উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে বিমান বিধ্বস্ত
উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে বিমান বিধ্বস্ত

সরেজমিন

শোকে স্তব্ধ উত্তরা, ঘরে ঘরে বেদনা

শোকের ছায়ায় বিষণ্ন হয়ে আছে উত্তরা। দিয়াবাড়ির মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় নিষ্পাপ শিশুসহ ৩২ জনের মর্মান্তিক মৃত্যুর শোক যেন কালো মেঘের মতো ঘনিয়ে এসেছে উত্তরা এলাকার বাসিন্দাদের মনে। ঘরে ঘরে বেদনা।

গত সোমবার বিমান দুর্ঘটনার পর থেকেই কোমলমতি শিশুদের মৃত্যু ও যন্ত্রণায় দেশবাসীর মন বেদনাবিধুর হয়ে ওঠে। তবে উত্তরার পরিবেশ ছিল হৃদয়বিদারক। সেদিন বিকেল থেকেই জীবনযাত্রা অনেকটা মন্থর হয়ে পড়ে। সেক্টরগুলোর হোটেল–রেস্তোরাঁ, ব্যস্ত বিপণিবিতান, তরুণদের আড্ডায় প্রাণবন্ত হয়ে থাকার জনপরিসরগুলো সন্ধ্যার পর থেকে অনেকটাই জনবিরল হয়ে যায়। সেক্টরের ভেতরের সড়কগুলোতেও যানবাহন চলাচল কমে আসে। জীবনযাত্রার স্বাভাবিক প্রাণচাঞ্চল্য ছিল ম্লান–মন্থর।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বিধ্বস্ত স্থান ঘিরে রেখেছেন। গতকালের ছবি

গতকালও সেই শোকাচ্ছন্নতা অনেকটাই বজায় ছিল। উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরের গৃহবধূ তামান্না আক্তার প্রথম আলোকে জানালেন, তাঁর ছেলে মোবাশ্বের রহমান মাইলস্টোন স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। ঘটনার দিন তিনি ছেলেকে আনতে স্কুলের প্রধান ফটকে কাছে অপেক্ষা করছিলেন। ছেলে শ্রেণিকক্ষ থেকে দুর্ঘটনার অল্প কিছুক্ষণ আগেই বের হয়েছিল। ওর এক সহপাঠী অগ্নিদগ্ধ হয়েছে। দুর্ঘটনার ঘণ্টাখানেক পরে তিনি ছেলেকে পেয়েছেন। তিনি বললেন, ওই সময়টা যে কীভাবে কেটেছে তা একমাত্র আল্লাহ তাআলাই জানেন। ছেলে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। ধোঁয়ায় শ্বাসকষ্ট হওয়ায় ছেলেকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন।

বিকেলে কথা হচ্ছিল রেজাউল হকের সঙ্গে। তিনি ময়মনসিংহ টিচার্স ট্রেনিং কলেজের শিক্ষক। বাসা দিয়াবাড়িতে। তাঁর দুই ছেলে–মেয়ে মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী। তাঁর কাছে জানা গেল, উত্তরা এলাকায় মাইলস্টোন স্কুলের অনেক শিক্ষার্থী। দিয়াবাড়ির ক্যাম্পাসটিই সবচেয়ে বড়। এ ছাড়া উত্তরায় ৪, ৭, ১১ নম্বর সেক্টরসহ বিভিন্ন সেক্টরে মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজের আরও বেশ কটি শাখা আছে। উত্তরা ও আশপাশের অনেক এলাকার বাসিন্দার সন্তানেরা মাইলস্টোনের শাখাগুলোর শিক্ষার্থী। ফলে দিয়াবাড়ি শাখার দুর্ঘটনার শোক ও বেদনা শুধু এই শাখার অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মনেই নয়, সব শাখার শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মনেও গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। তিনি নিজেও মনোবেদনায় ভারাক্রান্ত।

