কৃতী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সেলফি তুলছেন অভিনয় ও সংগীতশিল্পীরা। বাঁ থেকে তৌসিফ মাহবুব, জেফার রহমান, সাবিলা নূর, তাসনিয়া ফারিণ ও ইমরান মাহমুদুল। গতকাল ঢাকার আশুলিয়ায় ফ্যান্টাসি কিংডমে
কৃতী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সেলফি তুলছেন অভিনয় ও সংগীতশিল্পীরা। বাঁ থেকে তৌসিফ মাহবুব, জেফার রহমান, সাবিলা নূর, তাসনিয়া ফারিণ ও ইমরান মাহমুদুল। গতকাল ঢাকার আশুলিয়ায় ফ্যান্টাসি কিংডমে

ফ্যান্টাসি কিংডমে উৎসব

রোদঝলমল দিনে আনন্দের ফোয়ারা

ঝলমলে রোদের সকালে রোলারকোস্টারের সামনের লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল মাবিয়া তাবাসসুম। কামরুন নাহার হৃদি আর চন্দ্রিকা রহমান তার পেছনে। তারা তিন বন্ধু। অপেক্ষা করছিল ফ্যান্টাসি কিংডমের রোলারকোস্টারে ওঠার জন্য। ফ্যান্টাসি কিংডমে ঘোরাফেরা, রাইডে চড়ার আনন্দ তো আছেই, তার ওপর কলেজে ভর্তির আগে পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হওয়ায় মুহূর্তটা অন্য রকম।

‘স্বপ্ন দেখো জীবন গড়ো’ স্লোগান নিয়ে শিক্ষার ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ‘শিখো’র পৃষ্ঠপোষকতায় সারা দেশের ৬৪টি জেলায় প্রথম আলোর আয়োজনে চলছে জিপিএ-৫ উৎসব। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকার আশুলিয়ায় ফ্যান্টাসি কিংডমে প্রথম দিনের উৎসবে অংশগ্রহণের জন্য প্রায় ৯ হাজার শিক্ষার্থী নাম নিবন্ধন করেছিল। আজ বুধবার দ্বিতীয় দিনে ঢাকা, মানিকগঞ্জ ও গাজীপুর জেলার আরও ৯ হাজারের বেশি কৃতী শিক্ষার্থী অংশ নেবে।

গতকালের উৎসবে ঢাকার বনশ্রী ও জিগাতলা থেকে নিজেদের গাড়িতে চড়ে এসেছিল মাবিয়া ও তার বন্ধুরা। তিনজনই বেইলি রোডের ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের ইংরেজি ভার্সনের শিক্ষার্থী। তারা ভিকারুননিসা কলেজেই ভর্তি হবে। অনলাইনে নিবন্ধন হয়েছে, তবে কলেজে ভর্তি এখনো শুরু হয়নি।

মাবিয়া বলছিল, ‘রাস্তাটা ছিল ভয়ংকর।

একটু পর পর গর্ত। তার মধ্যে কাদাপানি। আসতে অনেক সময় লেগেছে, ভোগান্তি হয়েছে। তবে ফ্যান্টাসির ভেতর ঢোকার পর এখন অনেক আনন্দ...অনেক।’

টঙ্গীর মোড় থেকে আশুলিয়া হয়ে বাইপাইল পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কাজ চলছে। সে কারণে নিচের সড়কের অবস্থা হালচাষ দেওয়া ধানখেতের মতো। তার ওপর অনেক জায়গায় বৃষ্টির পানি জমে আছে। সেই পথ পাড়ি দিয়ে হাজার হাজার কৃতী শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকেরা সকাল থেকে আসতে শুরু করেন ফ্যান্টাসি কিংডমে।

কড়া রোদের মধ্যে সকাল থেকেই ফ্যান্টাসি কিংডমে যেন আনন্দের ফোয়ারা ছুটছিল। এমন খুশির দিনে রোদ-বৃষ্টির তোয়াক্কা করতে যাবে কে! মিরপুর ইসিবি থেকে ইশিকা বিনতে তৌহিদ এসেছিল বাবা ব্যবসায়ী তৌহিদ মোজাম্মেল হোসেন, মা তানজিলা সুলতানা আর ছোট ভাই ইরাদ বিন তৌহিদকে নিয়ে। বাসে করে তারা এসেছে পুরো পরিবার। ইশিকা বিএএফ শাহীন কলেজ থেকে বিজ্ঞানে জিপিএ-৫ পেয়েছে। পাঠ্যবইয়ের বাইরের বই পড়ার আগ্রহ আছে তার। প্রথমার স্টলে এসেছিল বই কিনতে। সেখানে কথা হলো। পরিবারের সবাই খুব খুশি। উৎসব উপলক্ষে এখানে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ ছাড়ে বই বিক্রি হচ্ছে।

