রাজধানীর মহাখালীতে এক অনুষ্ঠানে গবেষণার ফলাফল তুলে ধরা হয়। ঢাকা, ২৯ সেপ্টেম্বর
রাজধানীর মহাখালীতে এক অনুষ্ঠানে গবেষণার ফলাফল তুলে ধরা হয়। ঢাকা, ২৯ সেপ্টেম্বর

৬৫ শতাংশ পোশাককর্মী ১৮ বছরের আগে গর্ভধারণ করছেন: আইসিডিডিআরবির গবেষণা

পোশাকশিল্পে কর্মরত ৬৫ শতাংশ নারী শ্রমিক ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই গর্ভধারণ করছেন। এই নারীদের প্রতি তিনজনের একজন জীবনে অন্তত একবার অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের শিকার এবং প্রতি চারজনের একজনের গর্ভপাত বা মেনস্ট্রুয়াল রেগুলেশনের অভিজ্ঞতা রয়েছে।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) প্রকাশিত এক গবেষণার ফলাফলে এসব তথ্য উঠে এসেছে। আজ সোমবার রাজধানীর মহাখালীর সাসাকাওয়া মিলনায়তনে ২৪ মাস ধরে পরিচালিত এই গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করা হয়।

২০২২ সালের আগস্ট থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়। কড়াইল ও মিরপুর বস্তি এবং গাজীপুরের টঙ্গী বস্তিতে আইসিডিডিআরবির আরবান হেলথ অ্যান্ড ডেমোগ্রাফিক সার্ভেলেন্সের আওতাধীন এলাকায় এ গবেষণা চালানো হয়। বিষয়বস্তু ছিল পোশাকশিল্পে কর্মরত নারী শ্রমিকদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার।

সংশ্লিষ্টরা জানান, তৈরি পোশাক কারখানায় কর্মরত ১৫ থেকে ২৭ বছর বয়সী ৭৭৮ জন শ্রমিকের অংশগ্রহণে প্রতি ছয় মাস অন্তর জরিপের মাধ্যমে গবেষণাটি করা হয়। এতে দেখা যায়, পোশাকশিল্পে কর্মরত নারী শ্রমিকদের মধ্যে প্রতি তিনজন নারীর দুজনের বিয়ে হয়েছে ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই।

দীর্ঘমেয়াদি পরিবার পরিকল্পনায় সচেতনতা বেড়েছে

ফলাফলে দেখা যায়, গবেষণা জরিপ চলাকালে শুরুতে অংশগ্রহণকারী নারীদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতনতা ছিল ৪৯ শতাংশ। দুই বছর পর ফলোআপ করার সময় সচেতনতা বেড়ে ৭০ শতাংশ হয়। এ সময় জরুরি গর্ভনিরোধক বড়ি বা ট্যাবলেট সম্পর্কেও উল্লেখযোগ্য সচেতনতা বাড়ে।

শুরুতে ১৫ শতাংশ নারী এ সম্পর্কে জানতেন, যা পরে বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯ শতাংশ। একই সময়ে পরিবারে স্বামী–স্ত্রীর মতামতের প্রাধান্য দেওয়ার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব ৫৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

তৈরি পোশাকশিল্পে কর্মরত নারী শ্রমিকেরা ঘর ও কর্মস্থল দুই জায়গায় সহিংসতার শিকার হচ্ছেন বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। নারী শ্রমিকদের বিরুদ্ধে তাঁদের স্বামীর সহিংসতার হার ছিল অনেক বেশি। পাশাপাশি যৌন সহিংসতা ছাড়া অন্য সব ধরনের সহিংসতা গত দুই বছরে আরও বেড়েছে। এ সময় কর্মক্ষেত্রে মানসিক সহিংসতার হারও তাঁদের মধ্যে অনেক বেশি ছিল। গবেষণার শুরুতে প্রায় ৪৮ শতাংশ নারী পোশাক শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে মানসিক সহিংসতার শিকার হয়েছিলেন, যা দুই বছর পর বেড়ে দাঁড়ায় ৫৫ শতাংশে।

সহিংসতার শিকার নারীরা প্রায় কেউই আনুষ্ঠানিক সাহায্য চান না। শুরুতে ৩৫ শতাংশ নারী অনানুষ্ঠানিক (পরিবার বা বন্ধুদের কাছে) সাহায্য চেয়েছিলেন, দুই বছর পর এই হার কমে দাঁড়ায় ২১ শতাংশে।

কারখানায় যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা সীমিত

গবেষণায় উঠে এসেছে, বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোতে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে কিছু পরামর্শমূলক সেবা থাকলেও প্রয়োজনীয় সেবা সরবরাহ সীমিত। জরিপে অংশ নেওয়া শ্রমিকেরা যেসব কারখানায় কাজ করেন, সেগুলোর মধ্যে শুধু ২২ শতাংশ কারখানায় স্যানিটারি প্যাড পাওয়া যায়। মাত্র ১৪ শতাংশ কারখানায় পরিবার পরিকল্পনা সামগ্রী সরবরাহের তথ্য মিলেছে।

গবেষণাসংশ্লিষ্টরা জানান, কিশোরী গর্ভধারণের মূল কারণ বিশ্লেষণ করে তাঁরা দেখেছেন, নারী শ্রমিকদের মধ্যে যাঁরা অন্তত ৯ বছর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করেছেন এবং তুলনামূলক বেশি বয়সে বিয়ে করেছেন, তাঁদের কিশোরী বয়সে (১৫-১৯ বছর) গর্ভধারণের ঝুঁকি তুলনামূলক কম। আর যাঁরা সন্তান ধারণের আগেই গর্ভনিরোধক ব্যবহার শুরু করেছিলেন, তাঁদের কিশোরী বয়সে গর্ভধারণের ঝুঁকি ৪৭ শতাংশ কম পাওয়া গেছে।

অন্যদিকে স্বামীর দ্বারা সহিংসতার অভিজ্ঞতা থাকলে কিশোরী বয়সে গর্ভধারণের ঝুঁকি ২৬ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। গবেষণার তথ্য ব্যবহার করে গবেষকেরা দেখেছেন, স্বামীর সহিংসতা নারীর ক্ষমতায়নকে প্রভাবিত করে।

গবেষকেরা মনে করেন, নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বেশি থাকলে মানসিক ও যৌন সহিংসতা থেকে সুরক্ষা পাওয়া যায়। চলাচলে স্বাধীনতা থাকলেও শারীরিক সহিংসতার ঝুঁকি কমে।

সরকারি ক্লিনিকে সেবা দেওয়ার সময় পুনর্বিবেচনা করা উচিত

গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পপুলেশন কাউন্সিল বাংলাদেশের সাবেক পরিচালক উবাইদুর রব। তিনি বলেন, ‘নারীদের কর্মক্ষেত্র এখন কেবল গার্মেন্টেই সীমাবদ্ধ নেই। তবে যেখানেই কাজ করুক না কেন অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ কমাতে হবে। এ জন্য কর্মীদের জ্ঞান বৃদ্ধির বিকল্প নেই।’

উবাইদুর রব মনে করেন, এই গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য-প্রমাণ বাংলাদেশের পোশাকশিল্প খাতে কর্মরত নারী শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, অধিকার ও নিরাপত্তা উন্নয়নের লক্ষ্যে সঠিক নীতি ও কর্মসূচি প্রণয়নে সহায়ক হবে।

অনুষ্ঠানে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন–বিকেএমইএর যুগ্ম সম্পাদক ফারজানা শারমিন বলেন, সমাজব্যবস্থা পুরুষতান্ত্রিক হওয়ায় নারীদের জন্য ওয়ার্ক লাইফ ব্যালান্স ধরে রাখা বেশ কঠিন। গর্ভধারণের মতো বিষয়েও তাঁদের মতামতের তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এই পরিস্থিতিতে কর্মীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সরকার একটি সুদূরপ্রসারী ভূমিকা নিতে পারে। কর্মীদের কাছে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিগুলো সহজলভ্য করা এবং এই বিষয়ে তাঁদের জ্ঞান বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। অন্যদিকে সরকারি ক্লিনিকগুলোর সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত নির্দিষ্ট কার্যসময়ের কারণে কর্মরত নারীরা সেবা গ্রহণের সুযোগ পান না, যা পুনর্বিবেচনা করা উচিত।

মেরি স্টোপস বাংলাদেশের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ইয়াসমিন এইচ আহমেদ বলেন, নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে নারীরা এখনো দোকানে গিয়ে স্বল্পমেয়াদি জন্মবিরতিকরণ সামগ্রী ক্রয় করতে পারেন না। তাই গার্মেন্টগুলোতে কাউন্সেলিংয়ের পাশাপাশি সাধারণ জন্মবিরতিকরণ সামগ্রীগুলো নিশ্চিত করতে হবে।

প্রধান গবেষক রুচিরা তাবাসসুম নভেদ বলেন, ‘অর্থনৈতিক দিক থেকে তুলনামূলক এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পে কর্মরত নারীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অবস্থা অন্য নারীদের চেয়েও খারাপ। পরিস্থিতি উন্নয়নের নিয়ামকগুলো নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা দরকার। এ জন্য সরকার, উন্নয়ন সংস্থা ও অংশীদারদের সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে।’