এপির পূর্ব এশীয় ব্যুরোর সাবেক প্রধান এবং এফসিসিজের সাবেক প্রেসিডেন্ট কায আবিকোর কাছ থেকে পুষ্পস্তবক গ্রহণ করছেন মনজুরুল হক
এপির পূর্ব এশীয় ব্যুরোর সাবেক প্রধান এবং এফসিসিজের সাবেক প্রেসিডেন্ট কায আবিকোর কাছ থেকে পুষ্পস্তবক গ্রহণ করছেন মনজুরুল হক

টোকিওতে বিদেশি সাংবাদিকদের সংবর্ধনায় সিক্ত প্রথম আলোর মনজুরুল হক

জাপানের রাজধানী টোকিওতে কর্মরত বিদেশি সাংবাদিকদের সংবর্ধনায় সিক্ত হলেন প্রথম আলোর টোকিও ব্যুরো চিফ মনজুরুল হক। সম্প্রতি জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর হাত থেকে তাঁর বিশেষ সম্মাননাপ্রাপ্তি উদ্‌যাপন উপলক্ষে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রশংসাপত্রকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে জাপানের সম্পর্কোন্নয়নে অবদানের জন্য বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং সংগঠনকে দেওয়া মর্যাদাপূর্ণ স্বীকৃতি হিসেবে দেখা হয়। প্রতিবছর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই সম্মাননার জন্য কিছু ব্যক্তি ও সংস্থার নাম ঘোষণা করে, যেটি মূলত আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অসামান্য সাফল্যের জন্য জাপানের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি।

তারই ধারাবাহিকতায় এ বছরও কিছু নির্বাচিত ব্যক্তি ও সংগঠন এই সম্মানে ভূষিত হয়েছে। সম্মাননাপ্রাপ্তদের মধ্যে জাপানে অবস্থানরত ব্যক্তিরা ৫ সেপ্টেম্বর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিথি ভবন ইকুরা হাউসে আয়োজিত এক বিশেষ অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইওয়াইয়া তাকেশির হাত থেকে এই সনদ গ্রহণ করেন।

এর আগে অনেক সময় গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বরা এই মর্যাদাপূর্ণ স্বীকৃতির জন্য নির্বাচিত হলেও জাপানে কর্মরত কোনো বিদেশি সংবাদদাতার স্থান কখনোই এই তালিকায় হয়নি। তবে জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বছর সেই ধারার ইতি টেনে বাংলাদেশের শীর্ষ জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোর টোকিও ব্যুরো প্রধানকে সম্মাননার জন্য বেছে নিয়েছে।

১৯৯৮ সালে প্রথম আলো প্রকাশিত হওয়ার সময় থেকেই জাপান প্রতিনিধির ভূমিকা পালন করে এসেছেন মনজুরুল হক। সংবাদ সংগ্রহের সূত্রে জাপানের ৪৭টি জেলাতেই ভ্রমণের অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। সেই সুবাদে সম্রাট থেকে শুরু করে দেশের নেতৃস্থানীয় রাজনীতিবিদ, শিল্প, সংস্কৃতি ও চলচ্চিত্রের পরিচিত ব্যক্তিত্ব, হিরোশিমা-নাগাসাকির আণবিক বোমা হামলায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া হিবাকুশা নামে পরিচিত প্রজন্মের লোকজন ছাড়াও একেবারে সাধারণ মানুষজনের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছে।

জাপানের বিভিন্ন পেশার মানুষদের নিয়ে মনজুরুল হকের পাঠানো বিভিন্ন সংবাদ ও প্রতিবেদন প্রথম আলোয় নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়েছে। পাশাপাশি সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতার আলোকে জাপান নিয়ে একাধিক বইও তিনি লিখেছেন। এ সবকিছুই বাংলাদেশের পাঠকদের মধ্যে সূর্যোদয়ের দেশ হিসেবে পরিচিত জাপান সম্পর্কে জানা–বোঝার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে।

