
নদীর দখল-দূষণ বন্ধে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য আশানুরূপ নয়। তবে বিগত সরকারগুলোর তুলনায় নদী রক্ষায় অন্তর্বর্তী সরকার নিঃসন্দেহে এগিয়ে আছে। নদী রক্ষায় সব মন্ত্রণালয়কে যুক্ত করতে হবে। একটি মন্ত্রণালয় দিয়ে নদী রক্ষা সম্ভব হবে না।
আজ রোববার রাজধানীর সিরডাপে অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি) আয়োজিত ‘নদী, হাওর, বন, কৃষিজমি ও পাহাড়: পরিবেশ সুরক্ষায় আমাদের করণীয়’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বক্তারা এ কথা বলেন।
আলোচনায় অংশ নিয়ে লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, পরিবেশ ও উন্নয়ন নিয়ে একটা বাইনারি (বিভাজনমূলক দ্বিকেন্দ্রিক বিন্যাস) তৈরি করা হয়েছে। অথচ জুলাইয়ের চেতনা হচ্ছে এ বাইনারির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। উন্নয়ন কখনো প্রকৃতিকে অবজ্ঞা করে হতে পারে না। উন্নয়ন সেটিই, যেটি প্রকৃতি-পরিবেশকে সুরক্ষা দেয়।
পাভেল পার্থ বলেন, বাংলাদেশ পৃথিবীতে ইন্দো-বার্মা বায়োডাইভার্সিটি হটস্পটের অংশ, যা প্রমাণ করে এখানকার জীববৈচিত্র্যের অপরিসীম গুরুত্ব। তাই সব বনের ১৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাণিজ্যিক স্থাপনা নিষিদ্ধ করতে হবে।
পাভেল পার্থ আরও বলেন, ‘আমাদের নদীগুলোকে বাঁচাতে হলে প্রতিটি মন্ত্রণালয়কে যুক্ত করতে হবে। শুধু একটা মন্ত্রণালয় দিয়ে নদী রক্ষা হবে না। পাশাপাশি আন্তমন্ত্রণালয় সমন্বয় জোরদার করতে হবে।’
এর উদাহরণ হিসেবে বননির্ভর জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায় প্রয়োজনে বন অধিকার আইন করা এবং বন ও পাহাড় রক্ষায় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর লোকায়ত জ্ঞানকে রাষ্ট্রের পরিবেশ সংরক্ষণ নীতির অংশ করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন পাভেল পার্থ।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী তাসলিমা ইসলাম বলেন, ‘নদীসহ সামগ্রিক পরিবেশ রক্ষায় রাজনৈতিক সদিচ্ছা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আইন মানার ক্ষেত্রে বৈশ্বিক সূচকে আমাদের অবস্থান হলো ১৪২টি দেশের মধ্যে ১২৭। আর পরিবেশ রক্ষার সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৯তম অবস্থান।’ আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, যে হারে দখল-দূষণ হচ্ছে, তাতে সামনের সময়ে এসব সূচকে বাংলাদেশের অস্তিত্বই থাকবে না। বাংলাদেশে নদীর ক্ষেত্রে সমস্যা হলো দখল, দূষণ, বালু ও পাথর উত্তোলন। দেশের কোনো আইনেই নদীকে নদী হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি।
কোনো কোনো আইনে নদীকে জলাশয় হিসেবে দেখানো হয়েছে মন্তব্য করে তাসলিমা ইসলাম বলেন, দেশে ১৫টি আইন আছে, যা নদীকেন্দ্রিক। এ ছাড়া আদালতের নির্দেশনা আছে। এসব আইন ও আদালতের নির্দেশনার বাস্তবায়ন হবে, সে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তিনি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো সুফিয়া খানম বলেন, পৃথিবীতে যে ১০টি নদী ভয়াবহ প্লাস্টিক দূষণের শিকার, সেগুলোর মধ্যে ৮টি হচ্ছে এশিয়ায়। ভাটির দেশ হিসেবে এ দেশের নদীতে ওই প্লাস্টিক দূষণ এসে জমা হচ্ছে। আঞ্চলিক সংলাপের মাধ্যমে বাংলাদেশ এ নিয়ে উদ্বেগ তুলে ধরতে পারে।
সুফিয়া খানম সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে ভারতীয় বিদ্যুৎকেন্দ্রের ‘ফ্লাই অ্যাশবাহী’ জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ২২ কোটি ৪৪ লাখ টন ‘ফ্লাই অ্যাশ’ এসেছে ভারত থেকে। এগুলো পরিবহন করতে গিয়ে সুন্দরবনের ভেতরে নিয়মিত দুর্ঘটনা হচ্ছে। তিনি সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে এসব জাহাজ চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আরোপের আহ্বান জানান।
সভা পরিচালনা করেন বেসরকারি সংস্থা ‘নিজেরা করি’র সমন্বয়ক খুশী কবির। তিনি বলেন, অপরিকল্পিত উন্নয়নে প্রকৃতির যে অপরিসীম ক্ষতি হয়েছে তা নয়, এর সঙ্গে মানুষ ও তার জীবন-জীবিকাও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। তিনি বিদ্যমান আইন, নীতিমালা বাস্তবায়নে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
সভায় সারা দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিরা যোগ দিয়ে সংশ্লিষ্ট জেলার নদ-নদী, বন, হাওর-জলাশয়ের অবস্থা তুলে ধরেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা।