মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে প্রদর্শিত হচ্ছে কবি শামসুর রাহমানের কবিতার পাণ্ডুলিপি ও শিল্পী আমিনুল ইসলামের শিল্পকর্ম
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে প্রদর্শিত হচ্ছে কবি শামসুর রাহমানের কবিতার পাণ্ডুলিপি ও শিল্পী আমিনুল ইসলামের শিল্পকর্ম

কবিতা ও ছবিতে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো

‘এখানে দরজা ছিলো, দরজার ওপর মাধবীলতার/ একান্ত শোভা। বারান্দায় টব, সাইকেল/ ছিল, তিন চাকা-অলা, সবুজ কথক একজন/ দ্বারবন্দী। রান্নাঘর থেকে উঠত রেশমী ধোঁয়া।/...এখন এখানে কিছু নেই,/ কিচ্ছু নেই। শুধু এক বেকুব দেয়াল, শেল-খাওয়া,/ কেমন দাঁড়ানো, একা। কতিপয় কলঙ্কিত ইট/ আছে পড়ে ইতস্তত। বাঁ দিকে তাকালে ভাঙাচোরা/ একটি পুতুল পাবে, তা ছাড়া এখানে কিছু নেই...।’

আর কি বিশদ বর্ণনার প্রয়োজন আছে? কবিতার এই পঙ্‌ক্তিগুলোই স্পষ্ট করে তুলে ধরে, ১৯৭১-এ কী ভয়াবহ যুদ্ধের তাণ্ডবে লন্ডভন্ড করে দেওয়া হয়েছিল এই জনপদ।
সমকালীন বাংলা কবিতার শ্রেষ্ঠ কবি সম্মানে অভিহিত শামসুর রাহমান ‌‘এখানে দরজা ছিলো’ নামে এ কবিতা লিখেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সেই ভয়াবহ দিনে। ১৯৭১ সালের ৯ জুলাই। কবি এ কবিতা লিখেছিলেন ১৯৬৯ সালে কোহিনূর কেমিক্যাল কোম্পানি থেকে প্রকাশিত একটি কার্ট্রিজ কাগজের ডায়েরিতে। সুন্দর কাগজের ডায়েরিতে কবিতা লিখতে পছন্দ করতেন কবি। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর ভয়, আতঙ্ক, ধ্বংসযজ্ঞ আর অকুতোভয় বাঙালির স্বাধীনতার দুর্বার আকাঙ্ক্ষার কাব্যিক রূপায়ণ করেছিলেন কবি তাঁর সেই সময়ের কবিতায়। ফলে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেরও এক নান্দনিক উপাদান হিসেবে তাঁর এই কবিতাগুলো কালজয়ী হয়ে আছে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় লেখা শামসুর রাহমানের কবিতাগুলো পরবর্তী সময়ে বন্দীশিবির থেকে এবং ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা কাব্যগ্রন্থ দুটিতে প্রকাশিত হয়েছে। ডায়েরিতে লেখা তাঁর মূল পাণ্ডুলিপি এখন প্রদর্শিত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের তৃতীয় গ্যালারিতে। কবির মূল পাণ্ডুলিপির বড় আকারের ডিজিটাল প্রিন্ট আছে এখানে। সঙ্গে আছে মুক্তিযুদ্ধের সময় শিল্পী আমিনুল ইসলামের আঁকা শিল্পকর্ম।

কবির এই ডায়েরি পাওয়া গিয়েছিল বেশ আকস্মিকভাবেই। কবির পুত্রবধূ টিয়া রহমান প্রথম আলোকে জানান, কবির শ্যামলীর বাসার বসার ঘরেই মূলত তাঁর বইপত্র রাখা হয়েছিল। তবে এখানে স্থান সংকুলান না হওয়ায় অনেক বই-খাতা ছাদের একটি ছোট ঘরে স্তূপ করে রাখা হয়। সম্ভবত ১৯৯১ সালের কোনো একদিন তিনি ছাদের ঘর পরিচ্ছন্ন করতে গিয়ে এই ডায়েরি পান। কবি এই ডায়েরির কথা ভুলেই গিয়েছিলেন। হাতে পেয়ে তিনি আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। পরে কবির প্রবল ইচ্ছায় তাঁরা দুজন এই ডায়েরি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে দেন। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সংগ্রহশালার নিবন্ধন তালিকায় এটির সংগ্রহের তারিখ উল্লেখ রয়েছে—২০০০ সালের ৬ আগস্ট।

কবি শামসুর রাহমান

কবি শামসুর রাহমানের এই ডায়েরি পরে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর হুবহু গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছে ২০০৬ সালে। সম্পাদনা করেছেন জাদুঘরের ট্রাস্টি ও প্রাবন্ধিক মফিদুল হক। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ডায়েরিটির প্রথম ও শেষের মলাট ছেঁড়া ছিল। হয়তো সে সময় লুকিয়ে রাখার প্রয়োজনে কবি এটা করেছিলেন। পাণ্ডুলিপিতে অনেক কাটাকুটি, সংশোধনী রয়েছে। এর কিছু কবিতা তিনি কোনোভাবে কলকাতায় পাঠিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বর দেশ পত্রিকায় পরিচয় গোপন করে সেই কবিতাগুলো ছাপা হয়েছিল। পরে সেই কবিতা হাতে হাতে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। এই পাণ্ডুলিপি ফ্যাকসিমিলি (হুবহু) হিসেবে ২০০৬ সালে প্রকাশিত হয়েছে।