সবাই মাসুম বাচ্চা। তারা তো আমাদেরই সন্তান। তাই ঘরে ঘরে কান্নাকাটি। মোনাজাতের সময় মানুষ অঝোরে কান্নাকাটি করে দোয়া করেছেন
কেফায়েত উল্লাহ, ইমাম, ৯ নম্বর সেক্টর জামে মসজিদ, উত্তরা

দিয়াবাড়ি থেকে পশ্চিমে নয়ানগর এলাকা থেকে গৃহবধূ ঈশিতা জাহান গতকাল বিকেলে মাইলস্টোন কলেজের সামনে এসেছিলেন পরিস্থিতি দেখতে। তাঁর এক ভাগনি এই স্কুলে পড়ে। সে ভালো আছে। তিনি জানালেন, উত্তরার পার্শ্ববর্তী দিয়াবাড়ি, নয়ানগর, রানাভোলা, পুরান কালিয়া, শুকুরভাঙ্গা, ধরেঙ্গার টেক, দলিপাড়া, খালপাড়—এসব এলাকায় বসবাসকারীদের সন্তানেরা অধিকাংশই মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়ে। সে কারণে কারও নিজের সন্তান এই স্কুলে না পড়লেও হয়তো প্রতিবেশী বা আত্মীয়ের ছেলেমেয়েরা পড়ে। তাঁদের শোক–দুঃখে অন্যরাও সহমর্মী হয়েছেন।

কথা হলো উত্তরার ৯ নম্বর সেক্টরের জামে মসজিদের ইমাম কেফায়েত উল্লাহর সঙ্গে। বিষণ্ন কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘উত্তরার সব মসজিদে জোহর নামাজের পর বিশেষ দোয়াখায়ের হয়েছে। দুর্ঘটনায় কার সন্তান আছে আর কার সন্তান নেই, সে কথা কেউ ভাবেনি। সবাই মাসুম বাচ্চা। তারা তো আমাদেরই সন্তান। তাই ঘরে ঘরে কান্নাকাটি। মোনাজাতের সময় মানুষ অঝোরে কান্নাকাটি করে দোয়া করেছেন।’

স্কুলে পাওয়া ছেঁড়া খাতা, পুড়ে যাওয়া ব্যাগ

বিকেলে দিয়াবাড়ি গিয়ে গোলচত্বরের সামনে নানা বয়সের শত শত মানুষের ভিড় দেখা গেল। মেট্রোরেলের উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে হাঁটা দূরত্বেই দুর্ঘটনাস্থল। দলে দলে মানুষ মেট্রো থেকে নেমে দুর্ঘটনাস্থলের দিকে যাচ্ছেন। গোলচত্বরের সামনে সেনা, পুলিশ, র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রচুর সদস্য মোতায়েন। উৎসুক মানুষ মাইলস্টোন স্কুলের দক্ষিণ পাশের ফটক পর্যন্ত যেতে পারলেও ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে মোবাইল ফোন সার্ভিসের ব্যবসায়ী মনির হোসেন ঢাকায় এসেছিলেন কিছু যন্ত্রপাতি কিনতে। কেনাকাটা সেরে তিনিও শাহবাগ থেকে মেট্রোরেলে উত্তরায় এসেছেন ঘটনাস্থল স্বচক্ষে দেখতে। তিনি বললেন, খুবই দুঃখজনক ঘটনা। ঢাকায় আসার সময়েই পরিকল্পনা করেছিলেন ঘটনাস্থল দেখতে আসবেন। তবে ভেতরে যেতে পারলেন না বলে একটু আফসোস হচ্ছে।

একটা বেদনাঘন দিনের শেষে সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসছিল রাজধানীর এই প্রান্তবর্তী এলাকায়। অনেক মানুষ তখনো সমবেত ছিলেন দিয়াবাড়ির গোলচত্বরে। তাঁদের দৃষ্টি বিষণ্ন। মন এমন এক ব্যথায় ভরা, যা মুখে বলে বোঝানো যায় না।