
প্রথম দফা অস্ত্রোপচারে গুলি বের করা সম্ভব হয়নি। পাঁজরের ভাঙা হাড় ঠিক করা হয়েছিল। দ্বিতীয় অস্ত্রোপচারে গুলি বের করা সম্ভব হয়। বুকে অস্ত্রোপচারের গভীর দাগ। ৯ মাস হয়ে গেলেও সময়ে সময়ে শরীরে যন্ত্রণা হয়। বেশিক্ষণ শুয়ে–বসে থাকতে পারেন না। তবে শারীরিক অবস্থা যা–ই হোক, পড়ালেখায় আর অবহেলা করবেন না, সেই লক্ষ্য নিয়ে এবার এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছেন জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত মো. জুবায়ের আহম্মেদ (১৯)। এর আগে অর্থসংকটে তিনি তিন বছর এসএসসি পরীক্ষা দিতে পারেননি। আগামীকাল ১৩ মে তাঁর শেষ পরীক্ষা।
মো. জাকির হোসেন ও জেসমিন আক্তার দম্পতির দুই ছেলেমেয়ের মধ্যে ছোট জুবায়ের। তাঁরা থাকেন রাজধানীর তুরাগ থানার কামারপাড়া এলাকায়। বাবা জাকির হোসেন গাড়িচালক। আর বোন জাকিয়া সুলতানা বাড্ডায় নিজের সংসারে থাকেন। জুবায়ের কামারপাড়া উচ্চবিদ্যালয়ের মানবিক বিভাগের ছাত্র হিসেবে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছেন।
গতকাল রোববার জুবায়েরের সঙ্গে কথা হয়। সে সময় তিনি পড়াশোনা নিয়ে তাঁর আগ্রহ, লড়াই, সেনাসদস্য হতে চাওয়ার স্বপ্ন, জুলাই অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া আর দেশ নিয়ে প্রত্যাশার কথা জানালেন। ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি উচ্চতার জুবায়েরের লক্ষ্য ছিল সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া। নিজেকে সেভাবেই তৈরি করছিলেন। স্কাউটের সদস্য হয়েছিলেন। গুলিবিদ্ধ হওয়ায় সেনাসদস্য হওয়ার স্বপ্ন আর পূরণ হবে না বলে মনে করছেন তিনি। তবে তাঁর এখন গর্ব হয় অভ্যুত্থানে অংশ নিয়ে দেশের জন্য কিছু করতে পেরেছেন এই ভেবে।
গত বছরের ৪ আগস্ট দুপুর ১২টার দিকে উত্তরায় বিএনএস সেন্টারের সামনে জুবায়ের গুলিবিদ্ধ হন। গুলি তাঁর পাঁজরের নিচের অংশ ভেদ করে পাকস্থলী স্পর্শ করে বাঁ পাশে আটকে যায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসার কাগজপত্রে জুবায়েরের বিষয়ে লেখা, ‘বুলেট ইনজুরি’।
‘শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল, শার্ট খুলে দেখি বুকে ছিদ্র’
জুবায়ের জানান, জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে স্থানীয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তিনি ও তাঁর বন্ধু নাঈম আন্দোলনে যোগ দেওয়া শুরু করেন। ১৮ জুলাই মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ শহীদ হওয়ার পর তিনি প্রচণ্ড বিষণ্ন হয়েছিলেন। মুগ্ধ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন স্কাউট গ্রুপের সদস্য ছিলেন। ২০২২ সাল থেকে ওই একই গ্রুপের সদস্য জুবায়ের। তিনি জানান, আন্দোলনে অংশ নেওয়ার পর ২ আগস্ট তাঁর পায়ে ছররা গুলি লাগে। সেটা ততটা গুরুতর ছিল না। ৪ আগস্ট সকাল ১০টায় শিক্ষার্থীদের দলের সঙ্গে তিনি বের হন।
জুবায়ের বলেন, ‘দুপুর ১২টার দিকে বুকের হাড়ে ভারী কিছু আঘাত করার মতো অনুভূত হয়। শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। শার্ট খুলে ফেললাম। শার্ট খুলে দেখি, বুকে ছিদ্র। কয়েক সেকেন্ড পর রক্ত পড়া শুরু হলো। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে পাঁচ–সাত কদম দৌড়ে বন্ধুর কাছে গিয়ে বলি, দোস্ত, আমার গুলি লেগেছে। এটা বলেই নিচে পড়ে যাই।’
জুবায়ের বলেন, তিনি কখনো অচেতন ছিলেন, কখনো জ্ঞান ছিল। পরে শুনেছেন, তাঁকে শিক্ষার্থীরা কাছের একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে ব্যান্ডেজ করে দেওয়ার পর আরেকটি বড় হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে অক্সিজেন ও রক্ত দেওয়া হয়। পরীক্ষা করে শনাক্ত করা হয় গুলিটি কোথায় আটকে আছে। পরে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু তাঁরা উত্তরায় অন্য একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে এমআরআইসহ বেশ কয়েকটি পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে অস্ত্রোপচারের জন্য অপেক্ষা করতে বলা হয়। কিন্তু পরে ‘ঝামেলার ভয়ে’ অস্ত্রোপচার না করেই পরীক্ষা–নিরীক্ষা বাবদ ১৯ হাজার টাকা বিল ধরিয়ে দেয়। অনেক দেনদরবার করে ওই হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছাতে পৌঁছাতে তাঁদের সন্ধ্যা সাতটা বেজে যায়।