জাপানে দীর্ঘ তিন দশক ধরে এই সাংবাদিকতার সুবাদে মনজুরুল হক জাপানের বিদেশি সাংবাদিকদের ক্লাব এফসিসিজে সদস্যদের মধ্যে একজন সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। তিনি অতীতে এই মর্যাদাপূর্ণ ক্লাবের নির্বাচিত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং পরিচালনা পর্ষদের সদস্য থেকে শুরু করে বিভিন্ন বোর্ড পদে নির্বাচিত হয়েছেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকে সম্মাননা অর্জনের জন্য তাঁকে নির্বাচিত করা এফসিসিজের জন্যও সম্মানের। তাই ক্লাবের দোরগোড়ায় এই মর্যাদা ও স্বীকৃতি পৌঁছে দেওয়ার জন্য তাঁকে অভিনন্দন জানানোর সুযোগটি হাতছাড়া করতে চাননি জাপানে কর্মরত বিদেশি সাংবাদিকেরা।

মনজুরুল হকের এই অর্জনকে উদ্‌যাপন করার জন্য ২৭ সেপ্টেম্বর শনিবার বিকেলে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে এফসিসিজে। এতে যোগ দেন ক্লাবের নতুন-পুরোনো সদস্য, সাবেক সভাপতি, এনএইচকে বাংলা বিভাগের প্রধান ও অন্যান্য কর্মকর্তা, জাপান ফরেন প্রেস সেন্টারের প্রেসিডেন্ট, জাপান বহির্বাণিজ্য সংস্থা, জেট্রোর শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাসহ আরও অনেকে।

মনজুরুল হককে সম্মাননা জানানোর এই সুযোগ হারাতে চাননি টোকিওর বাইরের বিশিষ্টজনেরাও। তাঁকে অভিনন্দন জানাতে সুদূর তোকুশিমা জেলা থেকে ছুটে এসেছেন তোকুশিমা শিল্প জাদুঘরের প্রধান তানাকা সুসাকু এবং যাদুঘরের অন্য এক শীর্ষ কর্মকর্তা আসাই চিয়েকো।

সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন প্রথম আলোর টোকিও ব্যুরো চিফ মনজুরুল হক। জাপান, টোকিও

ফুলেল শুভেচ্ছা পাঠিয়েছেন প্রবীণ ফরাসি সাংবাদিক জোয়েল লুজন ও তাঁর স্ত্রী কোইযুমি কাযুকো। জোয়েল কয়েক বছর ধরে দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী থাকায় মনজুরুল হককে এই শুভেচ্ছা আবেগপ্রবণ ও অশ্রুসিক্ত করে তুলেছিল। ফরাসি এই সাংবাদিকের সঙ্গে কিছুদিন আগে পর্যন্ত জাপানে অনেক স্মৃতি তিনি ভাগাভাগি করে নিয়েছেন।

ক্লাবের সাবেক প্রেসিডেন্ট শ্রীলঙ্কার সাংবাদিক সুভেন্দ্রিনি কাকুচির সঞ্চালনায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন জাপানের সাবেক শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিক এবং জাপান ফরেন প্রেস সেন্টার এফপিসিজের প্রেসিডেন্ট কাযুও কোদামা। তিন দশক ধরে লেখার মধ্য দিয়ে জাপানের নানা জানা-অজানা দিক বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে তুলে ধরার জন্য মনজুরুল হকের ভূয়সী প্রশংসা করেন তিনি। এর মাধ্যমে যে বাংলাদেশ এবং জাপানের সম্পর্ক আরও পোক্ত হয়েছে, সেটি উল্লেখ করে তিনি জাপানের পক্ষ থেকে তাঁর এ অবদানের জন্য বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানান।

