা পুরোপুরি নষ্ট করে দেয়। ভেঙে ফেলা হয় সিসিটিভি (ক্লোজড সার্কিট) ক্যামেরাও।
ভবনের বিভিন্ন তলা থেকে জিনিসপত্র যখন নিচে ফেলা হচ্ছিল, তখন কয়েকজন পুলিশ সদস্য ঘটনাস্থলে ছিলেন। কেউ কেউ ঘটনাস্থল থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। হামলাকারীদের সংখ্যা ছিল বেশি। তখন পর্যন্ত অন্য আর কোনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যকে প্রথম আলো কার্যালয়ের সামনে দেখা যায়নি। যদিও শাহবাগ থেকে মিছিলটি রওনা হওয়ার সময় প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এ বিষয়ে অবগত করা হয়েছিল।
হামলার সময় ভবনের প্রতিটি তলায় লুটপাট করতে থাকে হামলাকারীরা। দেড় শতাধিক কম্পিউটার ও ল্যাপটপ, টাকা রাখার একাধিক লকার, নগদ অর্থ এবং কর্মীদের ডেস্ক থেকে তাঁদের ব্যক্তিগত সরঞ্জামাদি লুট করে তারা। ভবনের নিচতলায় প্রথমা প্রকাশনের নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্র থেকে বইও নিয়ে যেতে দেখা যায় কাউকে কাউকে। ভবনটির প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় আর কিছুই অবশিষ্ট রাখা হয়নি।
লুটপাট চলাকালেই হামলাকারীরা ভবনের ভেতরে অগ্নিসংযোগ করে। আগুন দাউ দাউ করে জ্বলার সময় প্রথম আলোর সামনে উল্লাস করছিল হামলাকারীরা। রাত একটার দিকে আগুন তীব্র আকার ধারণ করে এবং পাশের ভবনগুলোতেও ছড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। ভবনের পাশে থাকা বিদ্যুতের সংযোগেও আগুন লেগে যায়। তখন প্রথম আলোর পক্ষ থেকে দফায় দফায় ফায়ার সার্ভিস ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তবে হামলাকারীদের বাধায় এবং সড়ক আটকে দেওয়ায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে আসতে পারছিলেন না।
প্রথম আলোর উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়া ফায়ার সার্ভিসের প্রথম ইউনিট কারওয়ান বাজার মেট্রোস্টেশনের নিচে আসে রাত পৌনে দুইটার দিকে। তখন একদল সন্ত্রাসী প্রথম আলোর সামনে থেকে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি লক্ষ্য করে হামলা করতে যায়।
আক্রমণের মুখে ফায়ার সার্ভিসের দুটি গাড়ি দ্রুত পেছনের দিকে যেতে থাকে।
একপর্যায়ে হামলাকারীদের একটি অংশ এবং শাহবাগের দিক থেকে নতুন করে আসা আরেকটি দল ডেইলি স্টার-এ আক্রমণে যোগ দিতে যায়। এ কারণে প্রথম আলোর সামনের উপস্থিতি কিছুটা কমে যায়। এই পরিস্থিতিতে রাত দুইটার দিকে সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি প্রথম আলোর সামনের সড়কটি ঘিরে ফেলে। পরে রাত আড়াইটার দিকে ফায়ার সার্ভিসের প্রথম ইউনিট আগুন নেভাতে শুরু করে।
ফায়ার সার্ভিস যখন আগুন নেভাতে কাজ শুরু করে, ততক্ষণে পার্শ্ববর্তী একটি ভবনের কিছু অংশে আগুন লেগে যায়। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের প্রচেষ্টায় তা নিভিয়ে ফেলা সম্ভব হয়। আগুন থেকে আশপাশের ভবনগুলো রক্ষা পায়। পরে ধীরে ধীরে প্রথম আলো কার্যালয়ের আগুনও নেভাতে সক্ষম হন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
আগুন নেভাতে গিয়ে দুই ফায়ারফাইটার বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে গুরুতর আহত হন। তাঁরা হলেন মো. আলমগীর ও মো. শফিউল আলম। পরে তাৎক্ষণিকভাবে তাঁদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
ফায়ার সার্ভিস যখন আগুন নেভাতে সক্ষম হয়, ততক্ষণে পুড়ে ছাই হয়ে যায় প্রথম আলো কার্যালয়। ভবনের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। আগুন নেভানোর পর ভেতরে ঢুকে দেখা যায়, ভেতরে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের জনপ্রিয় ওটিটি প্ল্যাটফর্ম চরকির কার্যালয়।
প্রথম আলো কর্তৃপক্ষ বলেছে, প্রথম আলো অফিস আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা যাওয়ায় এ ব্যাপারে নিরাপত্তা চেয়ে সরকারের উচ্চপর্যায় এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল।
স্বাধীন সাংবাদিকতার কারণে অতীতেও বিভিন্ন সরকারের সময় প্রথম আলোকে চাপে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২৩ সালের ১০ এপ্রিল জাতীয় সংসদে বলেছিলেন, ‘প্রথম আলো আওয়ামী লীগের শত্রু।
প্রথম আলো গণতন্ত্রের শত্রু।’ তবে প্রথম আলো আপস করেনি। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে গত বছরের নভেম্বরেও স্বার্থান্বেষী একটি গোষ্ঠী প্রথম আলোর সামনে বিশৃঙ্খলা ও হামলার চেষ্টা করে। এবার কার্যালয় পুড়িয়ে দেওয়া হলো।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বৃহস্পতিবার মধ্যরাতের পর শ দুয়েক হামলাকারী ডেইলি স্টার–এর প্রধান ফটক ভেঙে ভবনের নিচতলায় ঢুকে ভাঙচুর শুরু করে। একপর্যায়ে নিচতলায় থাকা আসবাব ও সংবাদপত্রের স্তূপে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। সেই আগুন ভবনের তৃতীয় তলা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। আগুন থেকে বাঁচতে ২৮ জন সাংবাদিক ও কর্মী ছাদে আশ্রয় নেন। ভবনের ভেতরে কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ায় দমবন্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়।
ডেইলি স্টার-এর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জায়মা ইসলাম রাত একটার দিকে ছাদ থেকে ফেসবুকে লেখেন, ‘আমি শ্বাস নিতে পারছি না। প্রচুর ধোঁয়া। আমি ভেতরে আটকা পড়েছি। আপনারা আমাকে মেরে ফেলছেন।’
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ডেইলি স্টার-এর কার্যালয়ে যখন ভাঙচুর, লুটপাট ও আগুন দেওয়া হয়, তখন ভবনটির সামনেই ছিলেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। তাঁদের সামনেই হামলাকারীরা ১২ তলা ভবনের প্রথম থেকে সাততলা পর্যন্ত উঠে ভাঙচুর চালায়। এ সময় কম্পিউটার, ক্যামেরাসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম লুট করা হয়। ক্যানটিনে রাখা খাবারের উপকরণও লুট করা হয়। ছিঁড়ে ফেলা হয় ডেইলি স্টার ভবনে টানিয়ে রাখা জুলাই শহীদ আবু সাঈদ ও মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধের ছবি।
আগুন দেওয়ার পর হামলাকারীরা ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি শুরুতে ডেইলি স্টার ভবনের কাছে যেতে বাধা দেয়। এতে আগুন নেভানো বিলম্বিত হয়।
ডেইলি স্টার এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘শাহবাগের ঘটনা এবং কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয় অভিমুখে একদল লোক আসার খবর পেয়ে ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষ সরকারের সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরে যোগাযোগ করে। তারা সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয় এবং ঘটনাস্থলে সহায়তা করে। তবে আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করেছি, সমন্বিত ও দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হলে ছাদে আটকে পড়া আমাদের সহকর্মীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা চরম অনিশ্চয়তা ও মৃত্যুভয়ে কাটাতে হতো না।’