হাসপাতালের কিছু দৃশ্যের কথা উল্লেখ করে জুবায়ের বলেন, ‘চারপাশে শুধু রক্তাক্ত মানুষ দেখছিলাম। কেউ আহত। কেউ মৃত। আমার সামনে দাঁড়িয়ে সেসব দৃশ্য আড়াল করার চেষ্টা করছিলেন ভাইয়ারা (হাসপাতালে নিয়ে আসা শিক্ষার্থীরা)।’ তিনি জানান, ভোর চারটায় তাঁর অস্ত্রোপচার হয়। সেদিনের অস্ত্রোপচারে গুলি বের করা যায়নি। পাঁজরের ভেঙে যাওয়া হাড় ঠিক করা হয়েছিল। এর ১২ দিন পর পিঠে অস্ত্রোপচার করে গুলিটি বের করা হয়। তিন সপ্তাহ পর তিনি হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরে আসেন। চিকিৎসকেরা বলেছেন, তাঁর গুলি ‘স্নাইপার শট’ ছিল।
জুবায়ের বলেন, ‘৫ আগস্ট হাসপাতালের পর্যবেক্ষণ কক্ষে আধো ঘুম–আধো জাগরণের মধ্যে শুনতে পেলাম, কেউ একজন বলছে, শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছে। পরে এক ভাইয়া এসে আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, “তোমার রক্ত বৃথা যায়নি।” আমি চোখ খুলতে পারছিলাম না। যা শুনছি, তা ঠিক কি না বুঝতে পারছিলাম না। সবকিছু অবিশ্বাস্য লাগছিল।’
জুবায়েরের মা জেসমিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ছেলে লুকিয়ে লুকিয়ে আন্দোলনে যেত। অনেক সময় বাধাও দিয়েছেন। ছেলের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পেয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। কিন্তু হাসপাতালে যাওয়ার পর চারপাশের দৃশ্য দেখে ছেলের জন্য কষ্ট দূর হয়ে গিয়েছিল। বললেন, ‘আহা! কত মায়ের যে বুক খালি হয়ে গেছে!’
‘পড়াশোনা আর ছাড়তে চাই না’
জুবায়ের জানালেন, পরিবারে অনটনের মধ্যে নবম শ্রেণি থেকে তাঁর স্কুলের বেতন জমা পড়তে থাকে। মাসের বেতন ৫০০ টাকা। তা–ও দিতে পারছিল না পরিবার। তিনি মোবাইল ফোন সার্ভিসিংয়ের দোকান, কাপড়ের দোকান, প্রসাধনসামগ্রীর দোকানে কাজ করে আয় করতেন। তা দিয়ে কখনো কিছু বেতন পরিশোধ করে স্কুলে টিকে থাকতেন। কিন্তু বকেয়া বেতন ও পরীক্ষার ফি পরিশোধ করতে না পারলে স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে দেয় না। এ কারণে পরপর তিন বছর তিনি পরীক্ষা দিতে পারেননি। এবার চিকিৎসা সহায়তা, জমানো অর্থ ও ভগ্নিপতির সহায়তায় বকেয়া বেতন ও ফি বাবদ ১৯ হাজার টাকা পরিশোধ করে পরীক্ষা দিচ্ছেন। স্কুল কর্তৃপক্ষ পাঁচ হাজার টাকার মতো ছাড় দিয়েছে।
জেসমিন আক্তার জানান, জুবায়েরের বাবার অনেক ঋণ আছে। তিনি (বাবা) পড়ালেখার পেছনে খরচ করতে পারেন না। তাঁদের মেয়ে মেধাবী। টিউশনি করে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছিলেন। বিয়ের পর জামাতা মেয়ের পড়াশোনার খরচ জুগিয়েছেন। মেয়ে স্নাতক পাস করেছেন। জুবায়ের পরিবার থেকে সহায়তা না পেয়ে পড়াশোনা চালাতে পারছিলেন না। তবে এখন তিনি জুবায়েরকে পড়াশোনা করতে উৎসাহ দিচ্ছেন।
জুবায়ের বলেন, ‘পড়াশোনা আর ছাড়তে চাই না। আমি ভিডিওগ্রাফি পারি। ভালো ক্যামেরা পেলে এ কাজ করে কিছু আয় করতে পারব। দুটো অস্ত্রোপচার হয়েছে। তাই সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার স্বপ্ন তো আর পূরণ হবে না! অনেকে পরামর্শ দিয়েছেন, সেনাবাহিনীতে তবু আবেদন করতে। দেখি, আবেদন করে দেখব কী হয়!’
জুবায়ের আরও বলেন, ‘আহত হয়েছি, শরীরে অনেক যন্ত্রণা হয়। পরীক্ষার মাঝখানেও অনেক কষ্ট পাচ্ছিলাম। কিন্তু সেসব নিয়ে আর আফসোস হয় না। দেশটা যেন ভালো থাকে। এমন একটি সরকার যেন থাকে, যারা দুর্নীতি করবে না, অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করবে, জনগণের পক্ষে থাকবে।’