জন্মভিটার টানে ৭৬ বছর পর ভারত থেকে ৫/১ পূর্ণ চন্দ্র ব্যানার্জি লেনে

নিজের জন্মভিটায় গায়ত্রী কুণ্ডু। তাঁর দেখা সেই সবুজ গেট, লম্বা বারান্দা, প্যাঁচানো সিঁড়ি, কাঠ গোলাপের গাছ, নিচের রান্নাঘর, ছাদের ঘর, ঠাকুরঘর আর নেই। এখন সেখানে ইট–সিমেন্টের ভবন
ছবি: একুশ তাপাদার

৫/১ পূর্ণ চন্দ্র ব্যানার্জি লেন, শিংটোলা। এই ঠিকানায় ভবনটির বর্তমান নাম মোসাম্মৎ রহিমা ভিলা। এটি এখন ইট-কাঠ-সিমেন্টের ফ্ল্যাটবাড়ি। এই ফ্ল্যাটবাড়িতেই ইট-কাঠের ভেতর গায়ত্রী কুণ্ডু খুঁজছিলেন সবুজ গেট, লম্বা বারান্দা, প্যাঁচানো সিঁড়ি, কাঠ গোলাপের গাছ, নিচের রান্নাঘর, ছাদের ঘর, ঠাকুরঘর, কীর্তনের শব্দ। কিন্তু ৫/১ পূর্ণ চন্দ্র ব্যানার্জি লেনে ঠিকানাটুকু ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পেলেন না। পাবেন কীভাবে? কীর্তনের সুর, কাঠের রং করা পুতুল, ছাদে ঘুড়ি ওড়ানো, বাড়ির চৌবাচ্চা—এগুলো তো গায়ত্রী কুণ্ডুর মাত্র বছর পাঁচেক বয়সের স্মৃতি। এখন গায়ত্রী কুণ্ডুর বয়স হয়েছে ৮০ বছরের বেশি। আর সবুজ গেটের বাড়িটি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর কেটে গেছে ৭৬ বছর।

শুধু ঠিকানাটাই এক আছে, আর সবকিছু বদলে গেছে

৭৬ বছর পর জন্মভিটায় বাড়িটি দেখতে না পাওয়া আবার একই সঙ্গে ঠিকানাটা তো আছে—এই দুইয়ে মিলে গায়ত্রী কুণ্ডু স্মৃতি ও বর্তমানের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন। ঠিকানা খুঁজে পাওয়ার অনুভূতি প্রকাশ করার জন্য জুতসই ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। বললেন, ‘১৯৪৬ সালে জন্মভিটা ছেড়ে লঞ্চে করে কলকাতা গিয়েছিলাম। আর কখনো ফেরা হবে তা ভাবিনি। একলা আসতেও পারতাম না। মেয়ে নিয়ে এসেছে, তাই জন্মভিটাটা আবার দেখতে পেলাম। ভেবেছিলাম কাঠ গোলাপের গাছের গোড়া থেকে একটু মাটি নিয়ে ফিরব। গাছটিই নেই, আর চারপাশে ইট-সিমেন্টের ছড়াছড়ি, মাটি তো নেই। তারপরও ঢাকার একটু মাটি হলেও তা সঙ্গে করে নিয়ে যাব।’

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার হাওড়া থেকে স্কুলশিক্ষক মেয়ে দেবাঞ্জলি কুণ্ডুর হাত ধরে জন্মভিটা খুঁজতে বাংলাদেশের পুরান ঢাকায় এসেছিলেন গায়ত্রী কুণ্ডু। গত বৃহস্পতিবার থেকে গতকাল সোমবার বিকেল পর্যন্ত ছিলেন ঢাকায়। এই সাড়ে চার দিনের সফরে স্মৃতি হাতড়ে বেড়িয়েছেন গায়ত্রী কুণ্ডু।

গতকাল সকালে রাজধানীর একটি হোটেলে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা হয় গায়ত্রী কুণ্ডু ও দেবাঞ্জলি কুণ্ডুর। গায়ত্রী কুণ্ডু আলাপের সময় বারবার বলছিলেন, ‘আমার জন্মটা তো এ বাড়িতেই হয়েছিল। আট ভাইবোনের মধ্যে চারজনেরই জন্ম এখানে। তবে এখানে যাঁদের জন্ম, আমি ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই। বাবা-জ্যাঠা-কাকারা নেই। তাঁরা থাকলে আমার গল্প শুনলে খুব খুশি হতেন। এখন কলকাতা ফিরে গিয়ে বন্ধু ও অন্য আত্মীয়দের সঙ্গে জন্মভিটার গল্প করব।’

এই বাড়ি ঘিরে কতশত স্মৃতি, শৈশবের সেই সব স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসেছিলেন অশীতিপর গায়ত্রী কুণ্ডু

