পুলিশের তাক করা অস্ত্রের সামনে বুক পেতে দাঁড়িয়ে ছিলেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ
পুলিশের তাক করা অস্ত্রের সামনে বুক পেতে দাঁড়িয়ে ছিলেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ

বছর পেরিয়ে জুলাই

সমতার স্বপ্নের জন্য শহীদ

রৌদ্রদীপ্ত বিকেল। কোটা সংস্কারের দাবির ব্যানার নিয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মিডিয়া চত্বরে দাঁড়িয়ে আছেন কিছু শিক্ষার্থী। হঠাৎ সামনে থেকে ক্যাপ, চশমা ও চেক শার্ট পরা একজন তরুণ এগিয়ে এলেন। 

সামনে গিয়ে হাত বাড়িয়ে পরিচিত হলাম সেই তরুণের সঙ্গে। বয়সে বড়, তাই সম্মোধন করলাম ভাই বলে। তিনি রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ।

আবু সাঈদ ভাই বললেন, ‘এই অন্যায্য বৈষম্য মেনে নেওয়া যায় না। বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমিও কথা বলতে চাই।’ সেদিন থেকে মিছিলের সামনে এসে তিনি বক্তৃতা দিতেন। বলতেন ন্যায্যতার কথা, অধিকারের কথা। দিন শেষে ক্লান্ত শরীর নিয়ে আন্দোলনের কর্মকাণ্ড শেষে সংগঠকদের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ফটকের সামনে পার্কের মোড়ে বসে ভাবতাম, আমরা কি পারব এই আন্দোলনে বিজয়ী হতে? আবু সাঈদ ভাই খুব প্রত্যয়ের সঙ্গে বলতেন, ‘পারব, ভয় নাই।’

একদিন চা খেতে খেতে অনেক কথা হলো তাঁর সঙ্গে। আগে তিনি এ রকম কোনো কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেননি। কোটা বৈষম্য মেনে নিতে না পারায় তাঁর এই সম্পৃক্ততা। তখনই জেনেছিলাম, তাঁর কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই।

৩ জুলাই। এখনো স্পষ্ট মনে আছে, মিছিলের উদ্দেশ্যে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে জড়ো হচ্ছিলাম। টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে। আবু সাঈদ ভাই এলেন। প্ল্যাকার্ড নিলেন। তাতে রংতুলিতে লিখলেন সুযোগের সমতার কথা। এরপর সবাইকে সঙ্গে নিয়ে মিছিলের একেবারে সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। শুরু করলেন সেদিনের কর্মসূচি। নিজেই স্লোগান ধরলেন। মিছিল শেষে ক্যাম্পাসের তৎকালীন নির্মাণাধীন গেটে (বর্তমানে ‘শহীদ আবু সাঈদ গেট’) তাঁর বক্তৃতা আমাদের দারুণ উজ্জীবিত করেছিল।

আন্দোলন নিয়ে বিকেলে যখন আমরা কোনো মিটিং করতাম, হঠাৎ আবু সাঈদ ভাই উঠে চলে যেতেন। একদিন জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই, প্রতিদিন বিকেলে কোথায় যান?’ বললেন, ‘টিউশন করাতে, এই টিউশন আমাকে ভাত দেয়।’ কথাটা মনে খুব দাগ কেটেছিল। সন্ধ্যায় টিউশন শেষ করে এসে পার্কের মোড় মসজিদে মাগরিবের নামাজ পড়ে তিনি আমাকে ফোন করতেন। নিচে গিয়ে চা খেতে খেতে কথা হতো পরের দিনের কর্মসূচি নিয়ে। তাঁর অদম্য চিন্তা আর স্পষ্ট প্রতিবাদের আমি সাক্ষী। একটা কথা তিনি সব সময় বলতেন, ‘ভয় পেয়ে কী হবে?’ তাঁর সাহস আমাদের মনেও অদম্য সাহস সঞ্চার করত।

শহীদ আবু সাঈদ চত্বর

৬ জুলাই ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়েছিল। আবু সাঈদ ভাই নেতৃত্ব দিয়ে সেদিনের মিছিল এগিয়ে নিয়ে গেছেন সামনের দিকে। আমাদের মিছিল পৌঁছে গিয়েছিল মডার্ন মোড়ে। সেখানে দেখেছি, কী দায়িত্ব নিয়ে তিনি অ্যাম্বুলেন্সগুলো পার করে দিচ্ছেন। কর্মসূচি শেষে ক্লান্ত ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে পার্কের মোড়ে সেদিনের আন্দোলন নিয়ে কথা হলো। টিউশনের বেতন থেকে দুই শ টাকা তিনি আমার হাতে গুঁজে দিলেন পরের দিনের ব্যানার বানাতে।

১১ জুলাই সকালে লাল টি-শার্ট আর চশমা পরে আবু সাঈদ ভাইসহ আমরা একত্র হয়েছি। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী সদস্যরা কোনোভাবেই আমাদের কর্মসূচি পালন করতে দেবে না। সেদিন দেখেছি আবু সাঈদ ভাইয়ের সাহস। তাদের হুমকির তোয়াক্কা মোটেই না করে তিনি ওই দিনের আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেদিন মিছিলে তাঁর ওপর নির্যাতন চালানো হয়। তাঁকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। তারা আমাদের নানাভাবে অপবাদ দিল, তকমা দিল। আবু সাঈদ ভাই আমাকে বললেন, ‘আমরা কি রাজাকার? আমরা কি শিবির? আমরা কি ছাত্রদল?’ এরপর স্লোগান তুললেন, ‘কোটা না মেধা?/ মেধা, মেধা’, ‘আমাদের সংগ্রাম/ চলছেই চলবে’, ‘আপস না সংগ্রাম?/ সংগ্রাম, সংগ্রাম’, ‘দালালি না রাজপথ?/ রাজপথ, রাজপথ’।

সারা দিনের মিছিলের ক্লান্তি পার হয়ে জীবিকার তাগিদে ১২ জুলাই আবু সাঈদ ভাই অংশ নিলেন বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায়। পবিত্র জুমার নামাজ পড়ে আবারও মিছিল। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হামলার প্রতিবাদ জানালেন। সেদিন তিনি পাঞ্জাবি পরেছিলেন। স্বাধীনতা স্মারকে দাঁড়িয়ে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বললেন, ‘কারা আছ, যারা এই আন্দোলনের সামনের সারিতে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে পারবে?’

তখনো বুঝে উঠতে পারিনি কতটা সততা আর সাহস নিয়ে আবু সাঈদ ভাই কথাটি বলেছিলেন। এর প্রমাণ তিনি দিয়ে গেলেন ১৬ জুলাই। শিক্ষার্থীদের সেদিন বেধড়ক পিটিয়ে আর গুলি করে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হচ্ছিল। তিনি দুপাশ থেকে দুহাতে সবাইকে আহ্বান করলেন মিছিলে। একপর্যায়ে তিনি ক্যাম্পাসের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। দুই হাত প্রসারিত করে আহ্বান করলেন শিক্ষার্থীদের। ডানা মেলা পাখির মতো ভঙ্গি করা অবস্থায় আবু সাঈদকে নির্মমভাবে গুলি করল পুলিশ। তিনি হয়তো কল্পনাও করতে পারেননি, তাঁর ক্যাম্পাসের সামনেই এভাবে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হবে।

মৃত্যুর পর শহীদ আবু সাঈদের স্নাতকের ফল প্রকাশিত হলো। দেখা গেল, তিনি ১৪তম স্থান অধিকার করে প্রথম শ্রেণি (সিজিপিএ ৩.৩০) পেয়েছেন। আন্দোলনের সময় নির্যাতন–নিপীড়নের মধ্যেও তিনি শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় পাস করলেন। আমরা শুধু একজন তরুণ সহযোদ্ধাকেই হারাইনি, হারিয়েছি এক মেধাবী শিক্ষার্থীকে।

শহীদ আবু সাঈদ এখন এক প্রতিবাদের প্রতীক। ন্যায্যতার প্রশ্নে মানুষ আবার কখনো রাজপথে নামলে শহীদ আবু সাঈদ হবেন আমাদের প্রেরণা।

শহিদ আবু সাঈদ ফটকের পাশে গড়ে তোলা হয়েছে শহিদ আবু সাঈদ স্ট্রিট মেমোরি স্টাম্প

এই আন্দোলনের আশু লক্ষ্য ছিল শেখ হাসিনার পতন। তবে তাঁর পতনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনে এমন আকাঙ্ক্ষারও উন্মেষ ঘটেছিল যে এমন একটি রাষ্ট্র চাই যেখানে আর কখনো কোনো কর্তৃত্ববাদী শাসক ফিরে আসতে পারবে না, বৈষম্য থাকবে না; যেখানে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হবে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে, পরিপূর্ণ নাগরিক অধিকার থাকবে; প্রতিষ্ঠা পাবে সাম্য, মানবিক মূল্যবোধ ও সামাজিক ন্যায়বিচার। কিন্তু গণ–অভ্যুত্থানের পরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে এখনই মানুষ দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে পড়ে গেছে। চাঁদাবাজি, মামলা–বাণিজ্য আর ছিনতাইয়ের ঘটনায় মানুষ অতিষ্ঠ।

২০২৪–এর গণ–অভ্যুত্থানের বিপুল অংশজুড়ে ছিল শিক্ষার্থীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ। সরকার সেই শিক্ষার্থীদের জন্য কী করল? শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে সরকার একটা ‘শিক্ষা সংস্কার কমিশন’ও গঠন করল না। ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের সুচিকিৎসা এবং যথাযথ কর্মসংস্থান এখনো পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি।

নানা হতাশার মধ্যেও মানুষের ওপর চেপে বসা স্বৈরতান্ত্রিক একটি সরকারের বিদায় গণ–অভ্যুত্থানের বড় অর্জন। আজ যে মানুষ রাষ্ট্র আর সরকার নিয়ে খোলামেলা কথা বলছে, গণ–অভ্যুত্থান না হলে তো এতসব আকাঙ্ক্ষার কথা মানুষ বলতেও পারত না। মানুষ এখন দেশ নিয়ে যেসব স্বপ্ন দেখছে, সেই স্বপ্নের পেছনে আছেন আবু সাঈদ ভাইয়ের মতো অসংখ্য শহীদ।


শামসুর রহমান

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সমন্বয়ক