হামলাকারীরা মধ্যরাত থেকে ভোর সাড়ে চারটার পর পর্যন্ত ডেইলি স্টার কার্যালয়ের সামনে অবস্থান করে। তারা ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোকে ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ বলে অপবাদ দেয়, যদিও এই অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে মনে করে সংবাদমাধ্যম দুটি। কারণ, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সবচেয়ে চাপে ছিল এই দুই পত্রিকা। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পত্রিকা দুটি নিষিদ্ধ ছিল।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাত তিনটার দিকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা উঁচু ভবন থেকে উদ্ধারের জন্য ব্যবহৃত মই (ল্যাডার) দিয়ে ডেইলি স্টার ভবনের ছাদ থেকে কর্মীদের নিচে নামিয়ে আনার চেষ্টা করেন। হামলাকারীরা এ সময় নানা ধরনের স্লোগান ও সাংবাদিক-কর্মীদের মারধরের হুমকি দেয়। তখন তাঁদের না নামিয়েই মই সরিয়ে নেওয়া হয়।
পুলিশ, সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা হামলাকারীদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন। তবে তারা নিবৃত্ত হয়নি। খবর পেয়ে রাত তিনটার দিকে সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ-এর সম্পাদক নূরুল কবীর ডেইলি স্টার কার্যালয়ের সামনে যান। এ সময় হামলাকারীরা নূরুল কবীরকে ‘আওয়ামী লীগের দালাল’ অপবাদ দিয়ে শারীরিকভাবে হেনস্তা করে। পরে সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যরা তাঁকে সরিয়ে নেন।
রাত সাড়ে তিনটার দিকে আটকে পড়া সাংবাদিক-কর্মীদের উদ্ধারে ডেইলি স্টার-এর সামনে যান আলোকচিত্রী ও মানবাধিকারকর্মী শহিদুল আলম, অন্তর্বর্তী সরকার থেকে পদত্যাগ করা উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এবং দলটির কেন্দ্রীয় নেতা নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, সামান্তা শারমিন, নাহিদা সারোয়ার, মনিরা শারমিন ও আরিফুর রহমান তুহিন। তাঁরা হামলাকারীদের সহিংসতা পরিহার করে সরে যাওয়ার আহ্বান জানান। তাঁদের উপস্থিতিতে ভোর সাড়ে চারটার পর আটকে পড়া সাংবাদিক-কর্মীদের নিচে নামিয়ে আনা হয় এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় সরিয়ে নেওয়া হয়। এ সময় দুজন নারী কর্মীকে হেনস্তার চেষ্টা করে হামলাকারীরা।
ডেইলি স্টার জানিয়েছে, ধোঁয়ায় দমবন্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলেও ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর প্রচেষ্টায় কেউ সাংবাদিক-কর্মীদের হতাহত হননি এবং সবাই নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পেরেছেন। তবে তাঁদের কার্যালয়ের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
ডেইলি স্টার-এর মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান মাহমুদুল হাসান খানকে উদ্ধৃত করে সংবাদমাধ্যমটির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, হামলাকারীরা নিচতলা থেকে দোতলা পর্যন্ত প্রায় সবকিছু পুড়িয়ে ও ভেঙে দিয়েছে। ভবনের বিভিন্ন তলায় থাকা কম্পিউটার, টেবিল, চেয়ার, সোফা, ক্যামেরার লেন্সসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম ভাঙচুর করা হয়েছে।
ঘটনার পর গতকাল বিকেল চারটার দিকে ‘অটুট মনোবলে এগিয়ে যাবে দ্য ডেইলি স্টার’ শিরোনামে একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয় সংবাদমাধ্যমটির ওয়েবসাইটে। এতে বলা হয়, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম অগ্রসেনানী শরিফ ওসমান হাদির অকালমৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো, একটি বিশেষ গোষ্ঠী এই জনরোষকে কাজে লাগিয়ে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পক্ষে থাকা পত্রিকা দুটির (প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার) বিরুদ্ধে সহিংসতায় উসকানি দিয়েছে। আসন্ন নির্বাচন বানচাল করতে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির আরেকটি অপচেষ্টা বলে আমরা একে মনে করছি।’