১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় জন্মভিটা ছাড়তে বাধ্য হওয়া গায়ত্রী কুণ্ডু বলছিলেন, ১৯৪৬ সালে দেশ ছাড়লেন। তখন বয়স খুব কম থাকলেও স্মৃতিগুলো কেমন যেন স্পষ্ট। দেশভাগের পর বাবা-কাকাদের চোখে জল দেখতেন। আস্তে আস্তে কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে থিতু হতে হলো। আর বিয়ের পর হাওড়ায় সংসার পাতলেন।

গায়ত্রী কুণ্ডুর পাশে বসা মেয়ে দেবাঞ্জলি কুণ্ডু বললেন, ‘মা শারীরিকভাবে কলকাতায় গিয়েছিলেন। কিন্তু মনটা পড়ে ছিল এখানে। মা তাঁর জন্মভিটা নিয়ে এত গল্প করেছেন যে আমরা যারা বাড়িটি দেখিনি, তারাও বাড়িটির কোন জায়গায় কী ছিল, তা চোখের সামনে দেখতে পেতাম। বয়স বাড়তে থাকায় মায়ের স্মৃতিচারণা বেড়ে গিয়েছিল। শুধু বলতেন, একবার যদি জন্মভিটায় যেতে পারতাম! আমিও ভাবলাম, এটা তো আর অসম্ভব কিছু না। বিভিন্ন জটিলতায় আসতে একটু দেরি হলো। তারপরও মায়ের ইচ্ছাটা পূরণ হলো, আমার জন্যও এটা বড় প্রাপ্তি।’

দেবাঞ্জলি জানালেন, এই বাড়িতে জন্ম নেওয়া তাঁর এক মামাও এখানে আসতে চেয়েছিলেন, তবে তিনি মারা গেছেন। আরও আগে বাংলাদেশে আসতে পারলে এই মামার ইচ্ছেটাও পূরণ করা সম্ভব হতো।

চেনা সেই বাড়ির প্রাঙ্গণ আর নেই; সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে পুরোনো সেই সময়টাকে আরেকবার যেন খুঁজে ফিরছিলেন গায়ত্রী কুণ্ডু

গায়ত্রী কুণ্ডু মেয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। তাঁর দুই মেয়ের মধ্যে এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে। এই মেয়ে একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। কাজের ফাঁকে মায়ের ইচ্ছে পূরণে তাঁকে বাংলাদেশের পুরান ঢাকায় নিয়ে এসেছেন। গায়ত্রী বললেন, ‘জন্মভিটা আবার দেখতে পাওয়ার যে স্মৃতি, তা যত দিন বাঁচব, তত দিন মনে রাখব।

২০০১ সালে আমার এক ভাইঝি বাংলাদেশে এসেছিল, তখনো বাড়িটা আগের মতোই ছিল। এখন আর বাড়িটা নেই। সূত্রাপুর, সদরঘাট, বাংলাবাজার, বাবা-কাকার প্রেস, লাইব্রেরি, বড় বড় মজার গন্ধ মাখানো বড় কলা, বাখরখানি—কত স্মৃতি! সময় কম বলে অনেক কিছুই দেখা হলো না। তবে জন্মভিটার সঙ্গে আবার যোগাযোগটা হলো। বেঁচে থাকলে আবার আসার চেষ্টা করব।’

গায়ত্রী কুণ্ডুর স্বামী দিলীপ কুমার কুণ্ডু মারা গেছেন ২০০৭ সালে। গায়ত্রী বললেন, ‘আমার মুখে গল্প শুনে স্বামী আমাকে বাঙাল বলে খেপাতেন। শুঁটকি খাওয়া নিয়ে হাসাহাসি করতেন।’

সেই ছোট্ট গায়ত্রীকে পরিবারের সঙ্গে কেন জন্মভিটা ছাড়তে হয়েছিল, তা নিয়ে ৮০ বছর বয়সী গায়ত্রী কুণ্ডুর কণ্ঠে আক্ষেপ, ‘মানুষ কেন এমন করে? হিন্দু-মুসলমান মিলে আমরা তো ভালোই ছিলাম। রাজনীতি তো বুঝতে পারি না।’ পূর্ববঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গ, পাকিস্তান, বাংলাদেশ—মানচিত্রের বদল ঘটলেও গায়ত্রী কুণ্ডুর স্মৃতিরা সেই একই জায়গায় আটকে আছে।

‘এ দেশের মানুষ দারুণ’

গায়ত্রী কুণ্ডু বাংলাদেশ আর বাংলাদেশের মানুষের প্রশংসা করে বারবার বলছিলেন, দারুণ! চেনা নেই জানা নেই—এই মানুষগুলোই তাঁদের বাড়িতে নিয়ে যেভাবে আপ্যায়ন করেছেন, তা চিন্তাই করা যায় না।

গায়ত্রী কুণ্ডু যখন মেয়ের হাত ধরে পথে নেমেছিলেন, তখন তাঁর কাছে স্মৃতি হাতড়ে ছিল বাড়ির ঠিকানাটি। পুরান ঢাকার অলিগলি ভেদ করে এ ঠিকানা খুঁজে বের করা ছিল কঠিন সংগ্রামের। তবে দেবাঞ্জলি কুণ্ডুর বন্ধু শান্তা ভট্টাচার্য তাঁদের এই অনুসন্ধানকে একটু সহজ করে দিতে মা ও মেয়ের সঙ্গে বাংলাদেশে এসেছিলেন।

শান্তার সূত্রে ডেইলি স্টারের সাংবাদিক একুশ তাপাদার, সৌরভ চৌধুরী, শিংটোলার পঞ্চায়েত প্রধান আলমগীর সিকদার লোটন, পুরান ঢাকার কাজী নাদিমসহ অনেকেই গায়ত্রী কুণ্ডুর জন্মভিটা খোঁজায় যোগ দেন। মা ও মেয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপচারিতায় বারবার এই মানুষগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছিলেন। বিউটি বোর্ডিংয়ে বসে জন্মভিটা খুঁজতে বের হওয়ার আলোচনা করার সময়ই সেখানে কাকতালীয়ভাবে কথা হয়েছিল শিংটোলার পঞ্চায়েত প্রধান আলমগীর সিকদার লোটন ও কাজী নাদিমের সঙ্গে। তাঁরাই ঠিকানাটা শুনে জায়গা চেনেন বলে জানান।

একুশ তাপাদার ডেইলি স্টারে এই মা ও মেয়েকে নিয়ে প্রতিবেদন করেছেন। শান্তা ভট্টাচার্য, সৌরভ চৌধুরীসহ অন্যরা নিজেদের ফেসবুকে এ বিষয়ে আবেগপ্রবণ পোস্ট দিয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেওয়ার জন্য সৌরভ চৌধুরী চট্টগ্রাম থেকে আট মাস বয়সী মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে হাজির হয়েছিলেন ঢাকায়।

নতুন কিছু স্মৃতি নিয়ে হাসিমুখে বাড়ি ফিরেছেন গায়ত্রী কুণ্ডু ও তাঁর মেয়ে দেবাঞ্জলি কুণ্ডু

৬০ বছর বয়সী কাজী নাদিমের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয়। জানালেন, তিনি ও আলমগীর সিকদার বিউটি বোর্ডিংয়ে বসে নাশতা করছিলেন। তখনই গায়ত্রী কুণ্ডুর সঙ্গে পরিচয় হয়। গায়ত্রী কুণ্ডুদের বাড়িটি হাতবদলের একপর্যায়ে কাজী নাদিমের বন্ধুর বাসা ছিল। সেই সূত্রে ওই বাড়িতে তাঁর যাতায়াত ছিল। ওই বাড়িটিতে গিয়ে গায়ত্রী আর নাদিম বাড়ির যে বর্ণনা দিচ্ছিলেন, তা মিলে যাচ্ছিল।

কাজী নাদিম বললেন, ‘হাওড়া থেকে একজন বয়স্ক নারী তাঁর জন্মভিটা খুঁজতে এসেছেন। আমরাও আবেগতাড়িত হয়ে পড়ি। আমরা আমাদের দিক থেকে যথাসাধ্য সহায়তা করার চেষ্টা করেছি।’

গায়ত্রী কুণ্ডু হাওড়ায় নিজের ঠিকানায় ফিরেছেন পুরান ঢাকার বাখরখানি নিয়ে। ফেরার আগে প্রথম আলোকে বলছিলেন, এখানে থেকে যাওয়ার কোনো সুযোগ থাকলে থেকে যেতেন। তবে আবার আসতে চান জন্মভিটায়।

আর মেয়ে দেবাঞ্জলি কুণ্ডু বললেন, ‘মায়ের সঙ্গে আমিও এসেছিলাম আমার শিকড়ের সন্ধানে। মায়ের স্মৃতির সঙ্গে অনেক কিছুই মেলেনি। উত্তেজনা, আবেগ, নস্টালজিয়া—সব মিলে মা এই বয়সে সব সামলে নিতে পারবেন কি না, সেই ভয়েও ছিলাম। এখন মা ও মেয়ে ফিরে যাচ্ছি নতুন কিছু স্মৃতি নিয়ে।’

দেবাঞ্জলি জানান, তাঁর মায়ের ইচ্ছা ছিল জন্মভিটার উঠানের মাটি নিয়ে আসবেন। তবে সেখানে ভবন ওঠায় তা আর সম্ভব হয়নি। পরে ঢাকার একটু মাটি তাঁরা নিয়ে যেতে পেরেছেন। বিমানবন্দরে আটকে দিলেও অনুরোধ করে এক মুঠো মাটি তাঁরা নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পান।