মেয়ে জিনিয়া ইসলামকে নিয়ে মিরপুরের কাজীপাড়া থেকে এসেছিলেন নজরুল ইসলাম। কাজীপাড়ায় জিনিয়াস কেজি স্কুল নামের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে তাঁর। তিনি অধ্যক্ষ। বললেন, আয়োজনটি খুব ভালো। অনেক ছেলেমেয়ে এসেছে। তারা সবাই সমবয়সী, সমমনা। কলেজে যাওয়ার আগে ওরা এখানে একটা বড় পরিসরে মেলামেশার সুযোগ পাচ্ছে। এটা ওদের মনে একটা ভিন্ন ধরনের প্রভাব ফেলবে। ভবিষ্যতে এমন ভালো ফল করতে অনুপ্রেরণা দেবে।

শিক্ষার্থীরা সকালে এসে নিবন্ধন নম্বর দেখিয়ে ক্রেস্ট, সকালের নাশতা, দুপুরের খাবারের কুপন আর ভেতরে প্রবেশ ও রাইডের কুপন সংগ্রহ করেছে। এরপর মেতে ওঠে রাইডে চড়া, সহপাঠীদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি আর সেলফি তোলার আনন্দে।

আয়োজনটি পাওয়ার্ড বাই কনকা-গ্রি এবং সহযোগিতায় রয়েছে কনকর্ড গ্রুপ, ফ্রেশ, বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেড, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক পিএলসি, কোয়ালিটি গ্রুপ, প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি, অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইউসিএসআই ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ শাখা ক্যাম্পাস, আকিজ টেলিকম লিমিটেড, আম্বার আইটি লিমিটেড, এটিএন বাংলা ও প্রথম আলো বন্ধুসভা।

মঞ্চের অনুষ্ঠান

জাতীয় সংগীতের সুরে সুরে, দুপুরের খাবারের পর শুরু হয়েছিল উৎসবমঞ্চের জমজমাট অনুষ্ঠান। সঞ্চালক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হক সবাইকে আহ্বান জানালেন সম্প্রতি উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের স্মরণ ও শোক প্রকাশ করে এক মিনিট নীরবতা পালনের জন্য।

এরপর ছিল জিপিএ-৫ সংবর্ধনা উৎসবের মূল ভাবনা নিয়ে গান ‘হিপ হিপ হুররে/ পাখি হয়ে উড়রে/ আমরা সবাই জিপিএ ফাইভ’–এর সঙ্গে সোহাগ ড্যান্স ট্রুপের নৃত্য।

মঞ্চে এল কৃতী শিক্ষার্থীরা। সাভার ল্যাবরেটরি স্কুলের শেখ আসমা মালীহা, আদমজি ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলের তাসনিম আহমেদ, মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল ও কলেজের তাহিয়া বিনতে জাফর গান গেয়ে শোনায়।

শিক্ষার্থীদের পরিবেশনার পর প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফের পরিচালনায় অনুপ্রেরণাময় বক্তব্য নিয়ে মঞ্চে আসেন শিক্ষাবিদেরা। ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির উপাচার্য শামস রহমান শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের জন্য লক্ষ্য স্থির করে দ্রুত সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য কঠোর পরিশ্রম করার আহ্বান জানান।

অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. জাহাঙ্গীর আলম শিক্ষার্থীদের সততা, নিষ্ঠা ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে ভবিষ্যৎ জীবনের প্রস্তুতি নিতে উপদেশ দেন।

এরপর ‘লিচুর বাগানে’র গান আর নাচ নিয়ে মঞ্চে আসনে জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী সাবিলা নূর। তিনি তাণ্ডব সিনেমার জনপ্রিয় গান ‘লিচুর বাগানে’র সঙ্গে নৃত্যে পরিবেশন করেন।

অনুষ্ঠান সাজানো হয়েছিল গান, নৃত্যের ফাঁকে ফাঁকে বিশিষ্টজনের কথামালায়। নাচের পরে শিখোর প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও শাহীর চৌধুরী মঞ্চে এলেন শিখোর মেন্টর ও শিক্ষকদের নিয়ে। তিনি শিক্ষার্থীদের বলেন, ‘জীবনের প্রথম একটি ধাপে তোমরা সাফল্য অর্জন করেছ। সামনে অনেক পথ পড়ে আছে। বড় করে স্বপ্ন দেখতে হবে। সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। সময় নষ্ট করা যাবে না।’ তিনি শিক্ষার্থীদের মা–বাবাসহ অভিভাবকদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে বলেন।

এ পর্যায়ে ছিল উৎসবের সহযোগীদের বক্তব্য। কনকর্ড গ্রুপের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা (সিএমও) অনুপ কুমার সরকার, কনকা–গ্রির বিক্রয় ও বিপণন মহাব্যবস্থাপক মাহমুদুন নবী চৌধুরী, প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ সাকির হোসাইন, আকিজ টেলিকম লিমিটেডের হেড অব মার্কেটিং অ্যান্ড ব্র্যান্ড শফিকুর রহমান ও ইউসিএসআই ইউনিভার্সিটির বাংলাদেশ শাখা ক্যাম্পাস প্রভোস্ট চ্যান জো জিম শিক্ষার্থীদের সাফল্যের জন্য অভিনন্দন জানিয়ে বক্তব্য দেন।

কথাবার্তা হলো বেশ। আবার শুরু হলো গানের পালা। জনপ্রিয় শিল্পী ইমরান মাহমুদুল গান শোনাতে এলেন মঞ্চে। ‘তুই কি আমার হবি রে’, ‘দিয়েছি দিল দিল দিল’, ‘কন্যা কন্যা’ গানগুলো গেয়ে শোনান তিনি। গানের পর মঞ্চে আসেন আরেক জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী তাসনিয়া ফারিণ। তিনি ও ইমরান দ্বৈত কণ্ঠে ‘আজ রঙে রঙে রঙিন হব’ গানটি গেয়ে শোনান। তাঁদের পরিবেশনার পর সংগীতশিল্পী জেফার রাহমান মঞ্চে এসে পরিবেশন করেন ‘যতই তুমি বাহানা করো না কেন’ এবং ‘কে দিল পিরিতের বেড়া’ গান দুটি।

এরপর মঞ্চে আসেন অভিনয়শিল্পী তৌসিফ মাহবুব। তিনি শিক্ষার্থীদের দেশকে ভালোবাসার অঙ্গীকার করালেন। সংগীত ও অভিনয়শিল্পী—সবাই মিলে শিক্ষার্থীদের নিয়ে গাইলেন ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি…’।

বেলা তখন গড়িয়ে গেছে। মঞ্চে এসে টেকনাফ থেকে পায়ে হেঁটে এভারেস্ট জয় করার অভিজ্ঞতা শোনালেন পর্বতারোহী ইকরামুল হাসান শাকিল।

মাদক, মিথ্যা ও মুখস্থ—তিন ‘ম’কে শিক্ষার্থীদের না বলার সংকল্প করান প্রথম আলোর ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন, যুব কার্যক্রম ও ইভেন্টের প্রধান সমন্বয়ক মুনির হাসান। পুরস্কার তুলে দেওয়া হলো অনলাইন কুইজের ১০ বিজয়ীর হাতে। পুরস্কার বিতরণ করে প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ শিক্ষার্থীদের পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি পত্রপত্রিকা ও বই পড়তে উৎসাহিত করেন। ধন্যবাদ জানান শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ সবাইকে উৎসবে অংশ নেওয়ার জন্য।

শেষে মঞ্চে এলেন জলের গানের শিল্পীরা। শরতের শেষ বিকেলে কোমল আলোয় তাঁরা ছড়িয়ে দিলেন প্রিয় গানের চেনা সুর ‘এমন যদি হতো আমি পাখির মতো…’। মনে গানের সুরের রেশ আর এক আনন্দময় আলোয় ভরা দিনের স্মৃতি নিয়ে উৎসব থেকে ফিরতি পথ ধরেছিল সেই নবীন কৃতীরা, যারা একদিন এগিয়ে নেবে এ দেশকে।