ক্লাবের সাবেক সভাপতি ও বার্তা সংস্থা এপির পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক ব্যুরো প্রধান কায আবিকো সভাপতিসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে এফসিসিজেকে সুদৃঢ় ও কার্যকর নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য মনজুরুল হককে ধন্যবাদ জানান এবং সর্বশেষ এই অর্জনের জন্য অভিনন্দন জানান।

এরপর একে একে মনজুরুল হককে অভিনন্দন জানান বিশ্বখ্যাত সায়েন্স ম্যাগাজিনের পূর্ব এশিয়ার সাবেক ব্যুরো চিফ ডেনিস নর্মাইল, ফরাসি লা’এক্সপ্রেস পত্রিকার সাংবাদিক রেজিস আরনোউ, ডেনমার্কের সাংবাদিক কেন্ট ডাল, এনএইচকে বাংলা বিভাগের প্রধান মুরাকামি চিকাসহ অন্যান্য সহকর্মীরা, জাপান বহির্বাণিজ্য সংস্থা জেট্রোর এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট মুরাইয়ামা মাইয়ুমি, জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ফরেন প্রেস সেন্টারের স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের পরিচালক সুগাওয়ারা জুনইয়া এবং মিডিয়া রিলেশনস বিভাগের প্রধান সমন্বয়কারী আযুসা ইশিকাদো, ভারতীয় শিক্ষাবিদ বিবেক পিন্টো, বিশিষ্ট বাংলাদেশি চিত্রশিল্পী গিয়াসউদ্দিনসহ আরও অনেকে।

উপস্থিত অতিথিদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে আবেগপ্রবণ সাংবাদিক মনজুরুল হক বলেন, ‘আমি ৩০ বছর ধরে সারা জাপান চষে বেড়িয়েছি প্রথম আলোর পাঠকদের সামনে জাপানের বস্তুনিষ্ঠ চিত্র তুলে ধরার জন্য। এই কাজ আমাকে একদিকে যেমন আনন্দ দিয়েছে, অন্যদিকে নতুন অনেক বন্ধুর সন্ধান দিয়েছে, যাঁদের মধ্যে বড় একটা দলের আজ এখানে উপস্থিতি আমার জন্য বিশেষ তৃপ্তিদায়ক। পাশাপাশি ফরেন প্রেস সেন্টারের প্রেসিডেন্টসহ অন্য কয়েকজন কর্মকর্তার এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা হচ্ছে সার্বিকভাবে প্রথম আলো এবং পত্রিকায় কর্মরত আমার সব সহকর্মীর জন্য বিরল এক সম্মাননা। এই প্রাপ্তি আমাকে সাময়িক বাধা অতিক্রম করে সামনে আরও অনেক দূর অগ্রসর হওয়ার প্রেরণা দেবে। নিজেকে আমি যে বাংলাদেশি পরিচিতির পাশাপাশি এফসিসিজের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে দেখে থাকি, আজকের এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করার মধ্যে দিয়ে টোকিওর বিদেশি সাংবাদিকদের প্রেসক্লাব যেন সেই পরিচয়কে আবারও সত্যায়িত করল।’

টোকিওর অভিজাত মারুনুচি নিজুবাশি ভবনে এফসিসিজের এই সম্মেলনকক্ষ সাংবাদিক মনজুরুল হকের এই অভ্যর্থনা ঘিরে পরিণত হয় পুরোনো ও নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকদের এক মিলনমেলায়। আয়োজনে আপ্যায়নের ক্ষেত্রেও কিছুটা ভিন্নতা ছিল এবার। বিদেশি মেনুর পাশাপাশি তাতে যুক্ত হয়েছিল বাংলাদেশি খাবার, যার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন আমন্ত্রিত অতিথিরা। মনজুরুল হকের প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বিদেশিদের ক্লাবে বিনা মূল্যে দেশি এই খাবার সরবরাহ করেন জাপানে সবচেয়ে বড় বাংলাদেশি সুপার মার্কেট ‘বঙ্গবাজার’-এর স্বত্বাধিকারী বাদল চাকলাদার।