শিল্পী আমিনুল ইসলামও মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশেই অবস্থান করছিলেন। তিনিও তখন যুদ্ধের ভয়াবহ পরিস্থিতি তুলে ধরেছিলেন তাঁর শিল্পকর্মে। এই শিল্পকর্মগুলো তিনি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে দান করেছিলেন ২০০৩ সালের ৬ আগস্ট। মোট ৪টি রেখাচিত্র। এর তিনটি প্রদর্শিত হচ্ছে গ্যালারিতে। রেখাচিত্রে দেশকে দেখানো হয়েছে এক নারী হিসেবে। তাঁকে সশস্ত্র সৈনিকেরা ব্যবচ্ছেদ করছে। মফিদুল হক বললেন, ‘গভীর তাৎপর্যময় ও শক্তিশালী অঙ্কনশৈলীর এই কাজগুলোও মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। শুধু সশস্ত্র যোদ্ধারাই নন, আমাদের কবি, শিল্পীসমাজও মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের মেধা, মনন, সৃজনশীলতার প্রয়োগ করেছিলেন। শিল্পী আমিনুল ইসলামের শিল্পকর্ম ও কবি শামসুর রাহমানের এই ডায়েরি তার উজ্জ্বল নিদর্শন হয়ে আছে।’

আমিনুল ইসলাম

ডায়েরির কবিতাগুলোর মধ্যে প্রথমটি ‘যখন তোমাকে’, লেখা হয়েছিল ১৯৭০ সালের ২ অক্টোবর। আর শেষ কবিতাটি ‌শিরোনামহীন। ১৯৭১ সালের ১১ নভেম্বরে লেখা। এ ছাড়া আরেকটি কবিতা শিরোনামহীন ছিল। শিরোনামযুক্ত কবিতা ‌‘আন্তিগোনে’ লেখা হয়েছিল ১০ নভেম্বর ১৯৭১। অন্য কবিতাগুলো হলো ‘সাধারণ বাড়ি’, ‘না, আমি উন্মাদ নই’, ‘অনাবৃষ্টি’, ‘বিচ্ছিন্ন’, ‘ম্যাজিক’, ‘মন্টাজ’, ‘দুঃসময়ের মুখোমুখি’, ‘তোমার নাম’, ‘আত্মজীবনী বিষয়ক’, ‘সাধ’, ‘একজন’, ‘হে বঙ্গ’, ‘চে গুয়েভারার চোখ’, ‘কথা’, ‘কেমন বদলে গেছি’, ‘তোমাকে দেখার জন্য’, ‘এখানে দরজা ছিলো’, ‘প্রবেশাধিকার নেই’, ‘দখলীস্বত্ব’, ‘কাক’, ‘পথের কুকুর’, ‘বন্দীশিবির থেকে’, ‘আমারও সৈনিক ছিলো’, ‘প্রতিশ্রুতি’, ‘না, আমি যাব না’, ‘কিছুই নেই’, ‘উদ্ধার’, ‘প্রাত্যহিক’, ‘মধুস্মৃতি’, ‘ললাটে নক্ষত্র ছিল যার’, ‘প্রতিটি অক্ষরে’, ‘স্যামসন’, ‘মন্তাজ’ ও ‘আমড়াগাছি করা’। প্রথম চারটি কবিতা ২ অক্টোবর ১৯৭০ থেকে ২১ ডিসেম্বর ১৯৭০ সালের মধ্যে লেখা। বাকিগুলো ১২ জানুয়ারি ১৯৭১ থেকে ১১ নভেম্বর পর্যন্ত। এর মধ্যে ‘বন্দীশিবির থেকে’ কবিতা, যেটির শিরোনাম থেকেই কাব্যগ্রন্থের নামকরণ করেছিলেন কবি, সেই কবিতা লেখা হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১ জুলাই।

ডায়েরির কবিতাগুলোর মধ্যে ‘মন্টাজ’ ও ‘মন্তাজ’ নামে দুটি কবিতা আছে। প্রথমটি লেখা হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৮ জানুয়ারি, দ্বিতীয় ভাষ্যটির তারিখ নেই। এরপর ওই ডায়েরিতে আর কোনো কবিতাও লেখেননি কবি। সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করা হয়েছে, ‘দ্বিতীয় ভাষ্যের পর ডায়েরিতে বাদবাকি প্রায় সব পৃষ্ঠা সাদা, বোঝা যায়, এরপর খুব দ্রুতই ঝলমলে পতাকা উড়িয়ে স্বাধীনতা এসে হাজির হয় বাংলায়।’ সবুজের বুকে রক্তলাল সেই পতাকা ওড়ানোর চিরগৌরবের দিন ফিরে এল আজ আবার।